গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
হাতে মেরেকেটে ন’মাস। উৎসব, ছুটিছাটা, দুর্যোগ বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য ওইটুকু সময়ই হাতে। তাই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার রায় বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি কালক্ষেপ না করে ময়দানে ঝাঁপিয়েছে। একাধিক নেতা পালা করে দাবি করছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার জেলে যাবেন। জেলে যাবেন তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যেরাও।
বিজেপির এই ‘কৌশল’ যে আগামী বছর বিধানসভা ভোটের দিকে লক্ষ্য রেখে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বস্তুত, এই হুঁশিয়ারি তথা দাবি থেকে এটা স্পষ্ট যে, বিধানসভা ভোটে আক্রমণের অভিমুখ ঠিক করে নিচ্ছে রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল। লক্ষ্য— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও সহজে বললে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, তেলঙ্গানা-সহ বিভিন্ন রাজ্যে ভোটের বছরখানেক আগে থেকে এ ভাবেই সুর চড়াতে শুরু করেছিল বিজেপি। সেখানেও সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী অথবা তাঁর পরিবারের কোনও সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছিল। দিল্লি এবং ঝাড়খণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীরা গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তেলঙ্গানায় মুখ্যমন্ত্রীর মেয়ে গ্রেফতার হন।
বৃহস্পতিবার সকালে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষিত হতেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে আক্রমণ করেন। যোগ্য এবং অযোগ্যদের আলাদা না-করতে পারার ‘দায়’ তিনি সরাসরি চাপিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রীর উপর। মমতা পাল্টা বলেন, ‘‘এতগুলো মানুষের চাকরি যাওয়ার পরে বিজেপির মন্ত্রী সুকান্তবাবু বলছেন, অযোগ্যদের জন্য যোগ্যদের চাকরি গিয়েছে। এর জন্য আমি নাকি দায়ী!’’ মুখ্যমন্ত্রী উল্টে প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনারা প্রথমে যখন মামলা করলেন, তখন একবার ভেবে দেখলেন না, কারা যোগ্য আর কারা অযোগ্য? সেটা তো সরকারকে ভাবতেও দিলেন না! আপনারা নিজেরা যোগ্য তো?’’
তাতে অবশ্য বিজেপি থেমে যায়নি। কলকাতায় শুভেন্দু অধিকারী এবং দিল্লিতে সুকান্ত একযোগে মুখ্যমন্ত্রী-সহ গোটা মন্ত্রিসভার দিকে আঙুল তোলা শুরু করেন। মুখ্যমন্ত্রী-সহ গোটা মন্ত্রিসভা জেলে যাবে বলে বিজেপি দাবি করতে শুরু করে। শুভেন্দু ২০২২ সালের মে মাসের রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকের ‘নথি’ দেখিয়ে বলেন, ‘‘এই ক্যাবিনেট বৈঠকেই স্থির হয়েছিল, প্রায় ছ’হাজার অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরি করা হবে। বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী নিজে সভাপতিত্ব করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তার মানে তিনি জানতেন যে, তাঁর ভাইপো আর পার্থ চট্টোপাধ্যায় মিলে টাকার বিনিময়ে অবৈধ ভাবে প্রায় ছ’হাজার চাকরি বিক্রি করেছেন।’’
দিল্লিতে সুকান্ত বার বার বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বেই পুরোটা ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী-সহ গোটা মন্ত্রিসভা জেলের ভিতরে থাকবে।’’ হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ওমপ্রকাশ চৌটালার বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগে এমনই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সুকান্ত সে কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘একই অভিযোগে এ বার আরও এক মুখ্যমন্ত্রী জেলে যাবেন। তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, তাতে একা পার্থ চট্টোপাধ্যায় দায়ী হতে পারেন না। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর পুরো ক্যাবিনেটের জেলে থাকা উচিত।’’
তৃণমূল অবশ্য ইতিমধ্যেই পাল্টা ভাষ্য তৈরি করতে শুরু করেছে। ধারাবাহিক ভাবে বলা শুরু হয়েছে যে, ২০১৬ সালে রাজ্য মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন শুভেন্দু নিজে। ফলে তখনকার ‘দুর্নীতির দায়’ তিনি এড়িয়ে যেতে পারেন না।
বৃহস্পতির পরে শুক্রবারও দিনভর বিজেপি মমতাকেই আক্রমণ করে গিয়েছে। সকালে সুকান্ত এবং সম্বিত পাত্র ফের মুখ্যমন্ত্রী চৌটালার জেলযাত্রার প্রসঙ্গ টানেন। আর শুভেন্দু বলেন, ‘‘এর আগে হরিয়ানা এবং ত্রিপুরাতেও শিক্ষক নিয়োগে এই রকম বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সুপ্রিম কোর্ট তাতে উপযুক্ত পদক্ষেপ করেছিল। এখানেও মুখ্যমন্ত্রীই এই কাণ্ডের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী।’’ ঘটনাচক্রে, আরএসএসের ছাতার তলায় থাকা ছাত্র সংগঠন এবিভিপিকেও শুক্রবার রাস্তায় নামানো হয়েছে। বেলা ১টায় আচমকা রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের সদর দফতর বিকাশ ভবনের (শিক্ষামন্ত্রীর দফতরও সেখানেই) সামনে হাজির হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে তারা। পুলিশ ১০ কর্মীকে গ্রেফতার করে। পরে ব্যক্তিগত বন্ডে থানা থেকেই তাঁদের জামিন হয়।
এই ঘটনাপরম্পরা থেকে স্পষ্ট, ভোটমুখী বঙ্গে এই ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ বিজেপি হাতছাড়া করতে চায় না। দুর্নীতি ঢাকতে ‘অনৈতিক’ ভাবে অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরি করার অভিযোগ সংক্রান্ত মামলাতেও সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিতে পারে। বিজেপি এখন থেকেই বলতে শুরু করেছে যে, ওই নির্দেশের পর দুর্নীতিতে মুখ্যমন্ত্রীর ‘ভূমিকা’ আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।