গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
সরসঙ্ঘ চালকের বার্তা সামাজিক কর্মসূচির মোড়কে। কিন্তু সে বার্তা ‘ডি-কোড’ করলে এ কথা অস্পষ্ট নয় যে, বঙ্গবিজয়ই লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস)। পূর্ব ভারতের এক ‘পৌরাণিক’ ভৌগোলিক বিন্যাস ধরে এগোতে চাইছে বিজেপি। দক্ষিণবঙ্গ সঙ্ঘ পরিবারকে মোহন ভাগবৎ যা বলেছেন, তাতে স্পষ্ট সেই পৌরাণিক পূর্ব ভারতে পুরো যাত্রাপথ মসৃণ করে তোলার নির্দেশ। সঙ্ঘের কোনও মুখপাত্রই এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। কিন্তু সঙ্ঘের প্রান্ত কার্যকারিণীকে (প্রাদেশিক কর্মসমিতি) ভাগবৎ যে নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে তাঁর বেনজির দীর্ঘ বঙ্গসফরের মূল কারণ অনেকটাই স্পষ্ট।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কলকাতায় আসেন ভাগবৎ। ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরএসএসের দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তের নেতৃত্ব ও প্রচারকদের নিয়ে বৈঠকে ব্যস্ত ছিলেন। ১১ এবং ১২ তারিখ সঙ্ঘের সর্বোচ্চ কমিটির (অখিল ভারতীয় টোলি) বৈঠকও কলকাতায় বসেই করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে পৌঁছচ্ছেন বর্ধমান, সঙ্ঘের কাঠামোয় যা মধ্যবঙ্গ প্রাদেশিক কমিটির সদর। কিন্তু বর্ধমানে গিয়ে ভাগবতের বার্তা কী হতে পারে, তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে দক্ষিণবঙ্গের বৈঠকে দেওয়া নির্দেশের আভাস মেলার পর।
প্রত্যক্ষ ভাবে বা প্রকাশ্যে মূলস্রোতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে না আরএসএস। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ভাবধারার বাহক হিসেবে যে দল কাজ করে, সেই বিজেপির লক্ষ্য এখন নিজেদের ছাতার তলায় পৌরাণিক পূর্ব ভারতের একত্রীকরণ। পৌরাণিক পূর্ব ভারত বলতে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গকে বোঝানো হচ্ছে। অঙ্গ এবং কলিঙ্গ যদি জেতা যায়, তা হলে বঙ্গবিজয়ও সম্ভব— এই তত্ত্ব সামনে রেখে কর্মীদের মনোবল বাড়াতে চাইছে বিজেপি। তাদের সেই কাজ সহজ করতে আগামী এক বছর দক্ষিণবঙ্গে আরএসএসের ‘সক্রিয়তা’ দ্বিগুণ হবে বলে সঙ্ঘ সূত্রেই খবর।
বৈঠকে ভাগবতের বার্তা নিয়ে সঙ্ঘের তরফে প্রকাশ্যে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। ভাগবৎ-নির্দিষ্ট কৌশলের বিষয়েও মুখপাত্রদের মুখে কুলুপ। তবে সরসঙ্ঘচালক যে সক্রিয়তা ‘দ্বিগুণ’ করার কথা বলেছেন, তা দক্ষিণবঙ্গের পদাধিকারীরা মানছেন। সঙ্ঘের দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তের এক প্রথম সারির পদাধিকারীর কথায়, ‘‘এখন সঙ্ঘের শতবর্ষ চলছে। স্বয়ংসেবকদের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই উৎসাহ অনেক বেশি। সেই উৎসাহকে সরসঙ্ঘচালক পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে বলেছেন। দক্ষিণবঙ্ঘে আরএসএসের ব্যাপ্তিকে দ্বিগুণ করতে বলেছেন।’’
পৌরাণিক বিবরণ অনুযায়ী ‘অঙ্গ’ রাজ্যের অবস্থান ছিল বর্তমান বিহারের পূর্বাঞ্চল থেকে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক এলাকায়। কেউ কেউ বলেন অসমের দোরগোড়া পর্যন্ত সে রাজ্যের বিস্তার ছিল। পুরাণ শুধু নয়, ইতিহাসেও তেমনই উল্লেখ। ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতের উত্তর-পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ব ভাগ জুড়ে যে ষোড়শ মহাজনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়, অঙ্গ তার মধ্যে অন্যতম মহাজনপদ ছিল। সেখানেও অঙ্গের অবস্থান প্রায় একই জায়গায়। সেই ভৌগোলিক বিন্যাস অনুযায়ী পৌরাণিক অঙ্গ ইতিমধ্যেই বিজেপির হস্তগত। এনডিএ-র সরকার চলছে বিহারে। পশ্চিমবঙ্গে তাদের সরকার নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের যে অংশ পৌরাণিক অঙ্গের অংশ হিসেবে চিহ্নিত, সেই উত্তরাঞ্চলে লাগাতার দু’টি লোকসভা এবং একটি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পিছনে ফেলেছে তৃণমূলকে। অসমেও বিজেপির সরকার। পৌরাণিক ‘কলিঙ্গ’ হল বর্তমানের ওড়িশা। সে রাজ্যও সম্প্রতি বিজেপি দখল করেছে।
অর্থাৎ, পৌরাণিক পূর্ব ভারতের মধ্যে বিজেপির হাতের বাইরে রয়েছে একমাত্র ‘বঙ্গ’। পৌরাণিক বঙ্গ হল সেই অঞ্চল, যা মূলত এখনকার দক্ষিণবঙ্গের সিংহভাগ এবং বাংলাদেশের কিয়দংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এই অঞ্চলকে যে দল কব্জা করতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের মসনদ যে তার মুঠোতেই থাকে, তা একের পর এক নির্বাচনে প্রমাণিত। বিজেপি তাই অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের একত্রীকরণের স্লোগান তুলে এগোতে চাইছে। সেটি সম্ভব করা গেলে তবেই নবান্ন দখল করা সম্ভব। আরএসএস নিজেদের ‘শতবর্ষের উৎসাহ’ কাজে লাগিয়ে বিজেপির সেই পৌরাণিক যাত্রাপথকে সুগম করতে সচেষ্ট হচ্ছে।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ‘অব কি বার চারশো পার’ স্লোগান ধাক্কা খাওয়ার পর থেকেই আসরে নেমেছে আরএসএস। ৯০ আসনের হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনের আগে আরএসএস এবং তার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন ১৬ হাজার ছোট ছোট বৈঠকের মাধ্যমে প্রচার চালিয়েছে। মহারাষ্ট্রেও একই পন্থা নেওয়া হয়েছিল। ২৮৮ বিধানসভা কেন্দ্রে ৬০ হাজারের বেশি বৈঠক করেছিল সঙ্ঘ পরিবার। দিল্লিতে সেই কৌশল আরও নিবিড় ভাবে প্রয়োগ করা হয়। দিল্লির ৭০টি আসনে আরএসএস ৫০ হাজারেরও বেশি ছোট ছোট বৈঠক করেছে ভোটের আগে। ফলাফল ইতিমধ্যেই প্রকাশিত। ২৭ বছর পর রাজধানী শহরের গদি ফিরে পেয়েছে বিজেপি। আগামী একটা বছর পশ্চিমবঙ্গেও কি সেই পথেই এগোবে সঙ্ঘ? ভাগবতের বার্তা তেমনই বলে সঙ্ঘ সূত্রে জানা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে ভাগবৎ গোটা বাংলায় ‘নিবিড় প্রচার’ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। আরএসএসের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনকেও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রচারে নামতে বলে দেওয়া হয়েছে। মার্চ মাস থেকেই গোটা সঙ্ঘ পরিবার ময়দানে নামবে। মূল লক্ষ্য রাজ্যের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ভোট ভাগাভাগি আটকানো। কারণ, সংখ্যালঘু ভোট যে মূলত তৃণমূলের দিকেই যাবে, সে ‘বাস্তবতা’ সম্পর্কে ভাগবৎ নিজেও অবহিত।