TMC

দিল্লিতে সংসদীয় দলে ‘ভার্চুয়াল’ তোপ, কলকাতায় চপারের কোপ! গোষ্ঠীলড়াই আর বিবাদে জেরবার তৃণমূলের অন্দরমহল

রবি এবং সোমবার কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ উত্তাল হয়েছে তৃণমূল কাউন্সিলরদের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীসংঘর্ষের ঘটনায়। একদিকে ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুদর্শনা মুখোপাধ্যায়ের অনুগামীদের সঙ্গে গোষ্ঠীসংঘর্ষ হয়েছে বিরোধী গোষ্ঠীর। অন্যদিকে, ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের অনুগামীদের হাতে মার খেলেন শান্তনু সেনের অনুগামীরা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:২৮
Lots of Inner party clash happning in kolkata TMC

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

তৃণমূলের অন্দরমহলে পারস্পরিক বিরোধিতা এবং বিবাদ প্রায় সংক্রমণের মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দু’-তিন দিনে সংসদীয় দল থেকে কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলরদের সংঘর্ষের যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে দলীয় নেতৃত্বের চিন্তিত হওয়ার অবকাশ রয়েছে। যদিও দলের নেতাদের একাংশ বলছেন, তৃণমূলের মতো অবামপন্থী দলে এই ধরনের ঘটনা নতুন বা বিরল নয়। পিঠোপিঠি ঘটছে বলে অনেকে বিষয়টি বড় আকারে দেখছেন। দলনেত্রী সঠিক সময়ে শক্ত হাতে রাশ টানবেন। ইতিমধ্যেই তিনি দলের অভ্যন্তরে বিষয়গুলি নিয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছেন।

Advertisement

গত শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ধাপে ধাপে প্রকাশ্যে এসেছে দলের প্রবীণ সাংসদ তথা লোকসভার মুখ্যসচেতক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দলের একাধিক সাংসদের বিবাদের ঘটনা। লোকসভার সাংসদদের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে একে অপরের বিরুদ্ধে ভার্চুয়াল তোপ দাগা শুরু হয়েছিল আগেই। মঙ্গলবার কল্যাণ প্রকাশ্যেই সে সব বলতে শুরু করেছেন। অপর দিকে, রবি এবং সোমবার কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ উত্তাল হয়েছে তৃণমূলের পুর প্রতিনিধিদের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীসংঘর্ষের ঘটনায়। একদিকে দক্ষিণ কলকাতার ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুদর্শনা মুখোপাধ্যায়ের অনুগামীদের সঙ্গে গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়েছে বিরোধী গোষ্ঠীর। অন্যদিকে উত্তর কলকাতায় ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের অনুগামীদের হাতে মার খেয়েছেন অধুনা দল থেকে নিলম্বিত (সাসপেন্ডেড) শান্তনু সেনের অনুগামীরা।

রবিবার রাতে দক্ষিণের গড়িয়াহাট থানার অন্তর্গত ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁকুলিয়া রোডের বাসিন্দা তথা কেব্‌ল টিভি লাইনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রকি রাজবংশী চপারের কোপে গুরুতর জখম হন। অভিযোগের তির কাউন্সিলর সুদর্শনার ঘনিষ্ঠদের দিকে। ওই ওয়ার্ডে প্রায়শই বিধায়ক তথা মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের সঙ্গে সুদর্শনার দ্বন্দ্বের কথা শোনা যায়। রবিবার রাতের ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য গত বছর জগদ্ধাত্রী পুজো কেন্দ্র করে। গত বছর জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় কাউন্সিলরের অনুগামীদের সঙ্গে রকির বচসা হয়েছিল। বিসর্জনের দিনেও গোলমালের ঘটনা ঘটেছিল। ছ’মাস পেরিয়ে গেলেও রকির উপর রোষ যায়নি কাউন্সিলরের অনুগামীদের। তার ফলেই রবিবারের হামলা বলে রকির ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ। তাঁরা কাউন্সিলর সুদর্শনার পদত্যাগের দাবিতেও এখন সরব।

তার পরদিন, সোমবার কলকাতা পুরসভার অনুষ্ঠানে উপস্থিত স্বয়ং মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সামনেই নজিরবিহীন ভাবে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দুই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে অতীন এবং শান্তনু বলে স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউই এমন গোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।

উত্তর কলকাতার রাজনীতিতে অতীন-শান্তনু পরস্পরের বিরোধী অবস্থান তৃণমূলের অন্দরে সর্বজনবিদিত। তবে আপাতত দল থেকে সাসপেনশনের কারণে খানিকটা পিছিয়ে গিয়েছেন রাজ‍্যসভার প্রাক্তন সাংসদ শান্তনু । কিন্তু সম্প্রতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে ডাক পাওয়ায় আবার শান্তনু উত্তর কলকাতার রাজনীতিতে ‘সক্রিয়’ হয়েছেন বলেই খবর। ঘটনাচক্রে, সোমবার বিকেলে মেয়রের অনুষ্ঠানে প্রকাশ‍্যে মারামারি হয় যে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে, তার একটির নেতৃত্বে ছিলেন ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাকলি সেন। যিনি শান্তনুর স্ত্রী। অন‍্য গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর দেবিকা চক্রবর্তী। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণ সম্পর্কে ওয়াকিবহালেরা জানেন, কাকলির পাশে যেমন রয়েছেন তাঁর স্বামী শান্তনু, তেমনই দেবিকার পাশে রয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক অতীন।

সোমবার দমদমের সেভেন ট্যাঙ্কস সংলগ্ন এলাকায় ২ এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংযোগস্থলে পুর নিকাশি বিভাগের একটি কর্মসূচি ছিল। সেই মঞ্চের কাছেই ২ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি কাকলির তরফে আর একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। দীর্ঘ দিন পরে এলাকায় মেয়র আসছেন বলে তাঁকে সংবর্ধনা দিতেই কাকলি মঞ্চটি গড়েছিলেন। অভিযোগ, মেয়র ওই মঞ্চের সামনে আসতেই কাকলির অনুগামীদের সঙ্গে এলাকার বিধায়ক তথা ‘অতীন-ঘনিষ্ঠ’ ১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল নেতা আনোয়ার খানের অনুগামীদের ঝামেলা শুরু হয়। মঞ্চের সামনে পৌঁছোনোর আগেই দলীয় কর্মীদের হাতাহাতির ঘটনা দেখে হতচকিত হয়ে যান মেয়রও। পরে তিনি সেই বিস্ময় প্রকাশও করে ফেলেন। স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই মঞ্চে মেয়রের কাছে কারা আগে পৌঁছে ফুল দিয়ে সংবর্ধনা দেবেন, তা নিয়েই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের সূচনা। অভিযোগ, আনোয়ারের অনুগামীরা কাকলির অনুগামীদের প্রবল মারধর করেন। তিন জনের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। মঞ্চ কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। পরিস্থিতি সামলাতে পৌঁছোয় পুলিশও। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলে মেয়র, ডেপুটি মেয়র-সহ অন্য পুরপ্রতিনিধিরা পাশের সরকারি কর্মসূচির মঞ্চে উপস্থিত হন।

তবে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের এই বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্ব দিতে নারাজ স্থানীয় বিধায়ক অতীন। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল ঠিকই। মেয়রকে সংবর্ধনা দেওয়া নিয়ে সমস্যাও হয়েছিল। কিন্তু এখন আর কোনও সমস্যা নেই।” উল্লেখ্য, গত বছর ৮ অগস্ট আরজি কর হাসপাতালের মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ১৪ অগস্ট যে ‘মেয়েদের রাতদখল’ কর্মসূচি হয়েছিল, তাতে অংশ নেওয়ার কারণে দল থেকে সাসপেন্ড করা হয় প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ শান্তনুকে। এমনকি, তাঁর কাউন্সিলর স্ত্রী কাকলিকেও কলকাতা পুরসভার তৃণমূলের কাউন্সিলরদের হোয়াট্‌সঅ্যাপ গ্রুপ থেকে বার করে দেওয়া হয়। সোমবারের ঘটনা সম্পর্কে শান্তনু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি শুধু বলেন, “এটুকু বলতে পারি, যাঁরা মার খেয়েছেন, তাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে তৃণমূল করছেন। দলের খারাপ সময়ে, সিপিএম জমানার সময়েও তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। এখনও তাঁরা তাঁর প্রতি আস্থাশীল।’’

দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব আপাতত ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন। তবে এখনও পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কাউন্সিলর সুদর্শনা ওই ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে পরপর এমন ঘটনাপ্রবাহে শাসক তৃণমূলের স্বস্তিতে থাকার কথা নয় বলে একান্ত আলোচনার দলীয় নেতাদের একাংশ মেনে নিচ্ছেন।

Advertisement
আরও পড়ুন