অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের এক সপ্তাহ কাটতে না কাটতে আলোড়িত তৃণমূল। সৌজন্যে: বুধবার দুপুরে তৃণমূলের সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্ট। দীর্ঘ পোস্টের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়, চিকিৎসার কারণে অভিষেক সংগঠন থেকে ‘ছোট বিরতি’ নিচ্ছেন। তার পর থেকেই আলোড়িত শাসক শিবিরের অন্দরমহল। অভিষেক নিজে ওই বিষয়ে টুইটের বাইরে কোনও মন্তব্য করেননি। প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাতে জল্পনা আরও বাড়ছে।
প্রসঙ্গত, চিকিৎসার জন্য এর আগে বিদেশে গিয়েছেন অভিষেক। তাঁকে নিয়মিতই চোখের চিকিৎসা করাতে হয়। বছর দেড়েক আগে আমেরিকায় অভিষেকের চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। তার আগেও তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন চোখের চিকিৎসার জন্য। কিন্তু কখনও প্রকাশ্যে ঘোষণা করে ‘ছুটি’ নেননি তৃণমূলের সেনাপতি। তাই অভিষেক যা লিখেছেন, তা নিয়ে এই অনিবার্য কৌতূহল তৈরি হয়েছে যে, আবার কি নিজেকে গুটিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অভিষেক? যেমন হয়েছিল গত বছর নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু কেন?
দলের একাংশের বক্তব্য, অভিষেক পরিবারের সঙ্গে কিছু দিনের ‘ছুটি’তে যাচ্ছেন। লোকসভা ভোটের কারণে গত কয়েক মাস তিনি পরিবারকে সময় দিতে পারেননি। পাশাপাশি, তাঁর চোখের চিকিৎসাও করানো প্রয়োজন। ফলে সংগঠনে সময় দিতে পারবেন না। এক নেতার কথায়, ‘‘এই ‘সাময়িক বিরতি’র কারণ রাজনৈতিক নয়। শারীরিক এবং পারিবারিক। এর মধ্যে জল্পনা বা ব্যাখ্যার কোনও অবকাশ নেই।’’
তৎসত্ত্বেও অভিষেকের ‘বিরতি’ নেওয়ার কারণ হিসেবে শাসকদলের মধ্যে বিবিধ ব্যাখ্যা এবং জল্পনা শোনা যাচ্ছে। কারও বক্তব্য, সরকারের কাজ এবং আমলাদের একাংশের ‘শ্লথতা’ নিয়ে অভিষেক বিরক্ত। কারও বক্তব্য, আসন্ন বিধানসভা উপনির্বাচনের জন্য প্রার্থীচয়ন যে ভাবে হচ্ছে, সেই ‘প্রক্রিয়া’ নিয়ে তাঁর আপত্তি রয়েছে। লোকসভা ভোটের ফলাফল পর্যালোচনার ‘প্রক্রিয়া’ যে ভাবে শুরু হয়েছে, তা নিয়েও অভিষেকের আপত্তি রয়েছে বলে দাবি শাসকদলের অনেক নেতার। পাশাপাশি, মালদহ দক্ষিণ আসনে ‘অভিষেকের বাছাই’ তৃণমূলের প্রার্থী তৃতীয় হওয়ায় দলের একাংশ তাঁর সমালোচনা করেছে বলে তৃণমূলের সেনাপতির কাছে ‘খবর’ পৌঁছেছে। তাতেও তিনি ‘ক্ষুব্ধ’ বলে অনেকের বক্তব্য।
প্রত্যাশিত ভাবেই আনুষ্ঠানিক কোনও সূত্র থেকে এই সমস্ত জল্পনা বা ব্যাখ্যার সমর্থন মেলেনি। উপরন্তু, অভিষেক লিখেছেন, ‘চিকিৎসার কারণে’ তিনি সংগঠন থেকে ‘সাময়িক বিরতি’ নিচ্ছেন। সেটিকেই ‘আনুষ্ঠানিক’ কারণ বলে ধরে নিলে যাবতীয় জল্পনার সেখানেই বিরতি। তবু অভিষেক বলেই জল্পনা জারি আছে।
জল্পনা ১: সরকারের কাজ
গত বছরের শেষে যখন অভিষেক নিজেকে শুধু ডায়মন্ড হারবারে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলেন, তখন কুণাল ঘোষ, ব্রাত্য বসুরা তাঁকে ‘সক্রিয়’ হওয়ার আর্জি জানাতে গিয়েছিলেন। সেই বৈঠকে অভিষেক সরকারের আমলাদের একাংশের কাজের গয়ংগচ্ছ মনোভাব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, লোকসভা ভোটের পরেও অভিষেকের সেই ধারণা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অভিষেকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত এক নেতার কথায়, ‘‘অভিষেক মনে করেন, বার বার সংগঠন দিয়ে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাকে পরাস্ত করা যাবে না। সরকারকে তার কাজ করতে হবে। এবং তা সময়ে করতে হবে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা যাতে তৈরিই হতে না পারে, সেটাই নিশ্চিত করতে হবে।’’ কিন্তু সে সবের কোনও ‘উল্লেখযোগ্য’ লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না বলেই দাবি ওই নেতার। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরের সচিবের উপরেও অভিষেক বিরক্ত বলে ওই নেতা জানাচ্ছেন।
অভিষেক তাঁর পোস্টে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, গত বছর ‘নবজোয়ার যাত্রা’র সময়ে তিনি অনুধাবন করেছিলেন, মূল্যবৃদ্ধি এবং ১০০ দিনের কাজের টাকা না পাওয়া গ্রামীণ জীবনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলেছে। পাশাপাশিই তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেই দাবি নিয়ে তিনি দিল্লিতে আন্দোলন পৌঁছে দিয়েছিলেন। রাজ্য সরকার গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৯ লক্ষ শ্রমিককে ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা দিয়েছে। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পে বর্ধিত অঙ্কও নিশ্চিত হয়েছে। অনেকের মতে, সরাসরি না বললেও অভিষেকের পোস্ট থেকে বোঝা গিয়েছে, এই দুই ক্ষেত্রেই তাঁর ‘ভূমিকা’ ছিল। যে প্রতিশ্রুতি পূরণ এখনও বাকি, তা যাতে সময়ে হয়, রাজ্য সরকার যাতে বিষয়টি নিশ্চিত করে, তা-ও উল্লেখ করেছেন অভিষেক। সেটি হল, আবাস যোজনার বাড়ি। এই প্রসঙ্গে অভিষেক কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা লেখেননি। বরং ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে লিখেছেন, কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতের কারণে মানুষ তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত। অভিষেকের পোস্টে এত বেশি সরকারের ভূমিকার প্রসঙ্গ থাকাই তৃণমূলের অন্দরে ‘গভীর’ আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
তবে দলের অন্য একটি অংশের বক্তব্য, অভিষেক সংগঠন নিয়ে থাকেন। তিনি মনে করেন যে, দলের কাছ থেকে প্রশাসন ‘প্রয়োজনীয় তথ্য’ নিতে পারে। কিন্তু সরকারই প্রশাসন চালাবে। অভিষেক প্রকাশ্যেই বলেন যে, তিনি প্রশাসনের ভিতরে ঢুকতে আগ্রহী নন। ফলে এ সব নিয়ে জল্পনা অমূলক।
জল্পনা ২: উপনির্বাচন প্রক্রিয়া
মঙ্গলবার রাতেই উত্তরবঙ্গের অভিষেক-ঘনিষ্ঠ এক নেতা ঘরোয়া আলোচনায় দলের অন্দরে বলেছিলেন, উপনির্বাচনে যে ভাবে প্রার্থী করা হচ্ছে, তা নিয়ে ‘আপত্তি’ রয়েছে সেনাপতির। অভিষেক দায়িত্ব নেওয়ার পর তৃণমূলের সংগঠনে মৌলিক বদল এসেছে। তাতে একটা কর্পোরেট বাঁধুনি রয়েছে। বদলের মোদ্দা কথা— সংগঠনের কাজ দেখবেন অভিষেক। লোকসভা ভোটের প্রার্থী ঘোষণা, প্রচারের নকশা তৈরি থেকে শুরু করে সর্বত্র সেই সংগঠনের ‘ছাপ’ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু উপনির্বাচনে সেই ‘ধারা’ মানা হচ্ছে না বলেই দলের অন্দরে জল্পনা তৈরি হয়েছে। নবান্নে বৈঠক ডেকে মানিকতলার প্রার্থী ঠিক করেছেন দলনেত্রী মমতা। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই ওই কেন্দ্রের প্রার্থীর নাম প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। এক নেতার কথায়, ‘‘সাদা চোখে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, উপনির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করার বিষয়টি অভিষেকের ধাঁচের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না।’’ বাকি তিন কেন্দ্রের (রায়গঞ্জ, বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ) প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াতেও অভিষেক যুক্ত থাকতে চান না বলেই সেই নেতার দাবি।
তবে দলের এক প্রথম সারির নেতার বক্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের সর্বোচ্চ নেত্রী। তাঁর নেতৃত্বেই দল লোকসভা ভোটে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করেছে। উপনির্বাচনে কোন কেন্দ্রে দলের কোন প্রার্থী লড়বেন, তা তো নেত্রীই ঠিক করবেন। অভিষেকও সেটা জানেন এবং মানেন। কাজেই এসব জল্পনা অর্থহীন।’’
আবার অন্য এক নেতার বক্তব্য, ‘‘অভিষেকের পোস্ট থেকে অনেকে অনেক কিছু আন্দাজ করতে চাইছেন। তাঁরা চোখে দেখা বিষয়কে নিয়ে দু’য়ে-দু’য়ে চার করতে চাইছেন। তবে এটা দু’য়ে-দু’য়ে বাইশ। সমস্যা একটা হয়েছে ঠিকই। তবে তা উপনির্বাচন নিয়ে নয়। সেটা নিতান্তই মামুলি বিষয়। এর চেয়েও বড় কারণ রয়েছে।’’
জল্পনা ৩: উত্তরবঙ্গ বিপর্যয়
যে ভাবে উত্তরবঙ্গে গিয়ে ফিরহাদ হাকিম (ববি) নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর্যালোচনা শুরু করে দিয়েছেন, তাতেও অভিষেক ‘অসন্তুষ্ট’ বলে খবর। উল্লেখ্য, শুভেন্দু অধিকারী দলে থাকতে থাকতেই তৃণমূলে জেলাওয়াড়ি পর্যবেক্ষক প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই ব্যবস্থা না থাকলেও উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ির বিষয়টি মোটামুটি দেখাশোনা করেন অরূপ বিশ্বাস। কিন্তু ফল পর্যালোচনা করতে গিয়েছেন ফিরহাদ। অরূপ নন। সেই সূত্রেই তৃণমূলের এক নেতার বক্তব্য, ‘‘নির্বাচনী ফল পর্যালোচনা একেবারেই দলীয় সাংগঠনিক বিষয়। কিন্তু অভিষেক বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। কে ববিদাকে শিলিগুড়িতে পাঠাল, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।’’ যদিও ববি-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, দলনেত্রীর নির্দেশ না থাকলে তিনি যেতেন না।
জল্পনা ৪: মালদহ-কাঁটা
সারা রাজ্যে একমাত্র মালদহ দক্ষিণ আসনে তৃণমূল তৃতীয় স্থানে চলে গিয়েছে। রাজ্যে একমাত্র ওই আসনটিতে জিতেছে কংগ্রেস। তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, দলের অন্দরে অভিষেকের নেতৃত্বে ‘আস্থা’ রাখেন না, এমন কয়েক জন নেতা নিজেদের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনায় মালদহ দক্ষিণের ফলাফল এবং প্রার্থী বাছাই নিয়ে সমালোচনা করেছেন। বলা হয়েছে, অক্সফোর্ড থেকে ‘উড়িয়ে’ এনেও প্রার্থীকে জেতানো যায়নি। মালদহ দক্ষিণে অক্সফোর্ডের গবেষক শাহনওয়াজ আলি রেহানকে প্রার্থী করেছিলেন অভিষেক নিজে। এক নেতার বক্তব্য, ওই ‘কথোপকথন’ অভিষেকের কাছে পৌঁছেছে। তাতে তিনি বিরক্ত। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা জানাচ্ছেন, গোটা নির্বাচনী সংগঠনের দায়িত্ব ছিল অভিষেকের উপর। তৃণমূল যেমন ২৯টি কেন্দ্রে জিতেছে, তেমনই ১৩টি কেন্দ্রে জিততেও পারেনি। প্রতিটি কেন্দ্র নিয়েই পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। দলের গরিষ্ঠ অংশের মতামত নেওয়া হবে সেখানে। ছুটকো আলোচনায় কে কী বললেন, তা নিয়ে অভিষেক ভাবিত নন।
জল্পনা ৫: ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠক এবং তার পর
দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন অভিষেক। তার পরে সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবের বাড়িতে গিয়ে তিনি বৈঠক করেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন আপ-এর নেতা রাঘব চড্ডা। দিল্লি থেকে মুম্বই গিয়ে উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গেও বৈঠক করেন তৃণমূলের সেনাপতি। যাকে জাতীয় রাজনীতিতে অনেকে কংগ্রেসকে এড়িয়ে ‘সমান্তরাল পদক্ষেপ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তৃণমূলের এক নেতার দাবি, অভিষেকের সেই ভূমিকা নিয়ে দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। তবে দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘দলের নেত্রীই অভিষেককে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর অভিষেক তো সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। নেত্রীর নির্দেশেই তিনি জাতীয় স্তরের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তা নিয়ে দলের নেতৃত্বের প্রশ্ন থাকবে কেন?’’
অভিষেকের বিরতি নেওয়ার কারণ নিয়ে আরও বিবিধ আলোচনা রয়েছে। যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। তবে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, সেনাপতির পোস্টটি খুব ‘সরল’ বা ‘স্বাভাবিক’ নয়। বস্তুত, তাঁরা এখন আগামীর অপেক্ষায়।