Jamtara Gang

বদলাচ্ছে জালিয়াতদের অন্দরমহল, ধরপাকড় এড়াতে ভিন্‌রাজ্যে ডেরা বেঁধেছে জামতাড়া গ্যাং

এত দিনেও কেন বন্ধ করা গেল না এই চক্র? সাইবার অপরাধ দমন শাখার আধিকারিকদের দাবি, প্রথমত, প্রতারকেরা এই কাজকে পোক্ত পেশা হিসেবে এতটাই মেনে নিয়েছে যে পরবর্তী প্রজন্মকেও এই কাজ শেখাচ্ছে।

Advertisement
সুশান্ত বণিক
জামতাড়া শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৩ ০৮:০১
Jamtara Gang

প্রতারণা চক্র এখন আর শুধু জামতাড়া থেকে কার্যকলাপ চালাচ্ছে না। পুলিশের অভিযান এড়াতে তারা নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতীকী ছবি।

মাঠের মধ্যে ছোট-ছোট মাচা। সেখান থেকেই ব্যাঙ্ক আধিকারিক পরিচয়ে ফোন যেত সাধারণ মানুষের কাছে। মাচা থেকে ‘অপারেশন’ চালানোর কারণ, পুলিশ আসছে কি না, দূর থেকে নজরে পড়ে যায়। তল্লাশির সম্ভাবনা বুঝলে চম্পট দেওয়া সুবিধে। জামতাড়ার প্রত্যন্ত এলাকা দিয়ে যাওয়ার পথে নজরে পড়ে এমন মাচা।

থানায় প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়লেই ওই সব এলাকায় অভিযানে যেত পুলিশ। ধরাও পড়ে যেত কেউ-কেউ। তাতেই প্রতারণার ধরন পাল্টে গরিব মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে টাকা তোলা শুরু করে চক্রীরা। সাধারণ থানার পুলিশের পক্ষে এই চাতুরির রহস্যভেদ করা মুশকিল হয়ে ওঠে। অবশেষে ২০১৮ সালে জামতাড়ায় সাইবার অপরাধ দমন শাখা খোলা হয়। জামতাড়া পুলিশ জানায়, তার পর থেকে প্রায় ৭০০ জন প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে। শ’তিনেক মামলা রুজু হয়েছে। ’২২ সালের শেষ পর্যন্ত প্রতারণার প্রায় ৮২ লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। হাজার দেড়েক মোবাইল ও আড়াই হাজারের বেশি সিম কার্ড বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে দেড়শোর বেশি মোটরবাইক ও তিরিশটির মতো গাড়ি। যদিও যে পরিমাণ প্রতারণা হয়েছে, সে তুলনায় উদ্ধার হওয়া টাকা সিন্ধুতে বিন্দু, ধারণা পুলিশেরই একাংশের।

Advertisement

এত দিনেও কেন বন্ধ করা গেল না এই চক্র? সাইবার অপরাধ দমন শাখার আধিকারিকদের দাবি, প্রথমত, প্রতারকেরা এই কাজকে পোক্ত পেশা হিসেবে এতটাই মেনে নিয়েছে যে পরবর্তী প্রজন্মকেও এই কাজ শেখাচ্ছে। সম্প্রতি কর্মাটাঁড়ের তারাবহাল গ্রাম থেকে ‘কুখ্যাত’ সাইবার অপরাধী গফ্‌ফর আনসারিকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের দাবি, ধৃত জেরায় জানিয়েছে, নিজের ছেলেকেও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজে নামিয়েছে সে।

দ্বিতীয়ত, প্রতারণা চক্র এখন আর শুধু জামতাড়া থেকে কার্যকলাপ চালাচ্ছে না। পুলিশের অভিযান এড়াতে তারা নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। সীমানা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল, দুর্গাপুর, অন্ডাল, কুলটির বিভিন্ন অঞ্চলে গোপন ডেরা বেঁধেছে তারা। সেখান থেকে একই পদ্ধতিতে চলছে প্রতারণা। জামতাড়ার সাইবার অপরাধ দমন শাখার ডিএসপি মজরুল হোদা বলেন, ‘‘আমরা সে জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করছি।’’ আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার সুধীরকুমার নীলকান্তম জানান, পশ্চিম বর্ধমানের ৪২টি থানা ও ফাঁড়িতে সাইবার হেল্প ডেস্ক তৈরি করা হয়েছে। কুলটির শীতলপুরে ডেরা বেঁধে অপকর্ম চালানো জামতাড়ার বিশাল পাণ্ডেকে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয়েছে।

তদন্তকারীদের দাবি, এই প্রতারণা বন্ধে দু’টি উপায়ে তাঁরা বেশি জোর দিয়েছেন। প্রথমটি, আরও বেশি করে জনসচেতনতা গড়া। অ্যাকাউন্টের তথ্য বা কোনও ওটিপি ফোনে কাউকে না জানানো, মোবাইলে পাঠানো লিঙ্ক না খোলার মতো নানা বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে গ্রাহকদের। দ্বিতীয়টি, জামতাড়ার যুব সমাজকে শিক্ষিত করে, সুস্থ পথে আয়ের ব্যবস্থার মাধ্যমে এই অপরাধ থেকে মুখ ফেরানোর উদ্যোগ।

জামতাড়ার সাইবার অপরাধ দমন শাখা সূত্রে জানা যায়, এই জেলার ১১৮টি পঞ্চায়েতের প্রত্যেক এলাকায় একটি করে পাঠাগার তৈরি করা হয়েছে। বেকার যুবক-যুবতীদের চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সেখানে। এখন প্রায় ২৫ হাজার যুবক-যুবতী সেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকেরা, এলাকার শিক্ষক ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সদস্যেরা পালা করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

ডিএসপি মজরুল হোদার দাবি, ‘‘এই ব্যবস্থায় অনেক সুফল মিলছে। বেকার যুবকেরা সৎ পথে আয়ে উৎসাহিত হচ্ছেন। সাইবার অপরাধ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। অপরাধের সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে।’’ পুলিশ সূত্রের দাবি, এখনও পর্যন্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ’খানেক যুবক-যুবতী নানা ক্ষেত্রে চাকরিও পেয়েছেন।

পুলিশ ভরসা রাখছে তাদের পদ্ধতিতে। কিন্তু জাল যতটা ছড়িয়েছে, এত সহজে গোটানো যাবে কি না, প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
Advertisement