বঙ্গ বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুনীল বনসল। — ফাইল চিত্র।
ভোটের আগে দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পথ বদলাচ্ছে বিজেপি। বহু দিনের সাংগঠনিক ‘ত্রুটি’ শুধরে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বে জমানা বদল হলেই তৃণমূল স্তর পর্যন্ত বদলে যায় সাংগঠনিক দায়দায়িত্বে থাকা মুখ। ফলে দলের অন্দরে অভিমানের পরত ক্রমশ পুরু হতে থাকে। সেই অভিমান আর বাড়তে দিতে চান না বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের রাজ্য পদাধিকারী এবং জেলা সভাপতিদের নিয়ে বৈঠক করে সে কথা স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন বঙ্গ বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুনীল বনসল।
বুথ এবং মণ্ডল সভাপতিদের নাম আগেই ঘোষিত হয়েছিল। রবিবার রাত পর্যন্ত ৪৩টির মধ্যে ৩৯টি সাংগঠনিক জেলার সভাপতিদের নামও ঘোষিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সভাপতিদের নাম ঘোষিত হলেও জেলায় জেলায় বা বিভিন্ন মণ্ডলে নতুন কমিটি এখনও গঠিত হয়নি। সেই সব কমিটি কী ভাবে গঠন করতে হবে, সে বিষয়েই গত ১৮ এপ্রিলের বৈঠকে বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক বনসল রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বকে এবং জেলা সভাপতিদের নির্দেশিকা দিয়ে গিয়েছেন। বনসলের স্পষ্ট নির্দেশ, এত দিন যাঁরা কমিটিতে ছিলেন, তাঁদের সকলকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গড়া যাবে না। এ বারের কমিটিতে পুরনো-নতুনের ‘ভারসাম্য’ রাখতে হবে।
এই ভারসাম্যের বার্তা নিছক ‘কথার কথা’ নয় বলেই বিজেপি সূত্রের দাবি। কারণ, মণ্ডল বা জেলা স্তরে নবনির্বাচিত সভাপতিরা বুড়ি ছোঁয়ার ঢঙে বিদায়ী কমিটির দু’-একজনকে নতুন কমিটিতে ঠাঁই দিলেই খাতায়-কলমে নিয়মরক্ষা দেখিয়ে দেওয়া যাবে, এমন নয়। নতুন কমিটিতে বিদায়ী কমিটির উপস্থিতির অনুপাত কেমন হবে, তাও বনসল নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকের নির্দেশ, মণ্ডল এবং জেলা স্তরের নতুন কমিটিগুলিতে অন্তত ৫০ শতাংশ সদস্য বিদায়ী কমিটি থেকে নিতে হবে। আর সব কমিটিতেই অন্তত দু’জন মহিলাকে রাখতে হবে।
বনসলের নির্দেশিকা নিয়ে বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বেরও আপত্তি নেই। রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক লকেট চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘আমরা তো এই ভাবেই কমিটি গড়ার চেষ্টা করতাম। আমি নিজে যে সব এলাকা দেখভাল করেছি, সেখানে সব সময় নতুন আর পুরনোদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। ভালই হল। এখন থেকে সেটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেল।’’
শীর্ষ নেতৃত্বে জমানা বদল হলে দলের সব স্তরে পুরনো নেতা-কর্মীদের পিছিয়ে পড়ার পরম্পরা শুধু পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতেই আছে, তা নয়। গোটা দেশেই বিজেপিতে এই প্রবণতা দেখা যায়। অনেক দাপুটে নেতা-কর্মীও সেই প্রবণতার ঘূর্ণিতে পড়ে সংগঠন থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যান। এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এককালে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়া নেতারা এখন অনেক পিছনে চলে গিয়েছেন। কেউ প্রতিশোধ নিতে দল ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ দল ছেড়ে না-গেলেও পুরো নিষ্ক্রিয়। বীরভূম জেলার এক প্রবীণ বিজেপি নেতা যেমন বলছেন, ‘‘এ বারের ভোটে আর আগের মতো করে নামব না। ভোটে হারলেই তৃণমূল এসে দোকান-ব্যবসা ভেঙে দেবে। বহু টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে। আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে। পার্টিও আমাদের ভুলে নতুনদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করবে। আমাদের আর চিনতে পারবে না। তাই পার্টির জন্য আর ব্যবসা বা সংসারের ক্ষতি করব না।’’ রাজ্য বিজেপির এক প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘‘এই ক্ষোভ অনেকের রয়েছে। আমি নিজে এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সক্রিয় করে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু অধিকাংশই আর মাঠে নামতে রাজি নন।’’
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছেও পুরনোদের এই ‘অভিমানের’ খবর রয়েছে। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাংলায় সেই ‘অভিমানের’ বহর আর বাড়তে দিতে চান না বনসল। তাই সর্বত্র নতুন কমিটিতে বিদায়ী-নবাগতদের সমান অনুপাত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যাঁরা পিছিয়ে পড়েছেন বা দূরে সরে গিয়েছেন, ভোটের আগে তাঁদের সক্রিয় করে তুলতে আরএসএস ময়দানে নেমেছে। তাতে সকলকে না হলেও অনেককেই ভোটের কাজে ফেরানো সম্ভব হবে বলে বিজেপি নেতৃত্বের আশা। আর নতুন করে কেউ যাতে ‘অভিমানী’ তালিকায় চলে না যান, তা নিশ্চিত করতে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিজেপি নেতৃত্বের এই নতুন নির্দেশিকা।
কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এই অনুপাত বেঁধে দেওয়ার নেপথ্যে বিজেপির নেতৃত্বের আরও একটি উদ্দেশ্য কাজ করছে। তা হল নির্বাচন ব্যবস্থাপনা। ভোটের দেওয়াল দখল থেকে প্রচার, বাড়ি বাড়ি বুথ স্লিপ পৌঁছে দেওয়া থেকে বুথ আগলানো, ভোটার তালিকার স্ক্রুটিনি থেকে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন স্তরের আধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, পশ্চিমবঙ্গের ভোটে এ সবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সব কাজের জন্য ভোটের কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা দরকার হয়। সর্বত্র পুরনোদের সরিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দিলে সেই অভিজ্ঞতার ঘাটতি দলকে ডোবাতে পারে বলে নেতৃত্ব মনে করছেন। লকেট সে কথা অকপটেই বলছেন। তাঁর কথায়, ‘‘নতুনরা তো জানবেনই না কী ভাবে ভোট করাতে হয়। যাঁরা এই কাজটা করে আসছেন, তাঁদের কাছ থেকেই তো নতুনদের শিখতে হবে। সুতরাং নতুন কমিটিগুলোতে বিদায়ী কমিটি থেকে অন্তত ৫০ শতাংশ সদস্য রাখার নির্দেশ জরুরি ছিল।’’