মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
দু’দিন আগে নীতি আয়োগের বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি গিয়ে ‘বাংলা ভাগ’ বিতর্কে বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দেগে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার বিধানসভাতেও বিজেপি নেতাদের বঙ্গভঙ্গ সংক্রান্ত দাবিদাওয়ার প্রতিবাদে সুর চড়ালেন তিনি। বিধানসভাকে এড়িয়ে রাজ্যভাগের কথা বলা যাবে না, এ কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, ‘‘আসুক বাংলা ভাগ করতে। দেখিয়ে দেব কী করে রুখতে হয়!’’ বিজেপির বিরুদ্ধে ‘বিভাজনের রাজনীতি’ করার অভিযোগ তুলতে গিয়ে মমতার অভিযোগ, গোটা বাংলা তো বটেই, বিজেপি যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছে, সেই উত্তরবঙ্গও বঞ্চিত হয়েছে কেন্দ্রীয় বাজেটে।
উত্তরবঙ্গের বালুরঘাট কেন্দ্র থেকে জিতে উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন সুকান্ত মজুমদার। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে উত্তরবঙ্গের কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রকল্পগুলির অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত। যা থেকেই বঙ্গভঙ্গ সংক্রান্ত বিতর্কের সূত্রপাত। সোমবার বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সুকান্তের বক্তব্য, ‘‘বাংলা ভাগের কোনও প্রশ্নই নেই!’’
শনিবার দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে নীতি আয়োগের বৈঠকে বলার সময় তাঁর মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ তুলেছিলেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠরোধ করে তাঁর অপমান করা হয়েছে, এই অভিযোগ তুলে সোমবার বিধানসভায় নিন্দাপ্রস্তাব আনে তৃণমূল। এই নিন্দাপ্রস্তাবের প্রতিবাদে অধিবেশন কক্ষ থেকে ওয়াকআউট করে বিজেপি। এর পরেই বিধানসভায় যান মুখ্যমন্ত্রী। নীতি আয়োগের বৈঠকে ‘মাইক বন্ধ করে দেওয়া’ নিয়ে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণ করার পরেই বঙ্গভঙ্গের প্রসঙ্গ তোলেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘ভোট চলে গেলেই ভাগাভাগি ইস্যুকে নিয়ে আসা হয়। এক জন বলছেন, মুর্শিদাবাদ-মালদহ ভেঙে দাও। কেউ বলছেন, অসমের তিনটি জেলাকে নিয়ে নতুন কিছু করো। কেউ আবার উত্তরবঙ্গকে উত্তর-পূর্বের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে বলছেন। চার মন্ত্রী বলেছেন উত্তরবঙ্গ ভাগের কথা। আমি ধিক্কার জানাই। আসুক বাংলা ভাগ করতে, কী করে রুখতে হয় দেখিয়ে দেব।’’
গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীকে সুকান্তের চিঠি দেওয়া থেকেই বাংলা ভাগ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। সুকান্তের প্রস্তাবে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্ত রায়। আবার কোচবিহার ভেঙে গ্রেটার কোচবিহার তৈরি করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবি জানিয়েছেন বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ নগেন্দ্র রায় তথা অনন্ত মহারাজ। এ নিয়ে শোরগোল পড়তেই বৃহস্পতিবার লোকসভায় পশ্চিমবঙ্গের বিভাজন চেয়ে সরব হন ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। নিশিকান্ত লোকসভার শূন্য প্রহরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মূলত জনবিন্যাসের ভারসাম্য এবং দেশের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে বিহারের কিষাণগঞ্জ, আরারিয়া ও কাটিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলার সওয়াল করেন। তাঁর অভিযোগ, ধারাবাহিক অনুপ্রবেশের ফলে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের ওই পাঁচ জেলার জনবিন্যাস পাল্টে গিয়েছে। ওই জেলাগুলিতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) চালু করার দাবিও তোলেন তিনি। তাঁর দাবিকে সমর্থন করেছেন মুর্শিদাবাদ জেলার দুই বিজেপি বিধায়ক। এক জন মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষ, অন্য জন বহরমপুরের বিধায়ক সুব্রত মৈত্র।
সংসদে দুবের মন্তব্য নিয়ে আলোড়নের আবহে দিল্লিতে গিয়েই জবাব দিয়েছিলেন মমতা। ‘বঙ্গভঙ্গ’ রোধের ডাক দিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, ভোট না পাওয়ায় বাংলায় ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি নিয়েছে বিজেপি। সোমবার বিধানসভায় মমতা বলেন, ‘‘ভোট মিটে গেলেই বিজেপি ভাগ করার কথা বলে। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আলোচনা হোক বিধানসভায়। ভোটাভুটি হোক। বিধানসভাকে এড়িয়ে বাংলা ভাগ করার কথা বলা যাবে না।’’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য আগেই জানিয়েছিলেন, উত্তরবঙ্গের বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ রাজ্য ভাগের যে ডাক দিয়েছেন, তা দলের অবস্থান নয়। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সুকান্তেরও বক্তব্য, বাংলা ভাগের কোনও প্রশ্নই উঠছে না! তাঁর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী অবান্তর কথা বলছেন। কেউ প্রস্তাব দিচ্ছেন মানেই তা কোনও সিদ্ধান্ত নয়।’’
বাজেটে বাংলার প্রতি বঞ্চনা নিয়ে বিধানসভায় সোমবার সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী উত্তরবঙ্গকেও বঞ্চনা করেছে বাজেটে। মুখ্যমন্ত্রী মমতার সরকারের বিরুদ্ধে বরাবর ‘উত্তরবঙ্গ-বঞ্চনা’র অভিযোগ তুলে এসেছে বিজেপি। এ বার বিজেপির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ থেকে এত আসন পেল ওরা, তবু বাজেটে কিছু দিল না! এখন আবার বিভাজনের রাজনীতি করছে। আমরা ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা উত্তরবঙ্গের পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ করেছি।’’ গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের আটটি আসনের মধ্যে ছ’টি আসনে জিতেছে বিজেপি। তৃণমূল শুধু জিতেছে কোচবিহার কেন্দ্রে। মালদহ দক্ষিণে কংগ্রেস।