দুবাইয়ের বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। —ফাইল চিত্র।
লক্ষ্য ছিল লগ্নি টানা। রাজ্যে বিনিয়োগ নিয়ে আসা। সেই লক্ষ্যেই স্পেন ও সংযুক্ত আমিরশাহি মিলিয়ে তিন শহরে তিনটি বাণিজ্য সম্মেলন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাত্রার সময় বাদ দিলে তাঁর আনুষ্ঠানিক সফর শুরু হয়েছিল ১৪ সেপ্টেম্বর স্পেনের মাদ্রিদ থেকে। শেষ হয়েছে ২২ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ে। সফরের শেষে গত শনিবার শহরে ফিরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘এত সফল কর্মসূচি আমি খুব কম দেখেছি।’’ সেই সুরেই মঙ্গলবার নবান্নের তরফেও জানানো হল, বিদেশি বাণিজ্যিক সংস্থা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সামনে বাংলার যথাযথ বিপণন করা সম্ভব হয়েছে। ইতিমধ্যেই কোন কোন সংস্থা কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলায় আসছে, তা-ও জানিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর এই সফরের ফলে রাজ্যে বিনিয়োগ আসার ব্যাপারে সামগ্রিক ভাবে আশাবাদী রাজ্য সরকার, প্রশাসন এবং বাংলার বণিকমহল।
গত ১২ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে দুবাই ছুঁয়ে স্পেনের উদ্দেশে রওনা দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা-সহ তাঁর সফর-দল। তাতে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপচেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী, শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের প্রধান সচিব বন্দনা যাদব-সহ বাংলার এক ঝাঁক প্রথম সারির শিল্পপতি। ছিলেন কলকাতার তিন প্রধান ক্লাব মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মহমেডান ক্লাবের কর্তারা। সেই প্রতিনিধিদল সঙ্গে নিয়েই স্পেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দরবারে বিনিয়োগের অবশ্য গন্তব্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গকে বিপণন করেছেন মমতা। এবং সফরের শেষে নবান্নের তরফে যে তথ্য-পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তার নিরিখে মুখ্যমন্ত্রী মমতার অতীতের সমস্ত বিদেশসফরকে তা ছাপিয়ে গিয়েছে।
রাজ্য সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, মাদ্রিদের বাণিজ্য সম্মেলনে ৩৭টি বাণিজ্যিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপস্থিত ছিল। বার্সেলোনায় সেটা বেড়ে হয়েছিল ৫৪টি। আবার দুবাইয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাণিজ্য সম্মেলনে হাজির ছিলেন ১৩৫টি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রী মমতার তিনটি শহরের বাণিজ্য সম্মেলনে মোট ২২৬টি বিদেশি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান উপস্থিত হয়েছিল। চলতি বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে সমস্ত বিদেশি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী প্রতিনিধিদলে ছিলেন কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় আয়োজক সংস্থা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের দুই কর্তা ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় এবং সুধাংশু দে। তাঁদের উপস্থিতিতেই বইয়ের প্রচার, প্রসার এবং দু’দেশের সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে চিন্তাভাবনা আদানপ্রদান বিষয়ক ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হয় স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে।
মমতার এই সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ও বাঙালির প্রিয়তম খেলা ফুটবলের উন্নতিসাধন। সেই লক্ষ্যেই পৃথিবীর ইউরোপের বৃহত্তম ফুটবল লিগ লা লিগার সঙ্গে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। লা লিগা প্রেসিডেন্ট হাভিয়ার তেভাজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মাদ্রিদে সেই বৈঠক এবং মউ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক তথা ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কথা হয়েছে, লা লিগা বাংলায় একটি অ্যাকাডেমি করবে। তাদের প্রতিনিধিরা এসে বাংলার ফুটবল প্রতিভার বিকাশ ঘটাবেন। মহিলা ফুটবলকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে সেই অ্যাকাডেমিতে। স্পেন সফরের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, লা লিগার হাতে যাদবপুর-সন্তোষপুরের কিশোরভারতী স্টেডিয়ামটি তুলে দেওয়া হবে। যাতে সেখানে তারা অ্যাকাডেমি গড়তে পারে। প্রশাসনিক মহলের আশা, মাসদুয়েকের মধ্যে অ্যাকাডেমির কাজ শুরু হয়ে যাবে।
মঙ্গলবার নবান্নের তরফে জানানো হয়েছে, দুই দেশের তিন শহরের বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান তুলে ধরেছেন। যে অবস্থান বিনিয়োগের জন্য কী কী কারণে অনুকূল। যেমন বাংলার পাশেই রয়েছে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান। বাংলায় বিনিয়োগ মানে লাগোয়া দেশগুলির বাজারও ধরার সুযোগ। তা ছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকেও ছোঁয়া যাবে। বাংলায় বিনিয়োগ করা মানে ভারত-মায়ানমার, বাংলাদেশ-চিন অর্থনৈতিক করিডরের সুবিধা পাওয়া।
গত ১২ বছর মমতার শাসনকালে বাংলার অর্থনৈতিক অগ্রগতিও তুলে ধরা হয়েছে স্পেন ও আরব মুলুকে। সেখানকার বণিকমহলের কাছে বার্তা দেওয়া হয়েছে, এই রাজ্যই এখন দেশের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। যার বৃদ্ধির হার ৮.৪ শতাংশ। বাংলাকে দেশের ‘ইকনমিক পাওয়ার হাউস’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে বিদেশের বণিকমহলের সামনে।
মরুশহর দুবাইয়ে বাণিজ্য সম্মেলনের আগে মমতার সঙ্গে একান্ত বৈঠক হয় লুলু শিল্পগোষ্ঠীর। তারা নিউটাউনে একটি শপিংমল নির্মাণ করবে বলে জানিয়েছে। তা ছাড়া খাদ্য প্রকিয়াকরণ, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের মল-এ রাজ্যের ব্র্যান্ড ‘বিশ্ববাংলা’র স্টোরও থাকবে। রাখা হবে বাংলার ফল-সব্জি। ওই একইদিনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে আমিরশাহির বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী থানি বন আহমেদ আল জ়েয়াউদির। পরে বাণিজ্য সম্মেলনে আল জ়েয়াউদি বলেন, ‘‘ভারত-আমিরশাহি সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। জনসংখ্যার বিচারে ভারতের চতুর্থ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে আমরা বিশেষ নজরে দেখছি।’’
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চর্মশিল্প, নির্মাণ, পর্যটন-সহ যে সব ক্ষেত্রে বাংলায় ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ আসতে শুরু হয়েছে, তা-ও তুলে ধরা হয় স্পেন ও আমিরশাহিতে। মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্পে বাংলায় যে বিপুল কর্মযজ্ঞ চলছে, তা-ও উপস্থাপিত করা হয়। বাংলা কেন এখন বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে ভাল গন্তব্য, তিনটি সম্মেলনেই বিদেশের মঞ্চে তা তুলে ধরেন সঞ্জীব গোয়েনকা, হর্ষ নেওটিয়া, মেহুল মোহনকা, তরুণ ঝুনঝুনওয়ালার মতো প্রথম সারির শিল্পপতিরা। তাঁরা প্রত্যেকেই জানান, রাজ্যে বর্তমান সরকারের আমলে ব্যবসা করা সুবিধাজনক হয়েছে। মমতার শাসনকালে বাংলা থেকে বন্ধ, হরতাল, ধর্মঘটের সংস্কৃতি বিদায় নিয়েছে। গত ১২ বছরে একটি শ্রমদিবসও শ্রমিক বিক্ষোভ বা অসন্তোষের ফলে নষ্ট হয়নি। তার উপরে রয়েছেন ‘সংবেদনশীল’ মুখ্যমন্ত্রী। যিনি নিজে শিল্পমহলের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে ব্যক্তিগত স্তরে খোঁজখবর রাখেন এবং সমস্যা হলে দ্রুত তার সমাধান করেন। দুবাইয়ের শিল্প সম্মেলনে সঞ্জীব তো স্পষ্টই জানিয়ে দেন, মমতার আগে ৩৪ বছরের বামশাসনের সময় রাজ্য সরকার ‘উদাসীন’ ছিল।
সফরের সময় মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং দুবাইয়ে প্রবাসী ভারতীয় এবং বাঙালিদের সঙ্গেও মিলিত হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে প্রতিনিধিদলের। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে ‘বাংলা দিবস’ এবং বাংলার রাজ্যসঙ্গীত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ সম্পর্কে প্রবাসী বাঙালিদের অবহিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। অনুরোধ করেছেন, বিদেশের মাটিতেও যেন ‘বাংলা দিবস’ পালিত হয়। গাওয়া হয় বাংলার রাজ্যসঙ্গীত।