‘নয়া মুঙ্গেরে’ তৈরি হচ্ছে অস্ত্র। নতুন পথে সেগুলো আসছে বাংলায়। ছবি: সংগৃহীত।
হাত বদলে অন্য কোথাও যাচ্ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। তার আগেই শিয়ালদহে উদ্ধার হয়েছে ছ’টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং আট রাউন্ড কার্তুজ। সোমবার সকালে হাটেবাজারে এক্সপ্রেস শিয়ালদহ স্টেশনে থামতেই অভিযান চালিয়েছিল কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। গ্রেফতার করা হয় হাসান শেখ নামে মালদহের এক যুবককে। জানা যাচ্ছে, মালদহ থেকে তিনি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কলকাতায় আসছিলেন। তবে ‘চিরাচরিত ভাবে’ এ বার বিহারের মুঙ্গের থেকে ওই বেআইনি অস্ত্র আসেনি। অবৈধ অস্ত্র আমদানি হয়েছে বিহারের খগড়িয়া থেকে, যা সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রথম বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
মুঙ্গের থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে দক্ষিণবঙ্গের ‘চেনা রুট’ বদলে ফেলে কেন খগড়িয়া থেকে কালিয়াচক হয়ে শিয়ালদহের পথ বেছে নিল অস্ত্র কারবারিরা? বিস্তারিত জানতে ধৃতকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। তবে সোমবার সকালে শিয়ালদহে উদ্ধার হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রগুলি খগড়িয়ায় তৈরি হয়েছে বলে নিশ্চিত তদন্তকারীরা। সেই সূত্রেই জানা যাচ্ছে, পাচারের নতুন পথের সন্ধানও।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ, ইটাহার, করণদিঘি, ডালখোলা, চাকুলিয়া, গোয়ালপোখর, ইসলামপুর এবং চোপড়া থানার বিভিন্ন এলাকায় বাংলা ও বিহারের সীমানা। পুলিশ সূত্রের খবর, এত দিন জেলার ওই আটটি থানার তুলনামূলক নির্জন এলাকাকে বেছে নানা অপরাধমূলক কাজকর্ম করত ভিন্রাজ্যের দুষ্কৃতীরা। বিহার থেকে বাংলায় অস্ত্রপাচার হত ওই জেলা দিয়েই। আবার উত্তর দিনাজপুর হয়ে বিহার গিয়ে বেআইনি অস্ত্র কিনে বাংলায় ফিরে আসত এ রাজ্যের দুষ্কৃতীরা। তবে গত কয়েক বছরে ওই রুটে অভিযান চালিয়ে অস্ত্রপাচারের একাধিক পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে পুলিশ। জাতীয় সড়ক-সহ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় বিহার পুলিশের তরফেও নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। ফলে দুষ্কৃতীরা ওই সব ‘করিডর’ বাদ দিয়ে নতুন পথে খুঁজে বেআইনি অস্ত্র পৌঁছে দিচ্ছে গোটা বাংলায়।
অন্য দিকে, মুঙ্গের থেকে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র পাচার সংক্রান্ত নানা মামলা চলছে বিভিন্ন আদালতে। মুঙ্গেরের বাঘা বাঘা দুষ্কৃতীর অনেকেই বর্তমানে জেলবন্দি। তাই সেখানে বেআইনি অস্ত্র কারখানা চালানো এখন চ্যালেঞ্জের। অনেক অবৈধ কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন মুঙ্গের থেকে ওই ‘দক্ষ’ কারিগরদের নিয়ে গিয়ে খগড়িয়ায় গড়ে তোলা হচ্ছে ছোট ছোট অস্ত্র কারখানা। জঙ্গল, স্বল্প জনবসতিপূর্ণ এলাকা যা প্রশাসনিক নজরদারির খানিক বাইরে, সেখানেই গড়ে উঠছে ওই কারখানাগুলি। এ ভাবে খগড়িয়া হয়ে উঠছে ‘নতুন মুঙ্গের’। অস্ত্র তৈরির ওয়ার্কশপ থেকে ক্যারিয়ারদের হাত ঘুরে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছোনোর একটি রাস্তা সম্পর্কে খোঁজ পেয়েছে আনন্দবাজার ডট কম।
খগড়িয়ার বিশ্বনাথগঞ্জ রোড এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অন্তত ৩০টি বেআইনি অস্ত্র কারখানা। মুঙ্গেরের কারিগরদের সেখানে নিয়ে গিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। অত্যাধুনিক পিস্তল থেকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র তৈরিতে পটু ওই কারিগরেরা। তৈরি হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র বারুনি-পুর্ণিয়া হাইওয়ে ধরে সড়কপথে দু’টি পৃথক রাস্তা ধরে মালদহ এবং দিনাজপুরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। তার পর বুড়ি গণ্ডক নদী পার হয়ে মাধবপুর, সুলতানগঞ্জ ইত্যাদি জায়গা হয়ে কালিয়াচকে ঢুকছে অবৈধ অস্ত্র। আবার সুলতানগঞ্জ, বিন্দুপাড়া হয়ে ইসলামপুর মহকুমাতেও ঢুকছে অবৈধ অস্ত্র। পাশাপাশি, ডালখোলার পূর্ণিয়া মোড় ও বিহারের কিশনগঞ্জ এলাকার জাতীয় সড়ক, চাকুলিয়া, গোয়ালপোখর, করণদিঘি ও ইসলামপুরের রাজ্য সড়ক হয়ে বাস, ট্রেকার, অটো-সহ পণ্যবাহী গাড়িতে খগড়িয়ার অস্ত্র উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায় ছড়ানো হচ্ছে। সেখান থেকে অস্ত্রগুলি চাহিদামতো সরবরাহ হচ্ছে দক্ষিণবঙ্গেও। মালদহের বাসিন্দা বাদশাও সেই চাহিদার জোগান দিতে গিয়েছিলেন। ধৃত ব্যক্তি অস্ত্রগুলি কোথায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছিলেন, তার সঙ্গে এই পাচারচক্রে আরও কারা যুক্ত, তা জানার চেষ্টা চালাচ্ছেন তদন্তকারীরা।