Sevoke Rangpo Railway Project

উত্তরকাশীর পরিণতি হতে পারে বাংলাতেও! সেবক থেকে রংপো পর্যন্ত রেল সুড়ঙ্গ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ

উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ে বাংলার সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত রেল প্রকল্প নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পরিবেশবিদদের প্রশ্ন, উন্নয়নের ‘জোয়ার’ বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে না তো?

Advertisement
পার্থপ্রতিম দাস
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ২২:০০
উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ে উত্তরবঙ্গের সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত রেল প্রকল্প নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ে উত্তরবঙ্গের সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত রেল প্রকল্প নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। —ফাইল চিত্র।

আশ্চর্য মিল দুই পাহাড়ি এলাকার মধ্যে। সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে, বোল্ডার ধসিয়ে তৈরি হয়েছে রাস্তা। যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে হোটেল-বাড়ি। সর্বোপরি, পাহাড়ি নদীর উপরে তৈরি হয়েছে একাধিক বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। গঢ়য়াল হিমালয়ের কোলে লালিত উত্তরাখণ্ড এবং সিকিম ও উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকা— এই দু’টি জায়গাই এই সব ‘দোষে দুষ্ট’। সেই উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ে উত্তরবঙ্গের সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত রেল প্রকল্প নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পরিবেশপ্রেমীদের প্রশ্ন, উন্নয়নের ‘জোয়ার’ শেষ পর্যন্ত বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে না তো?

Advertisement

গত ১২ নভেম্বর উত্তরকাশী জেলার ব্রহ্মতাল-যমুনোত্রী জাতীয় সড়কের উপর সিল্কিয়ারা এবং ডন্ডালহগাঁওের মধ্যে নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গের একাংশ ধসে পড়ে। সুড়ঙ্গটি সাড়ে আট মিটার উঁচু এবং প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ। ভাঙা সুড়ঙ্গের ভিতরেই আটকে পড়েন সেখানে কর্মকত ৪১ জন শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে তিন জন বাংলার শ্রমিকও রয়েছেন। দু’জন হুগলির এবং এক জন উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের বাসিন্দা। সেই ঘটনার ১১ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও উদ্ধার করা যায়নি সুড়ঙ্গের ভিতর আটকে পড়া শ্রমিকদের। এই পরিস্থিতিতে সিকিম পর্যন্ত এই রেল সুড়ঙ্গ নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন। চলতি বছরের শুরুতে উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠে এবং প্রায় একই সময় উত্তর কাশীতে ধসের ঘটনাও উদ্বেগ বাড়িয়েছিল পরিবেশবিদদের। তার পর থেকে রংপো রেল সুড়ঙ্গের একাধিক অসঙ্গতির কথা তুলে ধরতে থাকেন তাঁরা। সূত্রের খবর, সুড়ঙ্গের ভাল-খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা করতে কমিটিও তৈরি হয়েছিল উত্তরবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই কমিটির রিপোর্টেই একাধিক আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হলেও প্রশাসনের তরফে তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের।

ওই রেলপথ নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা অবশ্য এমন আশঙ্কাকে আমল দিতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্যে পরিবেশের থেকে প্রকল্পের স্থায়িত্ব গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। রেলের দাবি, কোনও প্রকল্প শুরুর আগে তার স্থায়িত্বের বিষয়ে সমীক্ষা করা হয়। করা হয় বাতাস, পরিবেশ এবং ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। তার পরেই এই প্রকল্প শুরু হয়েছে। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সব্যসাচী দে বলেন, ‘‘নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই রেলের কাজ করা হচ্ছে। উত্তর কাশীর মতো বিপর্যয় যাতে এখানে না ঘটে, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে তো আটকানো যায় না, কিন্তু তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তার মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের রয়েছে।’’

নানাবিধ বিতর্কের মধ্যেই ২০১৯ সালে ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সিকিম পর্যন্ত যাওয়ার প্রকল্প শুরু করে রেল। তার কাজ এখন প্রায় শেষ। এই পথের অনেকটা অংশেই রেললাইন যাবে সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে। সব মিলিয়ে ১৪টি সুড়ঙ্গ তৈরি হচ্ছে এই পথে। সেবক স্টেশন থেকে শুরু করে কালিম্পং জেলা হয়ে সুড়ঙ্গ শেষ হচ্ছে সিকিম ও কালিম্পঙের সীমান্ত রংপোতে। খরস্রোতা তিস্তা নদী এবং ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের পাহাড়ের ঢাল ধরে গিয়েছে এই রেললাইন। পথে সুড়ঙ্গের পাশাপাশি রয়েছে ২৮টি সেতুও। এই রেলপথ নির্মাণ পর্বে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত তিন বছরে কাজের সময়ে নানা কারণে ধস নেমে ছ’জন শ্রমিক মারা যান। আহত হয়েছেন অনেকে। যদিও নির্মাণ সংস্থার যুক্তি, ভারী বৃষ্টি এবং কিছু অসাবধানতার জন্য দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রকল্পের ক্ষতি হয়নি।

কিন্তু পরিবেশবিদদের মত, এই ধরনের প্রকল্পের জেরেই পাহাড়ি এলাকায় ধসের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, দার্জিলিং, কালিম্পং পাহাড় ভূকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে। উপরন্তু হিমালয় নবীন ভঙ্গিল পর্বত। নবীনতম হল পূর্ব হিমালয়। তাই এর গড়নও নরম। কিন্তু এখানে নির্বিচারে বহুতল এবং অন্যান্য নির্মাণকাজ চালানো হচ্ছে। সেখানে যে ভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, পাহাড় ফাটিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছে, যে ভাবে নির্বিচারে বহুতল এবং অন্যান্য নির্মাণকাজ চলছে, তাতে নেমে যাচ্ছে দার্জিলিঙের জলস্তর। ফলে ভূগর্ভে শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থায় ভূস্তরের উপরে চাপ বেশি পড়লে সেই এলাকা বসে যেতে পারে। হিমালয়ের এই এলাকা সিসমিক জ়োন ৪ বলে চিহ্নিত। যার অর্থ, এলাকাটি অত্যন্তই স্পর্শকাতর। ২০১১ সালে সিকিমের মঙ্গনে হওয়া ভূমিকম্প গোটা এলাকাকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ৬.৯। সেই ভূকম্পের পরে কয়েক দিন বাইরের লোক ঢুকতে পারেনি, এমনই অবস্থা হয়েছিল রাস্তাঘাটের। সেনাবাহিনীই প্রথম পৌঁছয়। তার পরেও ৫ রিখটারের উপরে ভূমিকম্প আরও একাধিক বার হয়েছে ওই এলাকায়।

পরিবেশ সংগঠন উত্তরবঙ্গ বন-জন শ্রমজীবী মঞ্চের মুখ্য উপদেষ্টা সৌমিত্র ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের কথা কে শোনে! আগে এই ধরনের প্রকল্প নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা হত। এখন আর এ সবের বালাই নেই। আমরা সুড়ঙ্গের কাজ শুরু হওয়ার সময় থেকেই এর বিরোধিতা করে এসেছি। যে পাহাড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি হচ্ছে, সেটা পুর্নবয়স্ক পাহাড় নয়। যৌবনকাল চলছে পাহাড়ের। কাজেই এখানে দুর্ঘটনা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।’’ সৌমিত্রের সংযোজন, ‘‘নির্মীয়মাণ সংস্থার কাছে কোনও হিসাব নেই। কোথা থেকে শ্রমিক আসছে, কত জন কাজ করছেন, সেই সব তথ্যও নেই। পরিবেশের কথা ছেড়ে দিলেও মানুষের জীবনের দাম কতটা তাদের কাছে? উত্তর কাশীর মতো পরিস্থিতি যে কোনও মুহূর্তে তৈরি হতে পারে। তাতে বহু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’’

একই কথা বলছেন পশ্চিমবঙ্গ ওয়াইল্ড লাইফ বোর্ডের সদস্য তথা পরিবেশবিদ অনিমেষ বোস। তিনি বলেন, ‘‘তিস্তা নদীর উপর জল বিদ্যুৎ প্রকল্প, পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি তো তৈরি হয়েই চলেছে। গোদের উপর বিষফোঁড়া এই রেল সুড়ঙ্গ। তিস্তার জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছিল যে, অত্যাধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। কয়েক দিন আগেই তো জলের তোড়ে সব উড়িয়ে নিয়ে গেল। কেউ আটকাতে পারল! প্রশাসন কিন্তু ক্ষতির হিসাব দেয়নি। সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময় একাধিক বার ধস নেমে শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটেছে। তারও কোনও হিসেব নেই। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে পরিবেশের কোনও তোয়াক্কা করা হয় না। মানুষের তো না-ই।’’

কিন্তু রেলের বক্তব্যে বারেবারেই প্রতিরক্ষার স্বার্থের কথা উঠে আসছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তি, রেল যোগাযোগ তৈরি হলে সিকিমের অনেক এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর হবে। বিশেষ করে চিনের সঙ্গে পাহাড়ি সীমান্তগুলিতে সহজে পৌঁছনো যাবে। কিন্তু সেবকের ওই এলাকা যদি ধসে যায়, তা হলে আশপাশের এলাকা রক্ষা পাবে কি, প্রশ্ন থাকছেই।

আরও পড়ুন
Advertisement