BJP-RSS

কেবলই ছবি! হিন্দুত্বে সকলেই, তবু ঘরানায় আলাদা, ঘরের দেওয়াল থেকে টেবিলের সজ্জা, পরিচয় বহন করে পৃষ্ঠভূমির

সম্প্রতি দেশের রাজধানী নয়াদিল্লিতে রাজ্যের বিরোধী দলের দু’টি বৈঠক হয়েছে। দু’টিই বিজেপি নেতার বাড়িতে। কিন্তু দুই ‘বৈঠকখানা’র দেওয়ালে ইঙ্গিত, বাড়ির বাসিন্দাদের রাজনৈতিক শিকড়ে প্রভেদ রয়েছে।

Advertisement
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ০৯:০০
All are in Hindutva, Backgrounds are different, Photographs on walls, Statues on Tables speak volumes about varying histories of BJP leaders

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

রাজনীতিকদের ঘরের দেওয়ালে কি তাঁদের রাজনীতির শিকড় দেখা যায়? একই ভাবধারা, তবু মাটির তলায় শিকড়ের চরিত্র আলাদা। এমন কি হতে পারে? পারে। যদি ছবি অসত্য না বলে।

Advertisement

সম্প্রতি এ রাজ্যের বিরোধী দলের দু’টি বৈঠক হয়েছে নয়াদিল্লিতে। দুই ‘বৈঠকখানা’র দেওয়ালে ইঙ্গিত, বাড়ির বাসিন্দাদের রাজনৈতিক শিকড়ে প্রভেদ রয়েছে। দেওয়ালে ঝোলানো ছবি বলছে অমিত শাহ আর সুকান্ত মজুমদারের ‘হিন্দুত্ব’ একই ঘরানার নয়।

দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারীর রাজনৈতিক ‘পটভূমি’ যে আলাদা, তা কারও অজানা নয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যাচ্ছে, পটভূমিতে পরস্পরের চেয়ে আলাদা লালকৃষ্ণ আডবাণী আর মুরলী মনোহর জোশী বা রাজনাথ সিংহ আর নিতিন গডকড়ী। সে ইতিবৃত্তও ধরে রাখা আছে তাঁদের দেওয়ালে ঝোলানো ছবিতে। বসার ঘরে সাজানো মূর্তিতে।

সুকান্তের নয়াদিল্লির বাংলোর যে ঘরটিতে বিজেপি সাংসদদের নিয়ে শুভেন্দু গত সোমবার বৈঠক করেছেন, সে ঘরে গৃহস্বামীর মাথার উপরে তিনটি ছবি। মাঝখানে ‘ভারতমাতা’। দু’পাশে নরেন্দ্র মোদী এবং জেপি নড্ডা। অন্য একটি দেওয়ালে আরএসএসের প্রথম দুই সরসঙ্ঘচালক হেডগেওয়ার (প্রতিষ্ঠাতা) এবং গোলওয়ালকর। ঠিক উল্টো দিকের দেওয়ালে অমিত শাহ। মোদী-শাহ-নড্ডার ছবি রাখা সুকান্তের ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা’ বলে অনেকে ব্যাখ্যা করতে পারেন। কিন্তু সঙ্ঘের প্রচারক, পদাধিকারী বা সাধারণ স্বয়ংসেবক— প্রায় প্রত্যেকের ঘরে ভারতমাতা, হেডগেওয়ার এবং গোলওয়ালকরের ছবি থাকেই। সঙ্ঘের যে কোনও কার্যালয়েও এই তিন ছবি থাকা বাধ্যতামূলক। সুকান্ত বালুরঘাটে সঙ্ঘের শাখায় সক্রিয় ছিলেন। সাধারণ স্বয়ংসেবক থেকে পদাধিকারী হন। পরে সঙ্ঘের ‘পছন্দের মুখ’ হিসেবে বালুরঘাট লোকসভায় বিজেপির টিকিট পান। অতএব সুকান্তের বসার ঘরের সবচেয়ে নজরকাড়া দেওয়ালে ওই তিনটি ছবি ওই ভাবেই থাকার কথা।

কিন্তু দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির অন্যতম শীর্ষনেতা অমিত শাহের বৈঠকখানার দেওয়ালে সেই ছবি নেই। হিন্দুত্বের ছাপ শাহের গায়ে সুকান্তের চেয়ে বেশি বই কম নয়। কিন্তু শাহের হিন্দুত্ব সঙ্ঘে সীমাবদ্ধ নয়। তাই সোমবার যে ঘরে শাহ শুভেন্দুর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, তার দেওয়ালে ঝুলছে বিনায়ক দামোদর সাভারকর এবং চাণক্যের ছবি। প্রথম জন ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদের প্রথম ধ্বজাধারী। দ্বিতীয় জন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কাছে পূজ্য। ঘরের কোনার টেবিলে গণেশমূর্তি। শাহের অন্য এক বৈঠকখানায় তেপায়ার উপর বজরংবলির মূর্তিও দেখা যায়। তাঁর ঘরে ছবি বা মূর্তির ওই নির্বাচনের মধ্যে আরএসএস ভাবধারার বিরোধিতা নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এটিও প্রণিধানযোগ্য যে, কোনও ‘কপিবুক’ সঙ্ঘীর ঘর এ ভাবে সাজানো থাকে না। তবে কিনা শাহ ‘কপিবুক’ সঙ্ঘী নন-ও বটে। গুজরাতের অহমদাবাদে ১৮ বছর বয়সে সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর নৈকট্য তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ‘প্রশিক্ষিত’ স্বয়ংসেবক হিসেবে গড়ে তোলার বদলে শাহকে ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-তে মনোযোগ দিতে বলা হয়েছিল। সে-ও খুব বেশি দিন নয়। কয়েক বছরের মধ্যেই সরাসরি বিজেপিতে শামিল হন তিনি। বরাবর ‘কট্টর হিন্দুত্বে’ই থেকেছেন। কিন্তু সঙ্ঘের ‘ঘরের ছেলে’ হিসেবে পরিচিতি পাননি। শাহি বৈঠকখানায় তারই ছায়া আছে বলে মনে করেন অনেকে।

নরেন্দ্র মোদী নিজে দীর্ঘ ‘প্রচারক’ জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বাসভবন বা কার্যালয়ের অন্দরমহল নাগালের এতটাই বাইরে যে, সে সব দেওয়ালের বিশদ ছবি তেমন প্রকাশ্যে আসে না। তবে কলকাতায় এমন এক প্রাক্তন ‘প্রচারক’কে পাওয়া যায়, যিনি মোদীর মতোই সঙ্ঘ থেকে বিজেপিতে এসেছেন। এবং তাঁর দরজা এখনও অবারিত। তিনি দিলীপ ঘোষ। সুকান্তের মতোই দিলীপের দেওয়ালেও ‘ডাক্তারজি’ (হেডগেওয়ার), ভারতমাতা এবং ‘গুরুজি’ (গোলওয়ালকর) সঙ্ঘীয় বিন্যাসে বিরাজমান। পাশাপাশি, তাঁর বসার ঘরে পদ্মফুলের ভাস্কর্য, স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের মূর্তির দেখা মিলবে। দেখা মিলবে দণ্ডায়মান ত্রিশূলেরও।

বিধানসভায় শুভেন্দুর দফতরের দেওয়ালেও ভারতমাতা রয়েছেন। কিন্তু সেই ছবির দু’পাশে হেডগেওয়ার আর গোলওয়ালকর নন। এক পাশে শ্যামাপ্রসাদ। অন্য পাশে দীনদয়াল উপাধ্যায়। সে সবের ডান পাশে কিছুটা নীচের দিকে অটলবিহারী বাজপেয়ীর আবক্ষ ছবি। শুভেন্দুর চেয়ারের পিছনের দেওয়ালে শ্যামাপ্রসাদ এবং মোদী। বার্তা স্পষ্ট— জাতীয়তাবাদ এবং বিজেপি। আর কিছু নয়।

সঙ্ঘের ‘প্রচারক’ হিসেবে কয়েক বছর কাজ করেছিলেন আডবাণীও। তবে বিজেপিতে তাঁর সুদীর্ঘ যাত্রাপথের তুলনায় সঙ্ঘে কাটানো সময়কাল নগণ্যই। অনেকটা পথ পেরিয়ে আসা আডবাণীর বসার ঘরে বংশীধারী রাখাল বালকের মূর্তি। তাঁরই সমসাময়িক মুরলী মনোহর জোশীর বসার ঘরে আবার কাচের বাক্সের মধ্যে রথের ভাস্কর্য। আডবাণীর সভাপতিত্ব কালে ‘রামরথযাত্রা’য় জোশীও ছিলেন শরিক। জোশীর নিজের জমানাতেও কন্যাকুমারী থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত ‘একতা যাত্রা’ হয়েছিল। ওই রথ সে সব ‘মাইলফলক’ কর্মসূচির প্রতীক বলেই অভিমত অনেকের।

নিতিনকে অনেকে ‘আরএসএসের ঘরের ছেলে’ বলে ডাকেন। কারণ, আরএসএসের সর্বভারতীয় সদর দফতরটি নাগপুরের যে মহল্লায় রয়েছে, সেই মহালেই নিতিনের বেড়ে ওঠা। নিতিন ‘প্রশিক্ষিত’ স্বয়ংসেবকও। তবে ‘প্রচারক’ কখনও হননি। সঙ্ঘের গুরুত্বপূর্ণ পদেও কখনও যাননি। স্বভাবে নিতিন শৌখিন। ব্যক্তিত্বে নিজস্বতা ধরে রাখেন। বিজেপিতে গুঞ্জন, মোদী মন্ত্রিসভায় একমাত্র নিতিনই নিজের ছন্দে কাজ করেন। নিতিনের বসার ঘরেও তাঁর সেই ‘নিজস্ব হিন্দুত্বে’র সম্মিলিত ছাপ। মহারাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতি ‘গণপতি বাপ্পা’র মূর্তি। বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি। স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি। হেডগেওয়ারের মূর্তি। ‘সঙ্ঘের ঘরের ছেলে’ হিসেবে পরিচিত হয়েও সঙ্ঘীয় আচরণবিধির হুবহু প্রতিলিপিকার তিনি নন।

রাজনাথের পছন্দ অবশ্য পুরোটা বোধগম্য হয় না কারও। উত্তরপ্রদেশের মির্জ়াপুরে একসময় সঙ্ঘের ‘শাখা কার্যবাহ’ ছিলেন। সঙ্ঘীয় পটভূমি থেকে রাজনীতিতে উঠে আসা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু রাজনাথের বসার ঘরে না সঙ্ঘীয় বিন্যাস, না উত্তরপ্রদেশের নিজস্বতা। চারপায়া কাচের টেবিলে গণেশমূর্তি সাজিয়ে রাখেন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

কেবলই ছবি। কিন্তু কেবল ছবিই নয়। রাজনীতির পৃষ্ঠভূমির পরিচয়।

Advertisement
আরও পড়ুন