Government Land Encroachment

ভূমিতে ঘুঘুর বাসা, ভাঙবে তবে ছিল আশা

কয়েক বছর আগে রেলশহরে এক প্রশাসনিক বৈঠকে খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সরকারি জমি বেহাত হওয়ার নালিশ করেছিলেন জেলা কর্মাধ্যক্ষ নির্মল ঘোষ।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৪ ০৯:৩৩
ঝাড়গ্রাম শহরের একলব্য সরনির রাস্তার পাশে দখল হয়ে যাওয়া সরকারি জমি।

ঝাড়গ্রাম শহরের একলব্য সরনির রাস্তার পাশে দখল হয়ে যাওয়া সরকারি জমি। নিজস্ব চিত্র।

প্রায় বছর আটেক বাদে ঝাড়গ্রামে মাসির বাড়িতে বেড়াতে এসে হতবাক যাদবপুরের বাসিন্দা সঞ্চয়িতা প্রামাণিক! প্রাতর্ভ্রমণের রাস্তার ধারের ফাঁকা প্রান্তরটাই তো উধাও! একলব্য সরণির ধারে সরকারি ওই ‘জমি দখল করা নিষিদ্ধ’-এর বোর্ডটাও এখন নেই।

Advertisement

ফাঁকা সরকারি জমিতে মাথা তুলেছে একের পর এক বাড়িঘর। ঝাড়গ্রাম জেলা হওয়ার পর জমির দাম এখন আকাশছোঁয়া। পাল্লা দিয়ে অরণ্যশহরে বেআইনি কংক্রিটের বাড়বাড়ন্তের জন্য জমি মাফিয়া রাজই দায়ী বলে অভিযোগ। বাড়ছে প্রোমোটার চক্র। অরণ্যশহর ঝাড়গ্রাম থেকে পড়শি জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরের রেল শহর খড়্গপুরের জমি দখলের চিত্রটা একই রকম।

কয়েক বছর আগে রেলশহরে এক প্রশাসনিক বৈঠকে খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সরকারি জমি বেহাত হওয়ার নালিশ করেছিলেন জেলা কর্মাধ্যক্ষ নির্মল ঘোষ। কড়া পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে জমি পুনরুদ্ধার দূরের কথা, খড়্গপুর শহরের ইন্দা ছাড়িয়ে পাঁচবেড়িয়া, দেবলপুর, রাজগ্রাম, মালঞ্চ, তালবাগিচা, কৌশল্যা, ঝাপেটাপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় বেদখল হয়েছে সরকারি জমি। কোথাও স্কুলের জমিতে হয়েছে ক্লাবঘর, কোথাও সরকারি জমি দখল করে বাড়ি তৈরির অভিযোগ উঠেছে। এমনকি রেলশহরে রেলের মতো কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমিও বেদখল হয়ে গিয়েছে। রেলের জমিতে বস্তি ছাড়াও গজিয়ে উঠেছে দোকানপাট থেকে রাজনৈতিক দলগুলির ঝা-চকচকে কার্যালয়। জেলার প্রশাসনিক সভামঞ্চ থেকেই রেলের জমিতে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রেল কর্তৃপক্ষকে তোপ দেগে লাগাতার আন্দোলনের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। এ বার মুখ্যমন্ত্রীর মুখে সরকারি জমি দখলে কড়া পদক্ষেপের কথা শুনে বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক খড়্গপুরের পুরপ্রতিনিধি অভিষেক আগরওয়াল বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে নির্দেশ দিয়েছেন তা কার্যকর হোক আমরাও চাই। কিন্তু রেলের জমির ক্ষেত্রে দ্বিচারিতা কেন? তৃণমূলের নেতারাই রেলের মতো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের জমি দখলে মদত দিচ্ছেন।” যদিও তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদক দেবাশিস চৌধুরী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী তো উচ্ছেদ নয়, হকার জোন করে রাস্তা ফাঁকা করতে বলছেন। কিন্তু রেল তো দীর্ঘবছর ধরে বসবাসকারী বস্তিবাসী গরিব মানুষকে উচ্ছেদ করছে। আমরা তো বলছি পুনর্বাসন দিক রেল।”

রাঙামাটি-সহ মেদিনীপুর শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবাধে খাস জমি দখল হয়েছে বলে অভিযোগ। জমি দখলে‌ কোটি টাকার কারবার হয়েছে। এমনকি, এখনও জমি দখল হচ্ছে বলে অনুযোগ। বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক শুভজিৎ রায়ের অভিযোগ, ‘‘শাসক দলের লোকেরাই মেদিনীপুরের রাঙামাটিতে সরকারি জমি দখলের কারবারে যুক্ত। প্রশাসন সব জেনে-দেখেও চুপ।’’ তৃণমূলের জেলা চেয়ারম্যান দীনেন রায়ের দাবি, ‘‘দল কোনও অন্যায় কাজকে প্রশ্রয় দেয় না। দেবেও না।’’ মেদিনীপুরে ‘রবীন্দ্র ভবন’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল। এখনও গড়ে ওঠেনি। আর হবে কি না, সংশয়। কারণ, প্রস্তাবিত জমির একাংশ দখল হয়ে গিয়েছে! একই অবস্থা ঝাড়গ্রাম শহরেও। রবীন্দ্র ভবনের আদলে ঝাড়গ্রামে ‘আদিবাসী ভবন’ তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু একলব্য সরণির ধারে সেই জমিও বেশিরভাগটাই দখল হয়ে বাড়ি ঘর তৈরি হয়ে গিয়েছে।

ঘাটাল শহরে রাস্তার ধারে পূর্ত দফতরের জমি থেকে সেচ দফতরের জমি কিংবা খাস জমি সবক্ষেত্রেই নজর জমি মাফিয়াদের। ঘাটাল শহরের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত কলেজ মোড় (পাঁশকুড়া বাসস্ট্যান্ড) লাগোয়া বহুমূল্য সরকারি জমি প্রশাসনের নাকের ডগায় দখল হয়ে যাচ্ছে। মোটা টাকার বিনিময়ে তা হাতবদলও হচ্ছে। সম্প্রতি আবার সম্প্রসারিত ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়কের দু’ধারে ফাঁকা জমিও বেদখল হয়ে গিয়েছে। সেই সব জমিতে রাতারাতি তৈরি হয়েছে বেআইনি নির্মাণও। সেখানে শাসক দলের একাংশ ওই জমি দখলে যুক্ত বলে অভিযোগও উঠেছে। অন্যদিকে ঘাটাল শহরের পুরনো এলআইসি অফিসের উল্টোদিকের পূর্ত দফতরের ফাঁকা জমিও দখল হয়ে গিয়েছে। ঘাটাল শহরে শিলাবতী নদী বাঁধের জমিতেও গড়ে উঠছে বেআইনি নির্মাণ। ঘাটাল শহর ছাড়াও সরকারি জমি বেদখলে পিছিয়ে নেই খড়ার, ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোনা ও রামজীবনপুর পুরশহরও। ঘাটালের মহকুমা শাসক সুমন বিশ্বাস বলেন, “মহকুমার সবক’টি পুরশহরে দখল হওয়া সরকারি জমি উদ্ধার করা হবে। পুরসভাগুলির তরফে মাইক-প্রচার চলছে।”

মুখ্যমন্ত্রী নিজে ভূমি দফতরে ‘ঘুঘুর বাসা’ নিয়ে সরব হয়েছেন। পদক্ষেপ শুরু করেছেন। এ বার কি তবে ভাঙবে ঘুঘুর বাসা! বৃথা আশা, মরিতে মরিতেও মরে না। (কিংশুক গুপ্ত, বরুণ দে, অভিজিৎ চক্রবর্তী, দেবমাল্য বাগচী ও রঞ্জন পাল)

আরও পড়ুন
Advertisement