R G Kar Hospital Incident

‘বহু তুচ্ছ, ছোট্ট ঘটনার জ্বালা মিশে আন্দোলনে’

আনন্দবাজার পত্রিকার ডাকে শহরের বিশিষ্ট মুখেরা আলোচনাচক্রে বসেছিলেন। ছোট ছোট এলাকায় আন্দোলনের অখ্যাত নেত্রীদের নিয়ে মুগ্ধ সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার।

Advertisement
ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৩৫
আনন্দবাজার পত্রিকা আয়োজিত ‘শহর কী বলছে’ অনুষ্ঠানে (বাঁ দিক থেকে) মির আফসার আলি,

আনন্দবাজার পত্রিকা আয়োজিত ‘শহর কী বলছে’ অনুষ্ঠানে (বাঁ দিক থেকে) মির আফসার আলি, তিলোত্তমা মজুমদার, সুকন্যা সর্বাধিকারী, রিমঝিম সিংহ ও রত্নাবলী রায়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

কলকাতার একটি সাম্প্রতিক সন্ধ্যার গল্প শোনাচ্ছিলেন সঞ্চালক, অভিনেতা মির। মিছিলের জন্য যানজটে আটকে গাড়িতে বসে পাশের বাসচালককে লক্ষ করছিলেন তিনি। গলদঘর্ম দশাতেও কী অদ্ভুত, কোনও বিষোদ্গার নেই বাসচালকের চোখে-মুখে। এক বারও হর্ন না-বাজিয়ে উৎকর্ণ হয়ে বাসচালকটি মিছিলের কথাই শুনছেন।
মির বললেন, “এমন খাঁটি আইএসও ছাপ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ আন্দোলন কি আগে দেখেছি আমরা?” প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক সুকন্যা সর্বাধিকারীর চোখে আবার ভাসছে গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচের খুদেদের প্রতিবাদ। স্বাধীনতার
ঐতিহাসিক মধ্যরাতে শহরের যে নবীনা গবেষক প্রতিবাদের প্রথম স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন, সেই রিমঝিম সিংহ বললেন, ‘‘শুধু সমাজমাধ্যমের ডাকে বাংলার ৩০০টি জায়গায় এক রাতে জমায়েত হয় না। শ্রেণি বিভাজন থাকলেও এই আন্দোলন জ্ঞানত কারও কণ্ঠরোধ করেনি।” মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের কর্মী রত্নাবলী রায়ের কথায়, “অনেক ছোট্ট ঘটনা, তুচ্ছ ঘটনা, ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের ক্ষোভ মিশে এই বিস্ফোরণে।”

Advertisement

জনতা কি সত্যিই জাগল? এই প্রশ্নে আনন্দবাজার পত্রিকার ডাকে শহরের বিশিষ্ট মুখেরা আলোচনাচক্রে বসেছিলেন। ছোট ছোট এলাকায় আন্দোলনের অখ্যাত নেত্রীদের নিয়ে মুগ্ধ সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার। তবে তিনি প্রশ্নও করলেন, মেয়েরা বা প্রান্তিক লিঙ্গ, যৌনতার কেউই পুরোভাগে থাকবেন, সেটা এত দাগিয়ে দেওয়ার কী ছিল? রিমঝিমের মতে, “এক জন গৃহশ্রমিক বা সংখ্যালঘু ঘরের মেয়ের নিজের মুখে তাঁর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা শোনায় গুরুত্ব দিয়েছে এই আন্দোলন।” রত্নাবলীরও বিশ্বাস, একটি আতশকাচে সবাইকে দেখলে অনেকগুলি জীবন বিস্মরণেরও সমূহ আশঙ্কা। এই আন্দোলন তাতে সতর্ক ছিল।

একসঙ্গে অনেকগুলি ক্ষত, বৈষম্য এক সূত্রে গাঁথার চেষ্টা ছাড়াও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাও যেন মিশেছে এ প্রতিবাদে। সুকন্যা বললেন, “গরম, দূষণ, অসহিষ্ণুতায় আমরা কষ্ট পাই। কিন্তু এই ঘটনাটি ছেঁকা দিল।” তবে রিমঝিম বিরক্ত, “ইচ্ছে করে এটা রাজনৈতিক দলের সংঘাত বলে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।” প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তিনি হতাশ, “রাত দখল আন্দোলনের পরে মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর সরকার মেয়েদের রাতের ডিউটি বন্ধ করতে চাইলে বলতেই হয় রাত দখলের মানে ওঁরা বোঝেনইনি।” অপরাধের পরে মেয়েদের ঘাড়েই দায় চাপানোর প্রবণতাও সমানে বহমান। প্রভাবশালীদের মুখে মেয়েদের দোষারোপ বা ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ বন্ধ করতে আইন থাকার দাবিও উঠে এল।

সুকন্যা একটি অন্য দিকে আলো ফেললেন। “অনেক মেয়েই ভাবছেন, নাইট ডিউটির বিপদ বড় কথা নয়, অনেক কিছু জেনে ফেলেছিল বলেই মেয়েটাকে সরিয়ে দেওয়া হল। এটা তো ছেলেদের সঙ্গেও ঘটতে পারত।” আর জি করে ডাক্তার ছাত্রীর খুন ও ধর্ষণের প্রেক্ষিতে যাদবপুরে হস্টেলে র‌্যাগিংয়ের জেরে নবাগত ছাত্র-মৃত্যুর যন্ত্রণাও আলোচনায় উঠে এল। আর জি করের খুন বা দুর্নীতির যোগসূত্রে সুকন্যা বললেন, “মধ্যবিত্তের লোভ, নৈতিক অবক্ষয়েরও এ এক দলিল।” ‘জাস্টিসের’ দাবি তাই আসলে আমাদের নিজের কাছেই, বলছিলেন তিলোত্তমা। তাঁর কথায়, “পুলিশ দায়িত্ব পালন না-করায় সমালোচনা করছি। কিন্তু পুলিশও তো ভিন্‌ গ্রহের কেউ নয়।”

তবু রত্নাবলী আশাবাদী, “রাজনৈতিক দলগুলি চাইলেও এটা আত্মসাৎ করতে পারবে না। কী ভাবে আন্দোলন করতে হয়, শিখুক ওরা।” স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মিরের টিপ্পনী, প্রতিবাদের অর্জন, প্রতিবাদের গর্জন। ভয় ছাপিয়ে সাহসের জয়ই শেষ কথা বলে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement