শত অভিযোগ সত্ত্বেও এ হেন সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে যেন কিছুতেই পেরে উঠছেন না রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তারা। ফাইল ছবি।
রোদ-বৃষ্টিতে ট্র্যাফিক সামলান, দিনে-রাতে আসামি ধরেন, গোয়েন্দাগিরি করা তো বটেই, অনেকে আবার থানার দালালের মতো কাজ করেন বলেও অভিযোগ। কোনও অসহায় পরিবার থানা-পুলিশ করতে গেলে এঁদের দ্বারস্থ হতেই হয়। যথেষ্ট কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে তাঁরা ‘সাহেব’-এর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে কেস হালকা করে দিতে পারেন বা তুলে দিতে পারেন বলেও দাবি করেন। অভিযোগ, ট্র্যাফিক সিগন্যালে সুযোগ পেলেই নানা অছিলায় এঁরা টাকা তোলেন। উর্দি না থাক, অনেকেরই ভাবভঙ্গি রুপোলি পর্দার চুলবুল পান্ডে বা সিম্বার মতো বলেও অভিযোগ।
কিন্তু শত অভিযোগ সত্ত্বেও এ হেন সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে যেন কিছুতেই পেরে উঠছেন না রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তারা। দিনকয়েক আগেই সিভিক ভলান্টিয়ারদের বিষয়ে নির্দেশিকা তৈরি করতে রাজ্য পুলিশের আইজি-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি রাজাশেখরমান্থা। তার ভিত্তিতেই সিভিক ভলান্টিয়ারেরা কী কাজ করতে পারবেন, কী নয়, তা নিয়ে নতুন নির্দেশিকা জারি করতে হয় রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টরেটকে। এ বার সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে টাকা তোলার অভিযোগের তদন্ত সরাসরি সিআইডি-র হাতে তুলে দিল কলকাতা হাই কোর্ট। কল্যাণী পুরসভার এক তৃণমূল পুরপ্রতিনিধির দায়ের করা ওই মামলার প্রেক্ষিতে এই নির্দেশ দিয়ে শুক্রবার বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধেও যে হেতু জড়িত থাকার অভিযোগ আছে, তাই নিরপেক্ষ সংস্থা হিসাবে সিআইডি তদন্ত করবে। এর পরেই নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে, ‘অদম্য’ সিভিক ভলান্টিয়ারদের রোখা যাবে কোন পথে?
সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, নিয়োগ শুরুর সময় থেকেই সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। বাম জমানায় এ রাজ্যে সিভিক ভলান্টিয়ার ছিল না। তবে ২০০৮ সালে কলকাতায় যান নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরসভা ‘গ্রিন পুলিশ’ নামে একটি বাহিনী তৈরি করেছিল। যদিও সেই বাহিনী তৈরির মূল উদ্যোগ শুরু হয় ২০১২ সালে। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের ওয়েবসাইট বলছে, পুলিশে পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় ২০১৩ সালে রাজ্যে ৪০ হাজার পুলিশ এবং ১ লক্ষ ৩০ হাজার ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার’ নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। অনেকে অভিযোগ করেন, রাজ্য সরকার পুলিশবাহিনীতে যথাযথ কর্মী নিয়োগ না করে সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামোকে চালানোর চেষ্টা করছে। শুধু পুলিশই বা কেন, রাজ্যের বহু দফতরেই এই সিভিক-প্যারা-ক্যাজ়ুয়াল সংস্কৃতি রমরমিয়ে চলছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। মূলত শাসকদলের ‘দয়ার দানে’ নিয়োগ পাওয়ার একটা সমান্তরাল প্রক্রিয়াকে চতুরতার সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা। বিরোধীদের দাবি, বেকার যুবক-যুবতীরা এই সাত-আট হাজার টাকা মাইনের কাজের দিকে ছুটে যাচ্ছেন। এই কর্মীরা চিরদিনই সরকারের মুখাপেক্ষী আর সমর্থক হয়ে থাকবেন। এই যুক্তি দেখিয়েই বিরোধীরা রাজ্য সরকারের এই বাহিনীকে শাসকদলের ‘ইউনিফর্ম পরা ক্যাডার’ আখ্যা দেন। সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে পুলিশবাহিনীতেও আলোচনা শুরু হয়। মূল আপত্তি ছিল বাহিনীর নামে ‘পুলিশ’ শব্দটি নিয়ে। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাহিনীর নাম থেকে ‘পুলিশ’ শব্দটি ছেঁটে দেয় রাজ্য সরকার।
এখন রাজ্যে যে নিয়ম, তাতে ২০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে বয়স হলেই সিভিক ভলান্টিয়ার পদের জন্য আবেদন করা যায়। সর্বনিম্নশিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে অষ্টম শ্রেণি পাশ। তবে এই কাজ যাঁরা করবেন, তাঁরা কোনও ভাবেই নিজেদের ‘স্থায়ী সরকারি কর্মী’ হিসাবে দাবিকরতে পারবেন না। সিভিক ভলান্টিয়ার হতে গেলে দু’সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণও নিতে হয়। অনলাইন নয়, অফলাইনেই আবেদন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া হয়। এতেই অভিযোগ ওঠে, রাজনৈতিক নেতা-দাদাদের আশীর্বাদ থাকলেই সিভিক ভলান্টিয়ার হয়ে যাওয়া যায়। যে হেতু নেতার হাত মাথায় থাকে, তাই চাকরি যাওয়ার বিশেষ ভয় থাকে না বলে অভিযোগ। তার ফলেই তাঁদের এক্তিয়ার-বহির্ভূত একাধিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে বলে মনে করেন অনেকে।
তাই আনিস খান হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে শুরু করে মাদক মামলায় ফাঁসানোর নামে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মারার অভিযোগ ওঠে সিভিক ভলান্টিয়ারদের বিরুদ্ধে। পুলিশ না হয়েও পুলিশের মতো ক্ষমতা ভোগ করার মানসিকতা থেকে রাস্তায় চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে একাধিক। কলকাতার অনেকেই ভোলেননি রাজপথে ছিনতাইকারী সন্দেহে এক যুবকের বুকের উপরে পা তুলে এক সিভিক ভলান্টিয়ারের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য। এমন পরিস্থিতি কবে বদলাবে? রাজ্য পুলিশের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘সদ্য নয়া নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এর পরেও অভিযোগ আসে কি না, দেখা প্রয়োজন।’’