অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে থানায় দাখিল করা অভিযোগপত্র। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করার কর্মসূচি ‘প্ররোচনামূলক’, এমনটা দাবি করে থানায় অভিযোগ দায়ের করল বিজেপি। শনিবার রবীন্দ্র সরোবর থানায় ইমেলের মাধ্যমে এফআইআর দায়ের করেন বিজেপি নেতা রাজর্ষি লাহিড়ি। এই কর্মসূচিকে বিপজ্জনক বলে বিরোধিতা করেছে কংগ্রেস এবং সিপিএমও। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার জানান, এই ধরনের কর্মসূচি হলে মানবাধিকার এবং শিশু অধিকার লঙ্ঘিত হবে। এই কর্মসূচিকে ঘিরে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হলে তৃণমূল, মুখ্যমন্ত্রী দায়ী থাকবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন সুকান্ত। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীও এই কর্মসূচি নিয়ে রাজ্যের শাসকদলকে কটাক্ষ করে বলেন, “বাড়ি ঘেরাওয়ের রাজনীতি শুরু হলে তৃণমূলও ছাড় পাবে না।” শুক্রবারই এই কর্মসূচির বিরোধিতা করেছিল সিপিএম। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী এই প্রসঙ্গে বলেন, “বিরোধীদের বাড়ি ঘেরাও করা রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়।” এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাংলায় প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই আমদানি করেছিলেন বলে কটাক্ষ করেন তিনি।
তৃণমূলের অবশ্য বক্তব্য, বিজেপি এই কর্মসূচিকে ভয় পেয়েছে। রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা এই প্রসঙ্গে বলেন, “কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ১০০ দিনের কাজের টাকা এবং আবাসের টাকা আটকে রেখেছে। মানুষ তো হকের টাকা চাইবেই।” এই প্রসঙ্গেই তাঁর সংযোজন, “মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতাদের বাড়ি থেকে ১০০ মিটার দূরে জমায়েত করতে বলেছেন। বোঝাই যাচ্ছে বিজেপি ভয় পেয়েছে।” অভিযোগকারী বিজেপি নেতা এই প্রসঙ্গে বলেন, “ সভামঞ্চ থেকে যে ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে, তাতে প্ররোচনা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা প্রয়োজনে আদালতের দরজায় কড়া নাড়ব। জানতাম যে থানা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেবে না, তাই অনলাইনে অভিযোগ জানিয়েছি।” এই প্রসঙ্গেই তাঁর সংযোজন, “তৃণমূল নেতারা বাড়ি ঘেরাও করতে এলে বিজেপি নেতারাও বাইরে বেরোবেন।”
শুক্রবার ধর্মতলার সভা থেকে জোড়া সাংগঠনিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। তার প্রথমটি হল, ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকার দাবিতে ২ অক্টোবর গান্ধীজয়ন্তীতে দিল্লি অভিযান। দ্বিতীয়, কেন্দ্রীয় ‘বঞ্চনা’র বিরুদ্ধে ৫ অগস্ট রাজ্যের বুথে বুথে, ব্লকে ব্লকে, জেলায় জেলায় বিজেপি নেতাদের বাড়ি গণঘেরাও। দ্বিতীয় কর্মসূচির নকশাও মঞ্চ থেকে বলে দেন অভিষেক। তিনি বলেন, ‘‘সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করে রাখবেন! একদম গণঘেরাও! বাড়ির কেউ বয়স্ক থাকলে তাঁকে ছেড়ে দেবেন। আর কাউকে ঢুকতেও দেবেন না, বেরোতেও দেবেন না।’’
কিন্তু অভিষেকের পরেই বক্তৃতা করতে উঠে মমতা বুঝিয়ে দেন, এতটা ‘আগ্রাসন’ কাঙ্ক্ষিত নয়। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী বলেন, ‘‘অভিষেক ৫ অগস্ট একটা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমি বলব, ওটা ব্লকে ব্লকে করা হোক। শান্তিপূর্ণ ঘেরাও করো। বাড়ি থেকে ১০০ মিটার দূরে। ভোটের সময় যেমন বুথের ১০০ মিটার দূরে জমায়েত করা যায়। যাতে কারও ঢুকতে-বেরোতে অসুবিধা না-হয়।’’ অভিষেকের ঘোষণায় ওই ‘সংশোধন’ করার পাশাপাশি, ‘প্রতীকী’ শব্দটিও ব্যবহার করেন মমতা। তৃণমূলের অনেকের মতে, পাঁচ দশকেরও বেশি রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার সুবাদে পোড়খাওয়া রাজনীতিক মমতা বুঝেছেন, রাজ্যের প্রতিটি বুথে যদি বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করে তৃণমূলের জমায়েত, তা হলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
শুক্রবারই এই নিয়ে একটি বিবৃতি জারি করে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন এপিডিআর। তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের মূল সমাবেশস্থল ধর্মতলার মঞ্চ থেকে প্রথম এই কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে বক্তব্য রাখতে উঠে এই কর্মসূচির কথা জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করার এই কর্মসূচিকে ‘চরম অগণতান্ত্রিক, মানবতাবিরোধী ও বিপজ্জনক’ বলে বর্ণনা করেছে সংগঠনটি।
শনিবার এপিডিআর-এর সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত শূরের একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। তৃণমূলের সভামঞ্চ থেকে বিজেপি নেতাদের তালিকা তৈরি করে বাড়ি ঘেরাও করার কথা বলা হয়েছিল। বিবৃতিতে এই কর্মসূচিকে হিটলারের জার্মানির সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়, “শাসক দলের এই তালিকা তৈরি আমাদের জার্মানিতে হিটলারের সময় খুঁজে খুঁজে ইহুদিদের তালিকা তৈরির কথা মনে করিয়ে দিল। এ ভাবে ভিন্ন চিন্তার রাজনৈতিক কর্মীদের দাগিয়ে দেওয়া এবং পরিবার পরিজন-সহ তাঁদের বাসস্থানকে ঘেরাও করা মারাত্মক ব্যাপার।