Travel

নেভা নদীর তীরে

ইতিহাসের জীবন্ত দলিল সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর। বহু পরিবর্তনের সাক্ষী এই শহরে প্রকৃতি আর স্থাপত্য দুইয়েরই সুন্দর সহাবস্থানবিশ্বের উত্তরতম এই মেট্রোপলিস এতই বিপুল ও বৈচিত্রময় যে, এমন টুকরো টুকরো গল্পের বর্ণনা করা বেশ শক্ত।

Advertisement
আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২০ ০২:৫৪
ঐতিহাসিক: নেভা নদীর তীরে অবস্থিত সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর

ঐতিহাসিক: নেভা নদীর তীরে অবস্থিত সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর

দক্ষিণ শহরের রাজপথ ধরে চলেছি, ট্রামে চড়ে। গন্তব্যে পৌঁছে ফুটপাতে পা রাখতেই যেন প্রায় দাঁতকপাটি! ঠান্ডা হাওয়া হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। চটপট মিউজ়িয়ামের দিকে হাঁটা লাগালাম। গন্তব্যে পৌঁছনোর চেয়েও ঠান্ডা থেকে বাঁচার তাড়নায়।

এই শহরের নাম সেন্ট পিটার্সবার্গ। প্রায় দুশো বছর রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। বস্তুত, সাম্রাজ্যের কেন্দ্র হিসেবেই আঠারো শতকে এই শহরের জন্ম। সোভিয়েট আমলে রাজধানী মস্কোয় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও সেন্ট পিটার্সবার্গ রাশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রগুলির একটি, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। জ়ারতন্ত্রের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক বিকাশ এই শহরেই, এখান থেকেই ইউরোপের মানচিত্রে রাশিয়ার মহাশক্তিধর দেশ হয়ে ওঠা। শহর জুড়ে ছড়ানো তার অসংখ্য চিহ্ন— দুর্গ, প্রাসাদ, ক্যাথিড্রাল, মিউজ়িয়াম। মানুষের অসামান্য কীর্তির সঙ্গে প্রকৃতির লীলাও দেখার মতো। সেন্ট পিটার্সবার্গের অবস্থান নেভা নদীর মোহনায়। শহর জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে তার শাখা-প্রশাখা, তৈরি হয়ে গিয়েছে একাধিক দ্বীপ, সহসা ভেনিস বা ব্রুজ় বলে ভ্রম হতে পারে। বিপুল চওড়া নদী শহর ছাড়িয়ে মিশেছে ফিনল্যান্ড উপসাগরে। এই সমুদ্রের স্রোত আর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার হাওয়া মিলে শহরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছে পৌঁছে দেয়। নভেম্বর থেকে মার্চ— তাপমাত্রা সাধারণত শূন্যের অনেকটা নীচেই ঘোরাফেরা করে।

Advertisement

কাঁপতে কাঁপতে যে মিউজ়িয়ামে গিয়ে ঢুকলাম, তার নাম ‘গ্র্যান্ড মার্কেট রাশিয়া’। মিনিয়েচারের মাধ্যমে রুশ দেশকে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। পাহাড় থেকে নগর, নদী থেকে হ্রদ— সবই রয়েছে একটা বিরাট ঘরের ভিতর। আলোর খেলায় দিন-রাত হচ্ছে, ট্রেন-জাহাজ চলাচল করছে। কাছ থেকে দেখলে যেন সত্যি মনে হয়!

শহরের এই অংশটাকে ‘দ্য সোভিয়েট সাউথ’ বলে চেনাচ্ছিল গাইড বই। লেনিনের মৃত্যুর পরে শহরের নাম পাল্টে রাখা হয় লেনিনগ্রাদ। নিজের মতো করে তার পরিকল্পনা করেন স্তালিন। রাজপথের দু’ধারে বিরাট সব অ্যাপার্টমেন্ট, কমিউনিস্ট আমলে যেখানে প্রত্যেক গরিব নাগরিকের জন্য একখানা করে ঘর বরাদ্দ থাকত। সে সব বাড়ি আর রাস্তার দু’পাশে শ্রমিক-কৃষকদের ভাস্কর্য। কংক্রিটের মাঝে সবুজের ছোঁয়া— বিস্তৃত পার্ক। এমন আধুনিক দক্ষিণই তখন শহরের প্রাণ।

ভাস্কর্য: হিরোইক ডিফেন্ডার্স টু লেনিনগ্রাদ সৌধে সেনাকর্মীদের মূর্তি

শহরের উত্তর দিকটা এর উল্টো। সম্রাটের আমলে তৈরি, রাস্তার দু’ধারে প্রাসাদোপম প্রাচীন অভিজাত বাড়ির সারি। তার প্রাণকেন্দ্র প্যালেস স্কোয়্যার। সেখানে নেভা নদীর পারে শীতপ্রাসাদ ছিল সম্রাট ও তাঁর পরিবারের বাসস্থান। সেখান থেকেই নির্ধারিত হত এত বড় দেশের হালহকিকত। পর্যটকদের মূল আকর্ষণ সেই প্রাসাদ, তাদের সংগ্রহশালা হার্মিটেজ মিউজ়িয়াম, রাজকর্মচারীদের সাবেক বাসস্থান জেনারেল স্টাফ বিল্ডিং-সহ স্কোয়্যারের আরও কয়েকটি স্থাপত্য। মিউজ়িয়ামের সম্পদ পৃথিবী সেঁচে নিয়ে আসা। রেমব্রান্ট, ভ্যান গঘ, মাতিস, পিকাসো কার কীর্তি নেই সেখানে! আর যা আছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা বেশ মুশকিল। শ্রেষ্ঠ ধনপ্রাচুর্য আর শিল্পবোধের মিশেলে কী ঘটতে পারে, তারই সাক্ষী এই প্রাসাদ। এবং অবশ্যই ক্ষমতারও।

নদীর ও পারে একটা দ্বীপ জুড়ে বিশাল পিটার অ্যান্ড পল ফোর্ট্রেস। ১৭০৩ সালে জ়ার পিটার দ্য গ্রেট এই দুর্গ স্থাপন করেন, যেখান থেকে বড় হয়ে ওঠে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর। দুশো বছর সেখানে মূলত রাজনৈতিক বন্দিদেরই রাখা হত। সোভিয়েট আমলে মিউজ়িয়ামে পরিণত হয়। দ্বীপ থেকে মূল ডাঙায় পৌঁছলে আরও একটা জরুরি মিউজ়িয়াম— রাশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের সংগ্রহশালা। তার বড় আকর্ষণ একটা বারান্দা। বাড়িটি বলশেভিকদের সদর দফতর থাকাকালীন সেখান থেকে জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা দিতেন লেনিন, পেন্টিং বা ফোটোগ্রাফে যে দৃশ্য পরিচিত।

বিশ্বের উত্তরতম এই মেট্রোপলিস এতই বিপুল ও বৈচিত্রময় যে, এমন টুকরো টুকরো গল্পের বর্ণনা করা বেশ শক্ত। সেন্ট পিটার্সবার্গে এত কিছু দেখার-জানার আছে, এক বারের ভ্রমণে তাই এঁটে ওঠা অসম্ভব। এই শহরেই বাস করতেন ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি, তাঁর বাড়ি অবশ্য দ্রষ্টব্য। প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো চার্চ অব দ্য সেভিয়র অন ব্লাড-এর ভিতরে যে ফ্রেসকোর কাজ আছে, তেমন মোহিত করে দেওয়ার মতো শিল্পকর্ম গোটা ইউরোপের খুব কম স্থাপত্যে দেখা যায়। সেন্ট আইজ়্যাক’স ক্যাথিড্রাল-এর ২৬২ সিঁড়ি বেয়ে গম্বুজের উপর উঠলে মাথা ঘুরে যেতে পারে! মানুষের কৃতির যত রকম নমুনা হতে পারে, সবই হাজির। দিন পাঁচেক ভ্রমণের শেষে বুঝেছিলাম, এক বারের ট্রিপে এত কিছু ঘুরে ফেলা যায় না। যা বাকি থাকে, তার জন্যে আবার আসতে হয়। শেষবেলায় তাই চড়ে বসেছিলাম একটা বড় বোটে। প্রথমে ফিনল্যান্ড উপসাগরে ঘণ্টাখানেক, তার পর নদীর জালে-জালে শেষ বারের মতো শহরের আনাচ-কানাচ চিনে নেওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement