স্ত্রীর কান্নায় ভেঙে পড়লেন প্রিজ়ন ভ্যানে বসা শাহজাহান শেখ। —নিজস্ব চিত্র।
গ্রেফতারের পরে শরীরী ভাষা বদলে গিয়েছিল সন্দেশখালির শাহজাহান শেখের। সেই আক্রমণাত্মক ভাব এখন উধাও। এ বার প্রিজ়ন ভ্যানে বসে মেয়ের ‘আব্বু’ ডাক এবং স্ত্রীর কান্না শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না ‘সন্দেশখালির বাঘ’। মুখ ঘুরিয়ে আঙুল দিয়ে নিজের কান্না মুছলেন। তার পর রুমাল চাপা দিলেন মুখে। মঙ্গলবার বসিরহাট মহকুমা আদালতের বাইরে ‘অন্য শাহজাহান’কে দেখলেন সকলে।
শাহজাহানের এক ভাই শেখ আলমগিরকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। রবিবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে গ্রেফতার করে ইডিও। একই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় শাহজাহানের দুই শাগরেদ শিবপ্রসাদ (শিবু) হাজরা এবং দিদারবক্স মোল্লাকে। মঙ্গলবার শাহজাহান, আলমগির, শিবু, মাফুজার মোল্লা, জিয়াউদ্দিন, দিদার-সহ মোট ১২ জনকে বসিরহাট মহকুমা আদালতে হাজির করানো হয়। কিন্তু, আদালতের এক করণিক মারা যাওয়ার কারণে শুনানি প্রক্রিয়া হয়নি। আবার ৭ মে শাহজাহানদের আদালতে আনা হবে। সাসপেন্ড হওয়া তৃণমূল নেতাকে যখন আবার প্রিজ়ন ভ্যানে তোলা হচ্ছে, কয়েক মিটার দূর থেকে ‘আব্বু’ ডাক শুনে মুখ ফেরান তিনি। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘ঠিক আছি’ বুঝিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন শাহজাহান। গাড়ির একেবারে জানলার পাশে গিয়ে তত ক্ষণে দাঁড়িয়েছেন শাহাজাহানের স্ত্রী তসলিমা বিবি। তদন্তকারীদের তলবে যিনি ইতিমধ্যে একাধিক বার হাজিরা দিয়েছেন। স্ত্রীকে দেখে জানলার দিকে ফিরলেন। আকাশি রঙের জামা এবং ট্রাউজ়ার্স পরিহিত থমথমে মুখে স্ত্রীকে ধীরে ধীরে বললেন, ‘‘নিজের খেয়াল রাখবে।’’
প্রিজ়ন ভ্যানের জানলার কাছে তখন শাহজাহানের স্ত্রী-কন্যা সহ পরিবারের অন্যরাও দাঁড়িয়েছেন। সবাই শাহজাহানকে বলছেন, শরীরের যত্ন নিতে। এক জন বললেন, ‘‘সময় মতো ওষুধ খাবে।’’ স্ত্রী আঙুল ছুঁয়েছেন ভ্যানের জানলার রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে। স্ত্রীর কান্না দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না শাহজাহান। ‘আল্লার কাছে দোয়া কোরো’ বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। লুকিয়ে চোখ মুছলেন শাহজাহান।
উল্লেখ্য, শাহজাহান ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশ শিবির খুলে তখন যে সব অভিযোগ গ্রহণ করেছিল, তা খতিয়ে দেখে প্রাথমিক ভাবে ৮০টিরও বেশি মামলা দায়ের করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছে সিবিআই। এর বাইরেও সিবিআইকে ই-মেল আইডি ও অ্যাপ খুলে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির বাসিন্দাদের কাছ থেকে সরাসরি আরও অভিযোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। সেগুলিও নেওয়া শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে মামলার সংখ্যা শতাধিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তদন্তকারীদের দাবি। তদন্তকারী আধিকারিকদের কথায়, ৫ জানুয়ারি ইডির অফিসার ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের উপর হামলার ঘটনার পরে ফেরার হয়ে গিয়েছিল সন্দেশখালির ‘বেতাজ বাদশা’ শাহজাহান। আর তখনই সন্দেশখালির বাসিন্দারা শাহজাহান ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে জোর করে জমি দখল, মারধর, খুন, খুনের চেষ্টা ও ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করতে শুরু করেন। বিভিন্ন গ্রামে রীতিমতো শিবির খুলে বসিরহাট পুলিশ জেলার তরফে ওই অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া শাহজাহান ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই ১১টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ইডির আধিকারিকদের উপর হামলার পরে শাহজাহান ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশের তরফে আরও দু’টি মামলা করা হয়। সেই দু’টি মামলার তদন্তভারও সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল হাই কোর্ট। ওই দু’টি মামলায় শাহজাহান ও তাঁর ভাই আলমগির-সহ সাত জন এখন জেলে রয়েছেন।