R G Kar Medical College Hospital Incident

ষড়যন্ত্র জেনে ফেলায় কি মৃত্যু

সরকারি ভাবে কিছু না বলা হলেও সমস্ত প্রশ্নের এক রকম উত্তর মিলেছে পুলিশ সূত্র থেকে। কিন্তু সেই উত্তর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে চিকিৎসক মহল। অভিযোগ করা হচ্ছে সত্য গোপন করে ‘বড় মাথা’কে আড়াল করার।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২৪ ০৭:৩৮
আর জি কর হাসপাতালের ঘটনায় ঘটনার জেরে হাওড়া হাসপাতালে ডাক্তারদের প্রতিবাদী মোমবাতি মিছিল। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

আর জি কর হাসপাতালের ঘটনায় ঘটনার জেরে হাওড়া হাসপাতালে ডাক্তারদের প্রতিবাদী মোমবাতি মিছিল। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

সময় মিলছে কি? ঘটনা-পরম্পরা মিলছে কি? বয়ান মিলছে কি?

Advertisement

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসককে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় প্রশ্ন অনেক। সরকারি ভাবে কিছু না বলা হলেও সেই সমস্ত প্রশ্নের এক রকম উত্তর মিলেছে পুলিশ সূত্র থেকে। কিন্তু সেই উত্তর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে চিকিৎসক মহল। অভিযোগ করা হচ্ছে সত্য গোপন করে ‘বড় মাথা’কে আড়াল করার।

কলকাতা পুলিশ সূত্রে দাবি করা হয়েছে, আর জি করের জরুরি বিল্ডিংয়ের চার তলায় যেখানে পালমোনারি মেডিসিন বিভাগ, সেখানে একটি মাত্র সিসি ক্যামেরা রয়েছে এবং সেটি তদন্তে সাহায্য করছে। ধৃত সঞ্জয় রায়কে তাতে রাত ১১টায় যেতে দেখা গিয়েছে সেমিনার হল-এর দিকে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই তার ফিরে আসারও ফুটেজ তাতে ধরা পড়েছে। ভোর ৪টে নাগাদ সঞ্জয়কে ফের সেমিনার হল-এর দিকে যেতে দেখা গিয়েছে। ৩৫ মিনিটের মধ্যেই তাকে ফিরে আসতেও দেখা গিয়েছে! পুলিশের দাবি, এই ৩৫ মিনিটের মধ্যেই সঞ্জয় সেমিনার হল-এ ঢুকে খুন এবং ধর্ষণ করেছে। জেরায় সে তা কবুলও করেছে বলে পুলিশের দাবি।

যদিও এ দিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখা গেল, লম্বা করিডরের শুধু একটা অংশই দেখা সম্ভব সিসি ক্যামেরায়। ওই অংশ থেকে ডান দিকে রাস্তা বেঁকে যাচ্ছে নার্সিং স্টেশনের দিকে। সেমিনার হল তারও ভিতরে। ওই নার্সিং স্টেশন পেরিয়েই ছোট লিফটের পাশ দিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে তবে সেমিনার হল-এ যাওয়া যায়। তার মানে সেমিনার হল তো দূর, তার আশপাশের ফুটেজও পুলিশের কাছে নেই। সেই জায়গায় আদতে কী হয়েছে, সে ব্যাপারে পুলিশ কী করে দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিল? এক আন্দোলনকারী চিকিৎসকের দাবি, ‘‘ওই সময় অন্য কেউ ঢুকেও তো তরুণীকে খুন করে থাকতে পারে। এমনও তো হতে পারে, তরুণীকে অন্য কোথাও খুন করে সেমিনার হল-এ এনে ফেলা হয়েছে!’’ ঘটনাস্থলে উপস্থিত আর এক চিকিৎসক বললেন, ‘‘এ-ও তো হতে পারে, তরুণী বসে খাচ্ছিলেন। সেই সময়ে কেউ সেমিনার হল-এ ঢুকে তাকে মেরে আধমরা করে দিয়েছে, তারপর ঢুকেছে সঞ্জয়?’’

এই ক্ষেত্রে সন্দেহ বাড়াচ্ছে সেমিনার হল-এর অবস্থা। এ দিন সেখানে পুলিশ প্রহরা রাখা ছিল। তবে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ঢুকে দেখা গিয়েছিল, সেমিনার হল-এর এক দিকে চেয়ার পাতা। সামনে সাদা বোর্ড। সেই সাদা বোর্ডের নীচে পোডিয়ামের উপর পড়ে তরুণীর অর্ধনগ্ন মৃতদেহ। পুলিশের দাবি, সেখানেই সে রাতে ঘুমিয়েছিলেন তরুণী। ওই পোডিয়ামের পাশেই ছিল ফাউলার বেড। তার উপর তোষক। তাতে ধোপদুরস্ত সাদা চাদর পাতা। তার পাশেই ছিল গদি লাগানো কাঠের বেঞ্চ। প্রশ্ন উঠছে, তরুণী ওই সমস্ত জায়গায় না শুয়ে পোডিয়ামের উপরে খালি মাথায় শুয়ে থাকতে গেলেন কেন? আর জি কর হাসপাতালের এক চিকিৎসকের দাবি, ‘‘এখানেই সন্দেহ হচ্ছে। সেমিনার হল ওই তলার এক মাত্র এমন জায়গা যেখানে গরমের সময় অনেকে বিশ্রাম করেন। সে রাতে কেউ সেখানে থাকলেন না, একা তরুণী থাকলেন, আর এক জন ঢুকে তাঁকে ধর্ষণ এবং খুন করে ফেলল, এত সহজ নাকি সবটা?’’

চিকিৎসকদের একাংশের সন্দেহ রয়েছে পুলিশের বলা সময় সারণি নিয়েও। পুলিশের দাবি, ময়না তদন্তে জানা গিয়েছে, খাবার খাওয়ার চার ঘণ্টার মধ্যে তরুণীর মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ এ-ও দাবি করেছে, রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ অনলাইনে আনানো খাবার নিয়ে সেমিনার হল-এ যান তরুণী। সেখানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন চার জন। এঁদের মধ্যে এক জন ইন্টার্ন, এক জন হাউস স্টাফ এবং দু’জন স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের চিকিৎসক পড়ুয়া (পিজিটি)। তাঁরা নাকি সেখানে খাওয়া সেরে রাত আড়াইটে নাগাদ বেরিয়ে যান। একা সেমিনার হল-এ থেকে যান তরুণী। খাবার খেতে খেতে তাঁরা সকলে টিভিতে অলিম্পিক্সে নীরজের জ্যাভলিন থ্রো দেখেন।

পুলিশ সূত্রে এ-ও দাবি করা হয়েছে, রাত দু’টো নাগাদ তরুণীকে এক নিকটাত্মীয় মেসেজ পাঠান। তরুণীর ফোন থেকে রাত আড়াইটে নাগাদ তার সংক্ষিপ্ত উত্তর দেওয়া হয়। রাত ৩টে নাগাদ এক চিকিৎসকপড়ুয়া তাঁকে এক রোগীর রিপোর্ট দেখাতে যান। তরুণী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অবস্থায় উত্তর দিয়ে নীচে অন্য এক জনকে রিপোর্ট দেখিয়ে নিতে বলেন। এর পর রাত ৪টে নাগাদ সঞ্জয়কে সেমিনার হল-এর দিকে যেতে দেখা যায়। সব মিলিয়ে পুলিশের অনুমান, জুনিয়র চিকিৎসকেরা বেরিয়ে যাওয়ার পর তরুণী যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখনই তাঁকে খুন এবং ধর্ষণ করা হয়।

তরুণীর এক বিশেষ বন্ধুর প্রশ্ন, ‘‘পরের দিন যে অবস্থায় ওর মৃতদেহ পড়ে ছিল, সেটা দেখে চমকে গিয়েছিলেন সকলে। ওই রকম একটা মৃতদেহ দেখে কারও মনে হতে পারে যে ঘুমাচ্ছেন? এক জুনিয়র নাকি এই ভেবেই সেখান থেকে ফিরে গিয়েছিলেন।’’ আর এক চিকিৎসকের প্রশ্ন, ‘‘পরের দিন সকালে যাঁর ডিউটি ছিল, তিনি হাসপাতালে গেলেন কখন? ওই অবস্থায় কেউ মরে পড়ে আছেন, জানতে বেলা সাড়ে ন’টা বেজে গেল? কোনও বৃহৎ ষড়যন্ত্র জেনে ফেলার জন্যই কি এই পরিণতি?’’

আরও পড়ুন
Advertisement