CPIM Jhargram

‘লক্ষ্মী’র কাছে হার, কবুল প্রবীণ বাম নেতার

লোকসভা নির্বাচনে ধরাশায়ী হয়েছে বামেরা। একটি আসনও তারা পায়নি। বামের প্রধান শরিক সিপিএমের ভোট ব্যাঙ্ক নেমে গিয়েছে মাত্র ৫ শতাংশে।

Advertisement
কিংশুক গুপ্ত
 ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৪ ০৯:২৬
ডহরেশ্বর সেন।

ডহরেশ্বর সেন। নিজস্ব চিত্র।

এ-ও যেন এক লক্ষ্মীর পাঁচালি।

Advertisement

প্রবীণ সিপিএম নেতা ডহরেশ্বর সেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ভোট পরবর্তী অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন। সেখানে আরও বহু কারণের পাশাপাশি ভোটে বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে যা উঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্মীর সঙ্গে অসম লড়াই। তাঁর পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ হল— শাসক দলকে লক্ষ্মী তাঁর ভান্ডার উজাড় করে দিয়েছেন (লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের সুবিধা)। উল্টোদিকে লক্ষ্মী কোনওমতেই একদণ্ডও লাল পতাকার তলায় জিরোতে (বামদলের অর্থাভাব) আসছেন না।

লোকসভা নির্বাচনে ধরাশায়ী হয়েছে বামেরা। একটি আসনও তারা পায়নি। বামের প্রধান শরিক সিপিএমের ভোট ব্যাঙ্ক নেমে গিয়েছে মাত্র ৫ শতাংশে। এই বিপর্যয় মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে ৮৩ বছরের প্রবীণ সিপিএম নেতা ডহরেশ্বর সেনের। তাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই ভোটের ফলাফল ও দলের সাংগঠনিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে ঘুরে দাঁড়ানোর দাওয়াই বাতলেছেন তিনি। সূত্রের খবর, শনিবার সারা ভারত কৃষকসভার ঝাড়গ্রাম জেলা কমিটির বৈঠকে ডহরেশ্বরের চারপাতার রিপোর্ট নেতাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আলাদা করে সিপিএমের জেলা সম্পাদক প্রদীপ সরকারের কাছেও ওই বিশ্লেষণ রিপোর্ট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ডহরেশ্বর সেন এখন কৃষকসভার জেলা কমিটির সদস্য। এক সময় ছিলেন সিপিএমের অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য। থাকেন মেদিনীপুর শহরে। তবে আদতে তিনি ঝাড়গ্রামের ভূমিপুত্র। ৮৩ বছর বয়সেও একাই বাসে চেপে মেদিনীপুর থেকে ঝাড়গ্রামে এসে কৃষকসভার সাংগঠনিক বৈঠকে যোগ দেন তিনি। চার পাতার বিশ্লেষণ রিপোর্টে মূলত ঝাড়গ্রাম জেলার কৃষকসভার সাংগঠনিক দুর্বলতার দিক তুলে ধরেছেন তিনি।

লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প সম্পর্কে অবস্থানের প্রশ্নে বাম দলে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ একে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি হিসেবে দেখতে চান। কারও মত, জনপ্রিয় এই প্রকল্পকে জনকল্যাণমূলক মেনে নেওয়াই ভাল। একে অযথা আক্রমণে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। ডহরেশ্বর স্বীকার করে নিয়েছেন, এই প্রকল্পের মোকাবিলা করা যায়নি। ক্ষমতায় দীর্ঘদিন না থাকায় অর্থের ‌জোগান কমেছে বামদলগুলির। অথচ ভোটের লড়াইয়ে টাকা দরকার। তাই প্রবীণ নেতা তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন, তৃণমূল ও বিজেপি যে পরিমাণ টাকা খরচ করেছে তাতে বামেদের যে টুকুও বা প্রতিরোধ ছিল তা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। জাতপাতের আন্দোলনের ফলে আদিবাসী-মূলবাসীদের মধ্যে বামেদের প্রভাব তলানিতে ঠেকেছে। আদিবাসী অধিকার রক্ষা মঞ্চ, সামাজিক ন্যায় মঞ্চের মত এক সময়ের বাম গণ সংগঠনগুলির অস্তিত্বই এখন খুঁজে পাওয়া যায় না।

আদর্শ বনাম অর্থের লড়াই কি তবে ক্রমাগত একপেশে হয়ে যাচ্ছে? ডহরেশ্বর বলছেন, ‘‘আদর্শের মৃত্যু হয় না। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা দল ও সংগঠনে এসেছে। আসছেও। এক সময় নতুন সূর্য উঠবেই।’’ ডহর একটি সাঁওতালি শব্দ। অর্থ—পথ। ডহরেশ্বর কথার অর্থ ‘পথের ঈশ্বর’। পথের ঈশ্বর নতুন সূর্য ওঠার পথ চেয়ে বসে। তবে আপাতত তাঁর বিশ্লেষণ, সন্দেহের আবহ তৈরি করছে। এরিয়া কমিটিগুলির সদস্য হিসেবে নাম থাকলেও সেই সব নিষ্ক্রিয় সদস্যরা তৃণমূল অথবা বিজেপির হয়ে কাজ করছেন বলেও উল্লেখ করেছেন প্রবীণ নেতা।

ডহরেশ্বরের রিপোর্ট সম্পর্কে সিপিএমের মানিকপাড়া এরিয়া কমিটির সম্পাদক অর্জুন মাহাতো বলছেন, ‘‘ডহরদা প্রকৃত কমিউনিস্ট নেতা। প্রবীণ মানুষটির ওই বিশ্লেষণ দল ও শাখা সংগঠনগুলির ক্ষেত্রেও প্রয়োজ্য।’’ কৃষকসভার জেলা সম্পাদক দিবাকর হাঁসদা বলছেন, ‘‘ডহরদার পর্যালোচনা যথার্থ। কৃষকসভার জেলা ও ব্লক কমিটির সব সদস্যের কাছে তাঁর লিখিত পর্যালোচনাটি পাঠানো হচ্ছে।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদক প্রদীপ সরকার বলছেন, ‘‘ডহরদার লেখাটি প্রাসঙ্গিক। আরও ভাল করে পড়ে তবে মন্তব্য করব।’’

বিশ্লেষণ না হয় হল। কিন্তু প্রতিকার কী? কী কী করে গৃহস্থের বাড়ি ছেড়ে লক্ষ্মী ছেড়ে যাবে না তার উল্লেখ রয়েছে লক্ষ্মীর পাঁচালিতে। পথের ঈশ্বরও পথ বাতলেছেন। প্রথমত, এরিয়া কমিটি ভিত্তিক পর্যালোচনার কথা বলেছেন তিনি। অথচ কৃষক সভায় এরিয়া কমিটি নেই। এরিয়া কমিটি কেবল সিপিএমেই রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ‘যেমন খুশি চলো’র প্রবণতা থেকে দল ও শাখা সংগঠনকে মুক্ত করতে হবে। গণ সংগঠনের স্বাধীন কর্মসূচিকে সক্রিয় করতে হবে। ওই সব কর্মসূচির বিষয়ে দলকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষকসভার মতো দল ও শাখা সংগঠনেও চেক আপ সভা করার নিদান দিয়েছেন ডহরেশ্বর। মানুষের অভাব-অভিযোগ নিয়ে আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মানুষকে ছুঁতে হবে। দলীয় মুখপত্রকে অবশ্যপাঠ্য করার নিদান দিয়েছেন তিনি।

স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রিপোর্ট কি দলের গঠনতন্ত্রে রয়েছে? আগে কি এমন রিপোর্ট কেউ কখনও দিয়েছেন? স্থানীয় বাম নেতাদের কাছ থেকে এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। তবে নজির থাক বা না থাক, আশিতেও পথ খুঁজছেন যিনি তাঁর সেই জান কবুল চেষ্টার কাছে মাথা নত করছেন ধর্মকে আফিম মনে করা নেতাও।

আরও পড়ুন
Advertisement