Anubrata Mondal

জেল থেকে জেলায় ফিরবেন অনুব্রত, বীরভূমের সংগঠনে ‘বীর’ হয়ে থাকতে পারবেন কেষ্ট? দিদির ‘আস্থা’ থাকবে?

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত থেকে ২০২২ সালের পুরসভা— বীরভূমের সব নির্বাচনেই ‘ভোট করাতেন’ অনুব্রত মণ্ডল। এক একটি ভোট মানে ছিল এক একটি সংলাপের জন্ম। যে জন্ম দিতেন অনুব্রত স্বয়ং।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:০০
After being released on bail, will Anubrata Mondal remain as relevant in Birbhum politics as he was in the past

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সিবিআই থেকে ইডির হেফাজত, আসানসোল জেল থেকে তিহাড় (মাঝে কয়েক দিন দুবরাজপুর থানার লকআপ)— জেল থেকে জেলায় ফিরবেন অনুব্রত মণ্ডল। যিনি গ্রেফতার হওয়ার অব্যবহিত পরে বীরভূমের নেতাদের উদ্দেশে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘কেষ্ট যখন বেরোবে, তখন ওঁকে বীরের সম্মান দেবে।’’ সেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন চন্দ্রনাথ সিংহ, অভিজিৎ সিংহেরা। কিন্তু সে সবের মধ্যেও জোর কৌতূহল— জেলফেরত অনুব্রত কি বীরভূমের রাজনীতিতে আগের মতোই ‘প্রাসঙ্গিক’ থাকবেন? সেই মেজাজেই সংগঠন চালাবেন? দলে কি তাঁর সেই আধিপত্য ফিরে আসবে? ‘দিদি’ মমতা কি তাঁর উপর আগের মতোই ‘আস্থা’ দেখাবেন?

Advertisement

তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা থেকে জেলার অনেকে মমতার বক্তব্যকেই ‘সূচক’ হিসাবে দেখাতে চাইছেন। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অনুব্রতকে দল কোনও শাস্তি দেয়নি। তাঁর বদলে কাউকে জেলা সভাপতিও করেনি। সংগঠন পরিচালনা করেছে ‘কোর কমিটি’। ফলে পদ এবং চেয়ার যে অনুব্রত ফিরে পাবেন, তা নিয়ে অধিকাংশ নেতার কোনও সংশয় নেই। কলকাতার মেয়র তথা দলের তরফে বীরভূম জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘‘বীরভূমের বাঘ বীরভূমের বাঘই থাকবেন। বাঘ খাঁচায় থাকলে হায়না, শিয়ালেরা অনেক সময় চেঁচায়। কিন্তু বাঘ খাঁচা থেকে বেরোলে পালিয়েও যায়। তেমনই বিরোধীরা পালাবে।’’ অনুব্রতের জামিনের খবর ছড়াতেই তৃণমূলের লোকেরাও নিজেদের সমাজমাধ্যমে তাঁর বাঘের পিঠে চড়া ‘মিম’ পোস্ট করতে শুরু করেছেন।

প্রশ্ন সেখানেই। প্রশ্ন হল, অনুব্রত কি আগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবেন? আগের মতো ‘সক্রিয়’ হয়েই রাজনীতি করবেন?

জেলার রাজনীতিতে নানুরের তৃণমূল নেতা কাজল শেখ বরাবরই ‘কেষ্ট-বিরোধী’ হিসাবে খ্যাত। সেই কাজল বলছেন, ‘‘কেষ্টদা ফেরা মানে সংগঠন উপকৃত হবে। তাঁর মতো জেলার প্রতিটি ব্লক, অঞ্চল, অলিগলি আর কে চেনেন! মনে রাখবেন, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে।’’ কেষ্ট ফিরলে সংগঠনের না হয় উপকার হল, তাঁর কী হবে? তিনি কি অসুবিধায় পড়বেন? কাজলের জবাব, ‘‘কেন অসুবিধায় পড়ব? আমি কখনও কেষ্টদার অবাধ্য হইনি। তিনি যেমন দায়িত্ব দিয়েছেন, তেমন করেছি। তবে কাজল কখনও অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করেনি। করবেও না।’’ বীরভূমের সাংসদ শতাব্দী রায়ের সঙ্গে অনুব্রতের ‘বনিবনা’ নেই বলেই শোনা যেত। চার বারের সাংসদ শতাব্দী বলছেন, ‘‘কেষ্টদার সংগঠনে ফিরে কাজ করতে কোনও অসুবিধাই হবে না। কারণ, তাঁর পদ যায়নি। আর তিনি দীর্ঘ দিন ধরে সংগঠন করেছেন। জেলাটা চেনেন।’’

এ সবই কাজল বা শতাব্দীর ‘আনুষ্ঠানিক’ এবং ‘প্রকাশ্য’ মন্তব্য। রাজ্য বা জেলা তৃণমূলের অনেক নেতা একান্ত আলোচনায় অনুব্রতের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন সমীকরণের কথা বলছেন। শাসকদলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘এটা মাথায় রাখতে হবে যে, অনুব্রতকে জোড়া কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা গ্রেফতার করেছিল এবং তিনি বহু দিন জেল খেটে ফিরছেন। ফলে যতই তিনি ডাকাবুকো হোন না কেন, ফের আগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় একটা রয়েছে। নামলেও আগের মতো আগ্রাসী থাকবেন কি না সেটাও দেখার বিষয়।’’ বীরভূমের নলহাটির এক ‘কেষ্ট-ঘনিষ্ঠ’ নেতার কথায়, ‘‘আমি যে কেষ্টদার লোক, সেটা সকলে জানেন। দাদা জেলে থাকাকালীন আমি সে ভাবে সক্রিয় ছিলাম না। আবার দাদাকে ভাঙিয়ে যারা করে খেয়েছে, তাদের দেখেছি উল্টো দিকে ভিড়ে যেতে। কেষ্টদা ফিরলে সে সবেরও হিসাব করতে হবে।’’

অনুব্রত নিজে ততটা ‘আগ্রাসী’ রাজনীতি করবেন কি না, সেটা যেমন প্রশ্ন, তেমনই আলোচনা চলছে এ নিয়েও যে, তাঁকে ছাড়াই ভোটে সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল।

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত থেকে ২০২২ সালের পুরসভা— বীরভূমের সব নির্বাচনেই ‘ভোট করাতেন’ অনুব্রত। এক একটি ভোট মানে ছিল এক একটি সংলাপের জন্ম। কখনও ‘গুড়বাতাসা’, কখনও ‘চড়াম চড়াম’ আবার কখনও ‘ভয়ঙ্কর খেলা হবে’। তবে তৃণমূলের অনেক নেতাই মেনে নিচ্ছেন যে, কেষ্ট ছাড়া ভোট হবে না, সেই ‘মিথ’ ভেঙে গিয়েছে। কারণ, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত এবং ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বীরভূমে তৃণমূলের জয় পেতে অসুবিধা হয়নি। ওই দুই ভোটের সময়েই অনুব্রত জেলবন্দি ছিলেন। অবশ্য পাশাপাশিই অনেকের বক্তব্য, ব্লক এবং অঞ্চল স্তরে অনুব্রত যে ভাবে সংগঠন সাজিয়ে দিয়েছিলেন, তার উপর ভর করেই ভোটের বীরভূমে সাফল্য পেয়েছে তৃণমূল। ফলে তিনি সশরীরে জেলায় না থাকলেও তাঁর কোনও ভূমিকা ছিল না, সে কথা বলা যাবে না।

বীরভূম জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, অনুব্রতের জামিনের খবরে তাঁর অনুগামীদের শরীরী ভাষা যেমন বদলে গিয়েছে, তেমনই তাঁর ‘বিরোধী’ গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত নেতারা খানিকটা গুটিয়ে গিয়েছেন। অনুব্রতের সঙ্গে সারা ক্ষণ থাকতেন, এমন নেতাদের অনেকেই এখন সিবিআই এবং ইডির আতশকাচের নীচে রয়েছেন। ফলে তাঁরা খুব একটা খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছেন না। বিভিন্ন সমীকরণ থাকলেও তৃণমূলের প্রায় সকলেই মানছেন, অনুব্রত একেবারে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হবেন না। দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘মাথায় রাখতে হবে, অনুব্রত আর পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক নন। দলের নিচুতলায় কেষ্টদার একটা জনপ্রিয়তা রয়েছে। সেই জনপ্রিয়তা তৈরি করতে তাঁর কোনও আইটি সেল লাগেনি। আমাদের আর কোনও জেলা সভাপতি নেই, যাঁকে একডাকে গোটা বাংলা চেনে।’’

দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলে আলোচনা চলছে, তা হল মমতা কি অনুব্রতের উপর আগের মতোই ‘আস্থা’ রাখবেন। এ বিষয়ে দু’টি মতামতই রয়েছে। প্রথম অভিমত বলছে, মমতা কখনওই অনুব্রতের উপর ‘আস্থা’ হারাননি। তা হলে জেলে যাওয়ার পরেও তাঁকেই জেলা সভাপতির পদে রেখে দিতেন না। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘অনুব্রতকে জেলা সভাপতি রেখে দেওয়ার অর্থই হল যে, তাঁর উপর কোনও অনাস্থা দেখানো হচ্ছে না।’’ পক্ষান্তরে, দলের অন্য একাংশ মনে করছে, দলনেত্রী হিসেবে মমতা ‘দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব’ তৈরির দিকে মন দিতে পারেন। কারণ, অনুব্রত দু’টি তদন্তকারী এজেন্সির ‘নজরে’ থাকবেন। যদিও প্রকাশ্যে তিনি কোনও ভাবেই অনুব্রতের ক্ষমতাকে ‘খর্ব’ করবেন না। তৃতীয় অভিমত হল, মমতার আস্থা নির্ভর করবে স্বয়ং অনুব্রতের উপর। এত দিন জেলে বন্দি থাকার পরে বেরিয়ে এসে তিনি ‘স্বমহিমা’য় থাকবেন কি না, তার উপরেই মমতার ‘আস্থা’ বা ‘অনাস্থা’ নির্ভর করবে। পাশাপাশি, এ-ও দেখতে হবে যে, তাঁর অনুপস্থিতিতে ‘নেতা’ হয়ে ওঠা কাজল শেখের সঙ্গে অনুব্রতের দলীয় পর্যায়ে সমীকরণ কী হয়।

আরও পড়ুন
Advertisement