Social Security Schemes

হতে চাইলেন ঘরের ‘লক্ষ্মী’, অজান্তে হয়ে গেলেন ‘বিধবা’, ভাতা চেয়ে সঙ্কটে গৃহবধূ, ‘যমে-পুলিশে’ টানাটানি!

তৃণমূল যতই দায় ঝেড়ে ফেলুক, দে পরিবার চেষ্টা করেও দায় ঝাড়তে পারছে না। শেফালি-পদ্মারা জানাচ্ছেন, প্রথমে শান্তিপুর থানায় তাঁদের ডেকে পাঠানো হয়েছিল। পরে বিডিও আটকে রেখেছেন নথিপত্র।

Advertisement
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায় ও প্রণয় ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৫৯
Lakshmir Bhandar turns into Widow Allowance, Woman faces arrest threat allegedly not knowing about forgery

(বাঁ দিকে) বৌমা শেফালি দে, শাশুড়ি পদ্মা দে (ডান দিকে) —নিজস্ব চিত্র।

ছিলেন সধবা। ‘ঘরের লক্ষ্মী’। চেয়েছিলেন ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’। কিন্তু সরকারি খাতায় হয়ে গিয়েছেন ‘বিধবা’। স্বামী জীবিত। কিন্তু ‘দালালের খপ্পরে’ পড়ে এখন যমে-পুলিশে টানাটানি! এক দিকে ‘বিধবা ভাতা’ প্রকল্পের নথি বলছে, শেফালি দে-র স্বামী পরেশ দে যমলোকে। অন্য দিকে, পুলিশ প্রায় গোটা পরিবারকে থানায় ডেকে দীর্ঘ ক্ষণ বসিয়ে রেখেছে জালিয়াতির অভিযোগে। উপরন্তু বিডিও আটকে দিয়েছেন আধার কার্ড এবং ব্যাঙ্কের নথি। সঙ্গে হুঁশিয়ারি, টাকা ফেরত না দিলে গ্রেফতার। বস্তুত, সোমবার থানায় সেই মর্মে এফআইআর-ও দায়ের করা হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

ঘটনাস্থল নদিয়ার শান্তিপুর। শান্তিপুর পুরসভার ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শেফালিরা। স্থানীয় সূত্রের খবর, এক সময়ে গোটা পরিবার ছিল তাঁতশ্রমিক। কিন্তু তাঁতের কাজে উপার্জন ক্রমশ কমে আসায় সে কাজ ছেড়ে দিয়েছে তাঁর পরিবার। গত বেশ কিছু বছর দিনমজুরিই জীবিকা। এমন সব পরিবারের কথা মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালু করেছিলেন ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’। শান্তিপুর আড়পাড়ার এই পরিবারও সেই সুবিধা পাওয়ার জন্য তদ্বির-তদারক শুরু করেছিল। শেষে শেফালির জন্য ভাতার ব্যবস্থা হয়েও যায়। মাসে মাসে হাজার টাকা করে ঢুকতে শুরু করে অ্যাকাউন্টে। কিন্তু সে টাকা যে ‘ঘরের লক্ষ্মীর’ জন্য নয়, সে যে ‘বিধবা’র জন্য, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি পরিবারের কেউ। অন্তত তাঁদের দাবি তেমনই।

শেফালির শাশুড়ি পদ্মা দে এখন দরজায় দরজায় ঘুরছেন পুত্রবধূর গ্রেফতারি আটকাতে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার ছেলে বেঁচে আছে। আমরা তার মা-বাবা। আমরাও এখনও বেঁচে। আমরা কি চাইব বিধবার টাকায় খেতে?’’ তা হলে এই বিভ্রাট হল কী ভাবে? পদ্মা বলছেন, ‘‘আমরা লক্ষ্মীর ভান্ডার চেয়েছিলাম। উত্তম বলেছিল, করে দেবে। কাগজপত্র সব ওকেই দিয়েছিলাম। ও যে লক্ষ্মীর ভান্ডারের বদলে বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করেছে, সে কথা তো আমরা বুঝতে পারিনি!’’

কে উত্তম? পদ্মার বয়ান অনুযায়ী, উত্তম দেবনাথ স্থানীয় তৃণমূল কর্মী। তিনিই নথিপত্র সরকারি দফতরে জমা দিয়ে ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। উত্তম নিজে সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে উত্তম জানিয়েছেন, আপাতত তিনি কর্মসূত্রে ওড়িশায়। শান্তিপুরে থাকাকালীন তৃণমূল করতেন, সে কথা অস্বীকার করছেন না। তবে জালিয়াতির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘দল করতাম। তাই সাধারণ মানুষের কাজ করে দিতাম। অনেকের অনেক নথিপত্রই সরকারি দফতরে জমা দিয়েছি। কিন্তু এখানে যে অভিযোগ উঠছে, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’’

স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব উত্তমের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ থাকার কথা অস্বীকার করছেন না। শান্তিপুর পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর উৎপল সাহার কথায়, ‘‘উত্তম আগে আমাদের দল করত। কিন্তু তার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠছিল। তাই দল থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই মুহূর্তে উত্তম আমাদের দলের কেউ নয়।’’

কিন্তু শেফালিরা আতান্তরে। শেফালি-পদ্মারা জানাচ্ছেন, প্রথমে শান্তিপুর থানায় তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দীর্ঘ ক্ষণ বসিয়েও রাখা হয়। পদ্মার কথায়, ‘‘তার পরে বড়বাবু বলেন, বাড়ি চলে যান। আমরা মিটিয়ে দেব। কিন্তু পুলিশ কোনও কিছু মেটায়নি।’’ পুত্রবধূকে নিয়ে শাশুড়ি এর পর দরজায় দরজায় কড়া নাড়া শুরু করেন। প্রথমে যান ব্যাঙ্কে। সেখান থেকে বলা হয় পুরসভায় যেতে। পুরসভা বলে পঞ্চায়েতে যেতে। পঞ্চায়েত অফিস থেকে বলে দেওয়া হয় বিডিওর কাছে যেতে। অবশেষে বিডিও ‘আটকে রেখেছেন’ আধার কার্ড এবং ব্যাঙ্ক নথি। টাকা ফেরত না দিলে বিপদ বাড়বে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সোমবার শান্তিপুর থানায় এফআইআর-ও দায়ের করে দিয়েছেন শান্তিপুরের বিডিও সন্দীপ ঘোষ।

বিডিও সন্দীপ অবশ্য আধার কার্ড এবং ব্যাঙ্ক নথি ‘আটকে রাখার’ কথা মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘বিধবা না হয়েও বিধবা ভাতা নিচ্ছেন জানতে পেরে ওঁদের ডেকে পাঠানো হয়েছিল। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আধার কার্ড-সহ কিছু নথি আমরা রেখেছি।’’ তবে শেফালিদের বিরুদ্ধে ‘অসহযোগিতার’ পাল্টা অভিযোগও তুলেছেন বিডিও। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ওঁদের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম, কার মাধ্যমে এটা করা হয়েছে? নাম বলতে বলেছিলাম। কিন্তু ওঁরা কারও নাম বলতে রাজি হননি। আমরা বলেছিলাম, টাকা ফেরত দিন। পরিবারটি বলছে, টাকাও ফেরত দিতে পারবে না। আমরা তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। যদি টাকা ফেরত না-পাওয়া যায়, তা হলে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করে আইন অনুযায়ী তদন্ত হবে। যাঁরা এই কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বলে তদন্তে দেখা যাবে, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ করা হবে।’’ সেই পদক্ষেপই করা শুরু হয়েছে এফআইআর দায়ের করে।

পদ্মাদের অবশ্য টাকা ফেরত দেওয়ার পরিস্থিতি নেই। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা গরিব মানুষ। মাসে মাসে হাজার টাকা করে পেয়েছি। সে টাকা তো মাসে মাসেই খেয়ে ফেলেছি। এখন টাকা কোথা থেকে ফেরত দেব?’’

স্থানীয় বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার এই বিতর্কে ওই পরিবারের পাশেই দাঁড়াচ্ছেন। রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে জগন্নাথের তোপ, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইরা (দলের কর্মীরা) গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এই কাণ্ড করছে। তারা সাধারণ মানুষকে ভাতা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের কাছ থেকে থোক টাকা নিয়ে নিচ্ছে। তার পর এক খাতের টাকা অন্য খাতে সরাচ্ছে। এক প্রকল্পের নাম করে অন্য প্রকল্পের টাকা দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ জানতেও পারছেন না যে তাঁরা সধবা ভাতা পাচ্ছেন না বিধবা ভাতা পাচ্ছেন, না লক্ষ্মীর ভান্ডার পাচ্ছেন।’’

Advertisement
আরও পড়ুন