মঙ্গলবার সল্টলেকে এসএসসি ভবনের বাইরে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। —নিজস্ব চিত্র।
তালিকা দেখার জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের দফতরে ডেকে পাঠানো হয়েছে আন্দোলনরত শিক্ষকদের কয়েক জনকে। সেই বিষয়ে চিন্ময় বলেন, “ওই তালিকায় কারচুপি হলে তালিকা প্রত্যাহার করিয়ে আসব।” অপর শিক্ষক প্রতিনিধি রাকেশ আলম বলেন, “তালিকা নিয়ে মনে হয় সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়েছে।”
অনির্দিষ্টকালের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেন আন্দোলনরত শিক্ষকেরা। অবস্থানস্থল থেকে আন্দোলনরত শিক্ষকদের অন্যতম প্রতিনিধি চিন্ময় মণ্ডল বলেন, “আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমাদের দেখতে হবে কার নাম ‘কন্টিনিউ’ করার জন্য পাঠিয়েছে। অযোগ্যদের বহিষ্কার করতেই হবে। ওরা স্কুলে গেলে আমরা যাব না। আর আমাদের পাঠাতে হবে। ওই তালিকা কারচুপি হলে, সেটি প্রত্যাহার করিয়ে আসব।”
আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবস্থানস্থল থেকে ঘোষণা করে সকলকে এসএসসি ভবনের গেটের কাছে আসার জন্য বলা হচ্ছে। আচার্য সদনের সামনে ব্যারিকেডের অন্য প্রান্তে রয়েছেন পুলিশকর্মীরা। তাঁদের উদ্দেশে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান উঠতে শুরু করেছে অবস্থানস্থল থেকে।
আন্দোলরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য খাবার এবং জলের ব্যবস্থা করেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। মঙ্গলবার দুপুরে মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। সেই খাবারের জন্য লম্বা লাইনও পড়েছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরাও মুড়ি এবং শুকনো খাবার এনে খাচ্ছেন।
খাবার দেওয়া হচ্ছে আন্দোলনরত শিক্ষকদের। —নিজস্ব চিত্র।
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সাংবাদিক বৈঠকে জানান, ১৭২০৬ জন যোগ্য। কিন্তু পাশ থেকে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি তখন কিছু বলার চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে আচার্য সদনে ‘ঘেরাও’ হয়ে থাকা এসএসসি চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার বলেন, “আমাদের আধিকারিকেরা ১৭,২০৬ জনের মধ্যে কারা অযোগ্য সেই তালিকা প্রস্তুত করবে। প্রস্তুত হলে সেটি স্কুল শিক্ষা দফতরের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।”
ব্রাত্য বসুর সাংবাদিক বৈঠকে তালিকা প্রকাশ না হওয়ার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ব্রাত্যের বার্তার পরে এক চাকরিহারা বলেন, “১৩ তারিখ বৈঠকে তিনি বলেছিলেন তালিকা দেবেন। এখন মনে হচ্ছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর কথায় আশা নিয়ে ২১ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। ভরসা তাঁদের উপর রাখা যায়, যাঁদের উপর ভরসা করে কারও সুফল পাওয়ার নিদর্শন রয়েছে। এখন হয় (তালিকা প্রকাশ) করতে হবে, না হয় আন্দোলন জারি থাকবে।”
অযোগ্যদের কেন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে না, সেই নিয়ে প্রশ্নে ব্রাত্য বলেন, “তালিকা তো সুপ্রিম কোর্ট দিয়ে দিয়েছে। আমাদের তো চিহ্নিত করার কিছু নেই। সুপ্রিম কোর্টই জানিয়েছে। সেটি প্রকাশ্যেই (পাবলিক ডোমেন)-এই রয়েছে।” সোমবার সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, তৃতীয় দফার কাউন্সেলিংয়ের পর বাকি দফার কাউন্সেলিংগুলি নিয়ে কোনও মন্তব্য করছে না কমিশন। যদিও শিক্ষামন্ত্রীর দাবি, এমন কিছুই তিনি জানেন না। ব্রাত্য বলেন, “এগুলির কথা আমরা বলিনি। এসএসসি চেয়ারম্যানও এটি বলেননি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেও এটি উল্লেখ নেই। যা লেখা নেই, তা কাল্পনিক ভাবে ধরে নিয়ে কেন ওঁরা কথা বলছেন, তা আমি জানি না।”
ব্রাত্য জানান, আইনি পরামর্শ না-পাওয়ার কারণেই তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী জানান, কাউকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়নি, কাজে যোগ দিতে কারও সমস্যা হয়নি, কারও বেতন বন্ধেরও নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
তালিকা প্রকাশ না হলে কারা বেতন পাবেন, কারা স্কুলে যাবেন তা নির্ধারণ হবে কী ভাবে? প্রশ্নের জবাবে ব্রাত্য বলেন, “আপনারা বলছেন আমরা যোগ্য-অযোগ্য নির্ধারণ করতে পারিনি। কিন্তু আপনারা যদি ১৭ তারিখের কেসটি দেখেন, যেখানে আমরা ক্ল্যারিফিকেশন চাই, সেখানে খুব পরিষ্কার করে ১৭,২০৬ জন— তাঁরা যোগ্য। এটি মধ্যশিক্ষা পর্ষদ হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে।” তখন পর্ষদ সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় পাশ থেকে বলেন, “যোগ্য নয়। মোট শিক্ষক যাঁদের চাকরি যাচ্ছে, তার মধ্যে পুরো ভাগটি দেওয়া আছে। সেখানে ১৭,২০৬ জনের উল্লেখ রয়েছে।”
শিক্ষকদের উদ্দেশে ব্রাত্যের বার্তা, “আমরা আইনি পরামর্শ নিয়ে প্রতিটি ধাপ এগোচ্ছি। আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন। আপনারা গিয়ে আপনাদের কাজ করুন।”
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “আমরা রিভিউ পিটিশন করছি। তাই এমন কোনও কিছু করা উচিত নয় যাতে আপনাদের রিভিউ পিটিশনকে দুর্বল করে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘিত হয় কিংবা আপনাদের বা আমাদের আদালত অবমাননা না হয়, তা আপনাদের বজায় রাখতে অনুরোধ করছি। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যোগ দিতে অনুরোধ করছি উপযুক্ত শিক্ষকদের। বেতনের বিষয়ে আমাদের দফতর কাজ করে যাচ্ছে। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি। আগামিকালও ডিভিশন বেঞ্চে এসএসসির মামলা রয়েছে। আপনাদের জন্যই এসএএসসি লড়ছে। একমাত্র সরকারই আপনাদের পাশে রয়েছে।”
ব্রাত্য বলেন, “আইনি প্রক্রিয়া এখনও চালু তথা লাগু আছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে আমরা দায়বদ্ধ। আমাদের এটিও মনে রাখতে হবে আমাদের সরকার, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সাম্প্রতিক আবেদনে ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত উপযুক্ত শিক্ষকদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছে।”
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী সম্পূর্ণ ভাবে চাকরিহারাদের পাশে রয়েছেন। বিদ্যালয় শিক্ষাদফতর সব সময় তাঁদের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টি বিচারাধীন রয়েছে। আমরা রিভিউ পিটিশন করছি।”
দুপুর দেড়টা নাগাদ বিকাশ ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করার কথা রয়েছে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর। এসএসসি সোমবার বেশি রাতের দিকে বিবৃতি দেওয়ার পর ব্রাত্য বলেছিলেন, “যাঁরা বঞ্চিত শিক্ষক, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো তাঁদের মাইনে পাওয়া নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তাই এই আন্দোলনেরও কোনও মানে নেই। আর যাঁরা ওখানে আছেন (এসএসসি দফতরের সামনে বিক্ষোভকারী চাকরিহারারা), তাঁদের অনেকেই হয়তো অযোগ্য। তাঁদের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট কোনও গাইডলাইন না দিলে তো আমরা কিছু বলতে পারি না। আমরা দ্রুত রিভিউ পিটিশনের জন্য যাচ্ছি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টই আমাদের গাইডলাইন দিয়ে দেবেন। আমরা যে ভাবে এগোচ্ছি, তাঁদের আস্থা রাখা উচিত। এ বার আস্থা রাখবেন কি রাখবেন না, সেটা তাঁদের ব্যাপার।’’
এসএসসি ভবনের সামনে আন্দোলনস্থলে এখনও পর্যন্ত কোনও বায়ো টয়লেটের ব্যবস্থা হয়নি। এই অবস্থায় স্থানীয় তিনটি বাড়ির একতলা খুলে দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনরত মহিলা যাতে সেখানে শৌচালয় ব্যবহার করতে পারেন, সেই কারণেই ওই সিদ্ধান্ত।
স্কুল সার্ভিস কমিশনের পাশে একটি পেট্রল পাম্প রয়েছে। আপাতত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেটি বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ, কমিশনের দফতরের সামনে আন্দোলন চলার কারণে পাম্পে গাড়ি প্রবেশ এবং বেরোনোর ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি জমায়েতের মধ্যে কেউ ধূমপান করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থেকে যায়। তাই অবস্থানস্থল থেকেই ঘোষণা করা হচ্ছে যাতে কেউ পেট্রল পাম্পের কাছাকাছি ধূমপান না করেন।
মঙ্গলবার বিধাননগরের ডিসি অনীশ কুমার আন্দোলনরত শিক্ষকদের উদ্দেশে অনুরোধ করেন যাতে এসএসসি ভবনের ভিতরে জল এবং খাবার নিয়ে ঢুকতে বাধা দেওয়া না হয়। এর কিছু ক্ষণ কিছু বিস্কুট, কলা, তরমুজ এবং জলের ব্যবস্থা করেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। তাঁদের দাবি, সেগুলি পুলিশ ও অন্য সরকারি কর্মীদের জন্য নিয়ে এসেছেন।
আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক সমিতি (জুটা)-ও। অধ্যাপক সংগঠনের তরফে এক সদস্য মঙ্গলবার এসএসসি দফতরের সামনে এসেছেন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় বলেন, “এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। যোগ্য-অযোগ্যদের গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে সরকার। আমরা চাই অবিলম্বে ওদের দাবি মেনে যোগ্য-অযোগ্য তালিকা ঘোষণা করুক।"
বিধাননগর পুলিশের ডিসি অনীশ সরকার মঙ্গলবার জানান, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে কোনও আপত্তি নেই পুলিশের। কিন্তু পুলিশকর্মীদের কর্তব্যপালনে যাতে বাধা না-দেওয়া হয়, সে বিষয়েও আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষকদের সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি। বিধাননগর পুলিশের ডিসি বলেন, “পুলিশ অফিসারেরা নিজেদের ডিউটি করছেন। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু পুলিশ যখন নিজের কাজ করতে গিয়েছে, (সোমবার) সন্ধ্যা থেকে তাঁদের ধাক্কাধাক্কি করা হয়েছে এবং আটকানো হয়েছে। ভিতর থেকে তাঁরা বেরোনোর সময় আটকানোর চেষ্টা হয়েছে। পুলিশকে ডিউটি করতে আটকানো হলে তা আইনসম্মত হবে না। এই ভাবে পুলিশকে ডিউটিতে বাধা দেওয়া উচিত হবে না।”
‘যোগ্য’দের তালিকা প্রকাশের দাবিতে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা। কিন্তু ‘যোগ্য’দের তালিকা এখনও প্রকাশ হয়নি। এই অবস্থায় নিজেদের দাবি থেকে কিছুটা সরলেন আন্দোলনকারী শিক্ষকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, কমিশন যদি ‘যোগ্য’দের তালিকা প্রকাশ করতে না পারে, তবে ‘অযোগ্য’দের অবিলম্বে চাকরি থেকে বহিষ্কার (টার্মিনেট) করা হোক।