Kanchanjunga Express Train Accident

ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়লে কী ভাবে সামলাবেন নিজেদের? যাত্রা শুরুর সময়ে সঙ্গে কী রাখবেন?

দুর্ঘটনা বলেকয়ে আসে না। সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের জন্য কিছু জরুরি পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২৪ ১৫:০৭
How to deal with emergency situation following Kanchenjunga Express and goods Train Collision, Psychological impact on passengers

দুর্ঘটনা বলেকয়ে আসে না, যাত্রীরা কী কী মাথায় রাখবেন। —ফাইল চিত্র।

প্রচণ্ড শব্দ, একটি বিকট ঝাঁকুনি। তার পরই তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল সব কিছু। চোখ খুলতেই কেউ দেখলেন সামনে মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। কেউ হাজার ডাকাডাকি করেও প্রিয়জনের সাড়া পাননি। কেউ আবার নিজের চোখেই সহযাত্রীকে ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন। যাঁরা সুস্থ আছেন, তাঁরাও ভয়ে ও আতঙ্কে জবুথবু। সঙ্গে শিশু থাকলে বা বয়স্কেরা থাকলে, কী ভাবে তাঁদের সামলাবেন, সেই চিন্তাও তখন মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। জরুরি অবস্থায় কী করণীয়, তা ভেবেই পান না অনেক যাত্রী। প্রচণ্ড মানসিক চাপ, উত্তেজনা ও আতঙ্কে ভুল সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেন অনেকে। আবার এমনও দেখা যায়, দুর্ঘটনার ভয়ঙ্কর সময়টা পেরিয়ে আসার পরেও সেই মানসিক স্থিতি থেকে বেরোতে পারছেন না কেউ কেউ। ফলে সে দিক থেকেও মানসিক চাপ মনের ব্যাধির কারণ হয়ে ওঠে।

Advertisement

আপৎকালীন অবস্থায় কী কী করা উচিত আর কী নয়, সে কিছু কথা জেনে রাখাই ভাল—

ট্রেন থেকে ভুলেও নামবেন না

দুর্ঘটনার পরেই ট্রেন থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করেন অনেক যাত্রী। যে কামরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, সেখানেও যাত্রীরা প্রচণ্ড মানসিক উত্তেজনায় ট্রেন থেকে নেমে পড়ার চেষ্টা করেন। এই প্রসঙ্গে পূর্ব-রেলের প্রাক্তন মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামী বললেন, “যা-ই হয়ে যাক ট্রেন থেকে ভুলেও নামার চেষ্টা করবেন না। কারণ, ট্রেন কোথায় আছে, চারপাশের পরিস্থিতি কেমন, তা বোঝা সম্ভব হয় না। তাই এই অবস্থায় ট্রেন থেকে নামলে বিপদ হতে পারে।” অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে, জঙ্গলের মাঝে কোথাও দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেখানে পরিবহণ বা যোগাযোগের কোনও ব্যবস্থাই নেই। যাত্রীরা যদি উদ্বেগের কারণে সেখানে নেমে পড়েন, তা হলে পরে তাঁকে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে উঠবে। এতে পরিবার-পরিজনেরও উদ্বেগ বাড়বে।

হেল্পলাইন নম্বরের জন্য অপেক্ষা করুন

ফোনের নেটওয়ার্ক না পেলে বা ফোন অকেজো হয়ে গেলে চিন্তা করবেন না। সমীর গোস্বামী বলছেন, দুর্ঘটনা যেখানেই ঘটুক, রেল খুব দ্রুত হেল্পলাইন নম্বর চালু করে দেয়। তা ছাড়া দুর্ঘটনাস্থল থেকেও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করা হয়। তাই যত ক্ষণ না রেলের আধিকারিকেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছচ্ছেন, অপেক্ষা করুন। হেল্পলাইন নম্বর চালু হলে তার মাধ্যমেই যোগাযোগ করতে পারবেন। আত্মীয়-পরিজনেরাও সেই হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করলে আপনজনের খোঁজ পাবেন। সোমবার সকালে শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের সঙ্গে মালগাড়ির সংঘর্ষে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার পরে প্রতিটা স্টেশনেই হেল্পলাইন নম্বর চালু হয়েছে। সেখান থেকেও যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন সমীরবাবু।

আপৎকালীন অবস্থায় শিশু-বয়স্কদের সামলাবেন কী করে?

দুর্ঘটনা বলেকয়ে আসে না। কাজেই সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে যিনি পড়ছেন তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে বা তিনি সেই সময়ে কী ভাবে আচরণ করবেন, তা সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে বিপদের মুখে কী ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেতে পারে, তার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন মনোরোগ চিকিৎসক শর্মিলা সরকার। সেই পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখা প্রায় অসম্ভব। শর্মিলা বলছেন, ‘‘যদি যাত্রী নিজে বেঁচে যান, তা হলে সেটাই তখন তাঁর পরম পাওয়া। সঙ্গে যদি কোনও শিশু থাকে এবং সে কান্নাকাটি করতে থাকে, তা হলে বোঝান যে সে সুরক্ষিত আছে। খুব তাড়াতাড়ি সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসবেন। বয়স্কেরা এমন অবস্থায় প্রচণ্ড আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেন। যাঁদের হার্ট দুর্বল, তাঁদের ক্ষেত্রে মানসিক উত্তেজনা ভয়ের কারণ হতে পারে। তাই যিনি নিজে সুস্থ আছেন, তাঁর উচিত বাকিদের আশ্বস্ত করা। বাইরে কী ঘটছে, কাদের মৃত্যু হয়েছে, সে দিকে না দেখে চুপ করে বসে সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করা।”

সফরের সময়েই মেডিক্যাল কিট সঙ্গে রাখুন

বিপদ কখনও বলে আসে না। তাই নিজে থেকে সাবধান থাকতেই হবে। বিশেষ করে সফরের সময়ে সঙ্গে যদি বাড়ির খুদে সদস্য থাকে বা প্রবীণেরা থাকেন। আপনি একাও থাকতে পারেন। তাই সব সময়েই সঙ্গে ফার্স্ট এড কিট রাখা জরুরি। কী কী রাখবেন তাতে? ছোট, বড়, গোল... নানা আকারের ব্যান্ড এড রাখুন। অনেক সময়ে অ্যান্টিসেপটিক প্যাড রাখলেও কাজে দেয়। তুলো, স্টেরাইল গজ, ব্যান্ডেজ, লিউকোপ্লাস্ট বা মেডিক্যাল টেপও রাখুন। জ্বর, পেটখারাপ, বমির মতো সাধারণ ওষুধ অবশ্যই রাখুন। সঙ্গে থাক আর্নিকা। শিশুর জন্য চিকিৎসক যদি বিশেষ কোনও ওষুধ দিয়ে থাকেন, তা-ও বাক্সে রাখা বাঞ্ছনীয়। দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করতে ফার্স্ট এড বক্স রাখুন হাতের নাগালেই। সঙ্গে অবশ্যই হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার রাখবেন।

ওষুধ ছাড়াও টুকিটাকি যা যা রাখবেন

শুকনো খাবার সব সময়েই সঙ্গে রাখতে হবে। চেষ্টা করবেন বিস্কুট, মিষ্টি, কেক, ফল ইত্যাদি যেন সঙ্গে থাকে। যদি অনেকে মিলে সফর করেন, তা হলে সকলের কাছেই কিছু কিছু খাবার রেখে দেবেন। জল যদি কিনে খান, তা হলে পর্যাপ্ত জল সঙ্গে রাখার চেষ্টা করা ভাল। হাতব্যাগে অবশ্যই নিজের একটা জলের বোতল রাখবেন।

ফোনে সমস্যা হলে কী করবেন

বিপদের সময়েই হয়তো দেখলেন ফোন কাজ করছে না। যদি কল করার সমস্যা হয় তা হলে হোয়াট্‌সঅ্যাপে বাড়ির লোকজনকে মেসেজ পাঠিয়ে রাখুন। মোবাইল যদি হ্যাং করে যায়, তা হলেও উপায় আছে। মোবাইলের শব্দ বাড়ানো ও কমানোর বোতাম ও পাওয়ার বোতাম, সব একসঙ্গে ১০ সেকেন্ড টিপে ধরে রাখতে হবে। তার পরেই কিন্তু ফোন নিজে থেকে রিস্টার্ট নেবে। সমাধান খুব সহজ।

দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরলেন, কিন্তু কুরে কুরে খাচ্ছে আতঙ্ক

দুর্ঘটনায় যিনি শারীরিক ভাবে আহত হয়েছেন, তিনি তো বটেই, যিনি সুস্থ অবস্থায় বেঁচে ফিরেছেন তিনিও সেই আতঙ্কের মুহূর্তগুলি কাটিয়ে উঠতে পারেন না। একে বলা হয় ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার’। মনোরোগ চিকিৎসক অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এই ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরে, যাঁরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মস্তিষ্কে এক ধরনের চাপ, ভয়, আতঙ্ক চেপে বসে। দেখা যায়, তাঁরা অধিকাংশই ঘুমাতে পারছেন না। ঘুমিয়ে পড়লেও দুর্ঘটনার স্বপ্ন দেখছেন এবং ভয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ছেন। কেউ কেউ একা বসে কাঁদছেন, কেউ আবার হাসছেন। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। সাধারণত বড় দুর্ঘটনা থেকে ফিরলে কাউন্সেলিং করিয়ে নেওয়া খুব জরুরি। সে জন্য নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, যা মানসিক চাপ থেকে দ্রুত রেহাই দিতে পারে।

Advertisement
আরও পড়ুন