স্বপ্নপূরণ: গত ৪০ বছরের সেরা ফল করে ফিরেছে ভারত। জ্যাভলিনে সোনা জিতে নজির নীরজের। ফাইল চিত্র
গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত ভারতীয়ের কাছে এই দিনটার গুরুত্বই আলাদা। আমরা সবাই এই মুহূর্তে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালন করছি। স্বাধীনতা সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করার এটাই কিন্তু শ্রেষ্ঠ সময়। এখনই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে স্বাধীনতার তাৎপর্য।
গত দু’বছরে সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্ব গভীর সঙ্কটের সামনে এসে পড়েছে। কোভিড-১৯ এর জন্য আমরা সবাই নিজেদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছি। প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছি, কী ভাবে এত দিন ছোটখাটো জিনিসও নিশ্চিত ভাবেই আমাদের প্রাপ্য বলে মনে করতাম। যেমন, যেখানে ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর বা অবাধে শ্বাস নেওয়ার স্বাধীনতা। মনে হয় সেই কারণেই গত বছরে পেশাদার খেলাধুলো আবার শুরু হওয়ায় বা টোকিয়োয় শেষ পর্যন্ত অলিম্পিক্সের আসর বসায় আমরা সবাই মুক্তির স্বাদ পেয়েছি। শুধুমাত্র টিভিতে খেলা দেখা গেলেও সবারই তা ভাল লেগেছে। অবশেষে মানুষ যেন বাইরে বেরিয়ে এসে নিজেদের প্রকাশ করতে পেরেছে।
দুর্ভাগ্যবশত মানুষের প্রবণতা হচ্ছে, কোনও কিছু হারালেই একমাত্র তার মূল্য বুঝতে পারেন। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই স্বাস্থ্যসচেতন নন। ভারত হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম কনিষ্ঠ দেশ। একইসঙ্গে আবার পৃথিবীর যোগ্যতম দেশও নয়। আমাদের ক্রীড়াসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। তবু টোকিয়ো অলিম্পিক্সের সময় মানুষ এত ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেশকে সমর্থন করেছেন দেখে খুব ভাল লেগেছে। দারুণ হয় এর ফলে ভারতবাসী আরও অনুপ্রাণিত হয়ে খেলাধুলোকে জীবনের অঙ্গ হিসেবে বেছে নিলে। আমরা এক ক্রীড়াপ্রেমী দেশের মানুষ। কিন্তু এ বার আমাদের ভারতকে খেলাধুলোর দেশে পরিণত করতে হবে।
আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাটা স্পষ্ট হয়ে যায় শিশুদের কী চোখে দেখি, তার উপরে। অতিমারির জন্য বাধ্য হয়ে স্কুল বন্ধ করে দিতে হওয়ায়, দরিদ্র শিশুরা শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সামান্য স্বচ্ছল কিছু মানুষ ভার্চুয়াল মাধ্যমকে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বেছে নিতে পেরেছে।
যদিও আমাদের শিশুদের মধ্যে খেলাধুলো প্রসারের কোনও বিকল্প ব্যবস্থা করা যায়নি। তার কারণ আমরা আজও খেলাধুলোকে পড়াশোনার সমান প্রয়োজনীয় বলে মনে করি না। অথচ খেলার চর্চা করাটা শুধুমাত্র শারীরিক সক্রিয়তার জন্য নয়। তা একইসঙ্গে চরিত্রও গঠন করে এবং নেতৃত্ব দেওয়ার মানসিকতার জন্ম দেয়। একই সঙ্গে আবার পরস্পরকে সমাদর করতেও শেখায়। যা একজনকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে অতিমারি প্রত্যেকের, বিশেষ করে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে। কোনও ভাবেই আমরা এই মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটাকে উপেক্ষা করতে পারি না। একই সঙ্গে খেলাধুলোকেও অবহেলা করে যাওয়াটা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, খেলা শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যকেও সুন্দর করে তোলে।
আস্তে আস্তে আবার স্কুল খোলা শুরু হওয়ায় আর একটা উদ্বেগের দিকও কিন্তু থেকে যাচ্ছে। এ বার হয়তো পড়াশোনার খামতিটা কমিয়ে আনতে শারীরশিক্ষার ক্লাসগুলিকে নগণ্য মনে করা হবে। আমাদের এখনই খেলাধুলোকে গুরুত্ব দিতে শুরু করতে হবে। সম্ভবত শারীরশিক্ষার ক্লাসকে গুরুত্ব দেওয়ার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। এবং সেটা সপ্তাহে একদিন নয়, প্রত্যেকদিনই করতে হবে।
খুব ভাল একটা ব্যাপার হতে পারে প্রত্যেকদিনই যদি শারীরশিক্ষার ক্লাস দিয়ে স্কুল শুরু করা যায়। এটা করলে কিন্তু ছেলেমেয়েরা সারাদিনের পড়াশোনাতেও আরও উন্নতি করবে।
অলিম্পিক্সে পদকজয়ীদের সাফল্য আমাদের শিশুদের খেলার প্রতি আরও আকৃষ্ট করতেই পারে। পাশাপাশি দারুণ একটা ব্যাপার হয়, যদি খেলাটাকে আমরা রোজকার জীবনের অঙ্গ করে নিতে পারি। অনেক দেশের অলিম্পিয়ানেরই কিন্তু খেলার পাশাপাশি অন্য একটা সফল পেশাও রয়েছে। টোকিয়োয় এ বার সোনাজয়ী অস্ট্রেলীয় রোয়ার জেসিকা মরিসন যেমন একইসঙ্গে একটি বড় উপদেষ্টা সংস্থার কর্মী। ভারতে বেশির ভাগ মানুষকেই খেলা অথবা অন্য কোনও জীবিকাকে বেছে নিতে হয়। যদি আমাদের ছোটরা খেলায় আসে, তা হলে ওরা সবাই যে ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠবে, তা কিন্তু নয়। কিন্তু নিশ্চিভাবেই ওদের অনেকেই সুস্থাস্থ্যের অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক বা আইনজীবী হয়ে উঠবে।
এ দিকে আমরা যখন আবার স্কুল খোলার কথা ভাবতে শুরু করেছি, তখন কিন্তু একই সঙ্গে কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকিও নিয়ে ফেলছি। তাই আবার স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। যাতে শিক্ষার প্রসার ঘটানো ক্রমশ আরও কঠিন হয়ে উঠবে। তাই পাশাপাশি আমাদের দেখতে হবে, শিশুরা যেন সবসময় শারীরিক ভাবে সক্রিয় থাকে। মোবাইলের উপরে আমাদের নির্ভরতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এমন একটা সময়ে মনে রাখতে হবে, আমরা নিজেরা যেন কোনও ভাবে অচল, গতিহীন না হয়ে উঠি। তাই শিক্ষার অধিকারের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ খেলাধুলোর স্বাধীনতাও। শিশুরা আবার স্কুলে ফিরলে আমরা যেন ওদের প্রতি ধৈর্যশীল ও সহানুভূতিশীল থাকি। মনে রাখতে হবে, এতদিন ধরে সবাই কিন্তু ভার্চুয়াল শিক্ষালাভের সুযোগ পায়নি।
স্বাধীনতা দিবসের ৭৫ বছর উপলক্ষে আসুন আমরা সবাই শপথ নিই— ভারতকে ক্রীড়াপ্রেমী দেশের থেকে খেলাধুলোর দেশে পরিণত করব। জাতীয় স্বাস্থ্যের প্রতি আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব আছে। জয় হিন্দ।