R G Kar Hospital Incident

‘বিচার আমরাও চাই, কিন্তু রোগীর চিকিৎসাও তো দরকার’

চাপা ‘ক্ষোভের’ বহিঃপ্রকাশ যে ঘটেনি, তা নয়। এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রবিবারই ভাঙচুর করা হয়েছে এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ারের অস্থি-শল্য বিভাগের ওয়ার্ড।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৪ ০৯:২৬
অসহায়: বাবার চিকিৎসার জন্য লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে এসেছিলেন সোমনাথ হালদার। কিন্তু তাঁদের দু’সপ্তাহ পর আসতে বলা হয়।

অসহায়: বাবার চিকিৎসার জন্য লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে এসেছিলেন সোমনাথ হালদার। কিন্তু তাঁদের দু’সপ্তাহ পর আসতে বলা হয়। সোমবার এসএসকেএমে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের কঠোরতম শাস্তি তাঁরাও চান। কিন্তু নিজের বাড়ির লোকের কার্যত বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালে পড়ে থাকাটা মানতে নারাজ রোগীদের পরিজনেরা। তাঁদের দাবি, ‘‘আন্দোলন চলুক। কিন্তু আন্দোলনের জন্য যদি আমাদের প্রিয়জনকে হারাতে হয়, তার দায় কে নেবে? আর কত দিন এ ভাবে খুঁড়িয়ে চলবে পরিষেবা?’’ এমনই চাপা ক্ষোভ ক্রমশ পুঞ্জীভূত হচ্ছে শহরের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর পরিজনদের মধ্যে। একই ক্ষোভের সুর শোনা যাচ্ছে দিনের পর দিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা করাতে এসে ফিরে যাওয়া রোগীদের মধ্যেও।

Advertisement

চাপা ‘ক্ষোভের’ বহিঃপ্রকাশ যে ঘটেনি, তা নয়। এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রবিবারই ভাঙচুর করা হয়েছে এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ারের অস্থি-শল্য বিভাগের ওয়ার্ড। সোমবারও ওই হাসপাতাল-সহ অন্যান্য জায়গায় দেখা গেল রোগীদের হয়রানির ছবি। যেখানে সকলের একটাই প্রশ্ন, ‘‘কবে স্বাভাবিক হবে চিকিৎসা পরিষেবা?’’

এ দিন ভর্তির তারিখ ছিল বসিরহাটের নয়নতারা মণ্ডলের। তাঁর গলব্লাডারে পাথর, দু’টি কিডনিই অচল। পেট ফুলে রয়েছে। ভোরে গাড়ি ভাড়া করে এসএসকেএমে এলেও বিকেলেই বাড়ি ফিরে যেতে হল তাঁকে। নয়নতারার স্বামী পঞ্চানন মণ্ডলের অভিযোগ, ‘‘ভর্তির জন্য বলতে যাওয়ায় আমাদের জানানো হল, ‘ডাক্তার নেই। রোগীকে কি বেডে স্রেফ শুইয়ে রাখবেন? ডাক্তারদের ধর্মঘট মিটে গেলে আসবেন।’’

পাশে দাঁড়ানো নয়নতারার মা নমিতা দাস শাড়িতে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘‘আর জি করের ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। কিন্তু তার জন্য রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন কেন? কর্মবিরতি মিটলে আসতে বলা হয়েছে। তত দিন হয়তো মেয়েটাকে আর বাঁচানো যাবে না!’’ যে ভাবে চিকিৎসা চলছে, তাতে প্রিয়জনের ‘মৃত্যুভয়’ তাড়া করছে অনেক রোগীর বাড়ির লোককেই।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সুপার স্পেশ্যালিটি ব্লকের সামনে হতাশ চোখে বসে ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা এক যুবক। পাশে কয়েক জন আত্মীয়। ওই যুবকের বাবার পেটে টিউমারের অস্ত্রোপচার হয়েছে। তার পর থেকে আইসিইউ-তে রয়েছেন। যুবকের কথায়, ‘‘মাঝেমধ্যে এক জন ডাক্তার আসছেন। কিন্তু তেমন ভাবে কোনও চিকিৎসা হচ্ছে না। বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব কিনা, জানি না!’’

ওই রোগীর নাম-পরচিয় জানতে চাইতেই যুবকের উত্তর, ‘‘মাফ করবেন, বলতে পারব না। যে সামান্য চিকিৎসা হচ্ছে, চিহ্নিত হয়ে গেলে সেটাও হয়তো আর হবে না।’’ একই ভয় তাড়া করছে অন্য রোগীর পরিজনদেরও। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিয়োলজি বিভাগে ভর্তি, বাঁকড়ার বাসিন্দা সুন্দর দাসের পরিজনের কথায়, ‘‘আমরা গরিব মানুষ। বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো ক্ষমতা নেই। তাই এখানে যেটুকু হচ্ছে, তা-ই হোক। এর পরে কপালে যা আছে, তা-ই হবে।’’

বাড়িতে পড়ে গিয়ে মাথায় রক্ত জমাট বেঁধেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের পাথরার বাসিন্দা, বৃদ্ধা জ্যোৎস্না চৌধুরীর। এ দিন ভোরে জ্যোৎস্নাকে তাঁর পরিবারের লোকেরা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসেন এসএসকেএমে। তাঁর ছেলে সুবিনয় চৌধুরী বলেন, ‘‘দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পরে জরুরি বিভাগে মাকে দেখানো সম্ভব হয়। তার পরে বলা হল, আউটডোরে দেখাতে হবে। কিন্তু দুপুর আড়াইটে নাগাদ আউটডোরে গিয়ে কোনও চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি।’’

লক্ষ্মীকান্তপুরের বাসিন্দা সুদেব হালদার পায়ের জটিল সমস্যা নিয়ে এ দিন এসএসকেএমের জরুরি বিভাগে এসেছিলেন। তাঁর ছেলে সোমনাথ হালদার জানান, ডাক্তারদের আন্দোলন মিটে গেলে সপ্তাহ দুয়েক পরে ফের এসএসকেএমে আসতে বলা হয়। একই রকম অবস্থা নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজেও। সেখানে নাক-কান-গলা (ইএনটি) বিভাগে ভর্তি এক যুবকের পরিজনদের কথায়, ‘‘চিকিৎসকেরাই তো আসছেন না। রোগীদেরই ঠিক মতো দেখছেন না। সেখানে আমরা আর কী
খবর পাব?’’

চোখে আঘাত নিয়ে ‘রিজিয়োনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি’ (আরআইও)-তে ভর্তি চার বছরের এক বালক। এ দিন হাসপাতাল চত্বরে বসে তার বাবা আলিমুদ্দিন শেখ বললেন, ‘‘শুক্রবার ছেলেকে ভর্তি করিয়েছি। তার পরে কেউ ছেলেটাকে দেখেননি। আজ এক জন ডাক্তার এসেছিলেন। কিন্তু ছেলেটার চোখটার কী অবস্থা, এখনও বুঝতে পারছি না।’’

অন্য দিকে, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ চত্বর কার্যত খাঁ খাঁ করছে। যে হাসপাতালে এক সময়ে রোগীর ভিড় লেগেই থাকত, সেখানে এখন রোগী নেই। জানা যাচ্ছে, ওই হাসপাতালে মোট শয্যা ২০০৩টি। এ দিন ভর্তি রয়েছেন মাত্র ১১২ জন। যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও ছুটি করিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন পরিজনেরা। বলছেন, ‘‘আন্দোলন, বিচার আমরাও চাই। কিন্তু রোগীদের চিকিৎসাটাও তো দরকার। সেটার দাবিও থাকছে আমাদের তরফে।’’

আরও পড়ুন
Advertisement