West Bengal Panchayat Election 2023

ভান্ডারে জমছে চাকরির চাহিদা, নাগরিকত্বেরও

কাঁটাতারের বাইরে চাষের খেত আছে এ গ্রামের মানুষের। নির্দিষ্ট সময় মেনে, বিএসএফের অনুমতি নিয়ে, পরিচয়পত্র জমা দিয়ে চাষিরা যান চাষ করতে। ধান প্রধান ফসল। কোথাও কলা হয়।

Advertisement
সীমান্ত মৈত্র  
বাগদা শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২৩ ০৬:৫২
river.

এমনই অবস্থা ইছামতীর। —নিজস্ব চিত্র।

এ কেমন ইছামতী! স্রোত নেই। কচুরিপানা আর আগাছায় ভরা।

গ্রামের বটগাছের তলায় বড় চাতালে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েক জন বাসিন্দা। কেনারাম প্রামাণিক এই গ্রামে রয়েছেন বহু বছর। বছর চুয়াত্তর বয়স তাঁর। নদীর কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, “ছোটবেলায় নদীতে এত স্রোত ছিল যে, নামতে ভয় পেতাম। এখন দেখুন, কী তার অবস্থা!’’ তার পর জুড়ে দিলেন, ‘‘আমরা চাই, সরকার নদীটির সংস্কার করুক। জীবদ্দশায় আরও এক বার স্রোত দেখে যেতে চাই।”

Advertisement

গ্রামের নাম খয়রামারি। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাগদা ব্লকের সিন্দ্রাণী গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় থাকা গ্রামটি এ-দেশের একেবারে শেষ প্রান্তে। ওই যে সেতুটি রয়েছে ইছামতীর উপরে, তার নাম লোকমুখে ‘বিএসএফ সেতু’। কিছু দূরে বাংলাদেশ সীমান্ত। এখন সেখানে কাঁটাতার এবং বিএসএফের পাহারা।

বিভিন্ন সময়ে এই পথেই বহু মানুষ এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। দেশান্তরী হওয়ার স্রোতে ভেসে। কেউ এসেছেন দেশভাগের আগে-পরে। কেউ আবার ’৭১ সালের পরে। ৯০ শতাংশই নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের। গোটা গ্রামটি মতুয়া প্রধান। এখানকার মানুষ নিয়ম করে গাইঘাটার ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুবাড়িতে যাতায়াত করেন।

কাঁটাতারের বাইরে চাষের খেত আছে এ গ্রামের মানুষের। নির্দিষ্ট সময় মেনে, বিএসএফের অনুমতি নিয়ে, পরিচয়পত্র জমা দিয়ে চাষিরা যান চাষ করতে। ধান প্রধান ফসল। কোথাও কলা হয়। এক সময়ে খয়রামারি দিয়ে চোরাচালান চলত। সাইকেলে চাপিয়ে চাল পাচার হত। এখন সে সব বন্ধ।

হেলেঞ্চা-দত্তপুলিয়া রাজ্য সড়ক থেকে সিন্দ্রাণী বাজার এলাকায় বাঁ দিকের পিচের রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে এই খয়রামারি গ্রাম। পিচের রাস্তার পাশেই পড়বে প্রাথমিক স্কুলটি। তার সামনেই মিলবে গ্রামে যত্রতত্র যাওয়ার অটো-টোটো। একটু ভিতরে ঢুকলে দেখা যাবে কাঁচা বাড়ির সঙ্গে রয়েছে কিছু পাকা বাড়িও। কয়েকটি বাড়িতে রয়েছে মতুয়াদের আরাধ্য হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দির।

প্রাথমিক স্কুল সংলগ্ন রাস্তার ধারে চায়ের দোকানটি গোবিন্দ বিশ্বাসের। সেখানে ভরদুপুরে বাঁশের মাচায় বসে খোশগল্প করছিলেন দুই বৃদ্ধ। তাঁদেরই এক জন, তিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ অমলেন্দু সরকার। পাশে বসা দ্বিতীয় জনকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘‘উনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে জিনিসপত্র ফেরি করেন। ওঁর কাছ থেকে চারিদিকের পরিস্থিতি জানতে পারবেন।’’ অমলেন্দু নিজেও এই বয়সে মুম্বই গিয়েছিলেন রান্নার কাজ করতে। সম্প্রতি গ্রামে ফিরেছেন। এলাকায় সামান্য জমি আছে। জানালেন, পঞ্চায়েতে আবেদন করেও বার্ধক্য ভাতা পাননি। তাঁর স্ত্রী-ও পাননি লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা। অমলেন্দু বললেন, ‘‘ভগবান দু’টো হাত, দু’টো পা দিয়েছেন কাজ করে খেতে। আমি তাই করি। কেউ সাহায্য করবেন— এই আশা করি না।’’

গোবিন্দ থাকেন তাঁর বৃদ্ধা মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে। চা করতে করতে বললেন, ‘‘আমার মায়ের বয়স হলেও বার্ধক্য ভাতার টাকা পান না। স্ত্রী লক্ষ্মীর ভান্ডার পান না। চা বিক্রি করে কোনও রকমে চলে যাচ্ছে।’’

সবার অবস্থা অবশ্য এক নয়। কেনারাম যেমন বার্ধক্য ভাতা পান। বৌমা পান লক্ষ্মীর ভান্ডার। এই প্রকল্পের টাকা পান আর এক বাসিন্দা প্রশান্ত বিশ্বাসের স্ত্রীও। তবে প্রশান্ত কেনারামের সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, ‘‘আমার দুই ছেলে স্নাতক। বেঙ্গালুরুতে কাজ করে। স্ত্রী যে ৫০০ টাকা পান, তাতে এক কেজি খাসির মাংসও হয় না।’’ তার পরেই বললেন, ‘‘আমি চাই, ৫০০ টাকা না দিয়ে এখানে ছেলেদের কর্মসংস্থান হোক।’’

সুলেখা মণ্ডল, মৌমিতা বৈরাগীরা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। লক্ষ্মীর ভান্ডারে তাঁদের হাতে টাকা আসে। তাঁদের কথায়, “অভাবের সংসারে তা অনেক কাজে লাগে। প্রয়োজনমতো ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিই।’’ দুপুরে বাড়ির উঠোনে বাসন মাজছিলেন এক মহিলা। বললেন, “ওই টাকাটা পাই বলে স্বামীর কাছে হাত পাততে হয় না।’’

আরও একটা চাহিদা আছে গ্রামের মানুষের। নাগরিকত্ব। এক বৃদ্ধের কথায়, ‘‘বাংলাদেশ থেকে ধাক্কা খেয়ে এসেছি। এখানেও যদি নাগরিক হতে না পারি, তাড়িয়ে দেবে!’’

খয়রামারি গ্রামে দু’টো বুথে ১৭০৮ জন ভোটার। অধিকাংশই মতুয়া। গত পঞ্চায়েতে দু’টি আসনে বিজেপি জিতেছিল। বিজেপি প্রার্থী লতিকা মণ্ডল বলেন, “তৃণমূলের দুর্নীতির প্রভাব ভোট বাক্সে পড়বে।” তৃণমূলের বিদায়ী পঞ্চায়েত প্রধান সৌমেন ঘোষ বলেন, “মানুষ পঞ্চায়েতে উন্নয়নমূলক কাজ দেখে ভোট দেবেন। অন্য কোনও প্রভাবই পড়বে না।”

আরও পড়ুন
Advertisement