মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই বাবুন বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
অশনি সঙ্কেত দেখা গিয়েছিল গত অক্টোবর মাসেই। হকি বেঙ্গলের সভাপতি পদ থেকে সরানো হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই স্বপন (বাবুন) বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এ বার বাংলার অলিম্পিক্স সংস্থা (বিওএ) থেকেও সরে যেতে হল তাঁকে। শুক্রবার বিওএ-র নির্বাচনে জিতে সংস্থার নতুন সভাপতি হয়েছেন চন্দন রায়চৌধুরী। বাংলার খেলাধুলোর জগতে বাবুনের খানিকটা ‘আধিপত্য’ তো ছিলই। এই নির্বাচনে হারের পরে তা অনেকাংশেই খর্ব হল। খবর এ-ও যে, নির্বাচনে বাবুনের হারে মুখ্যমন্ত্রী ‘অপ্রসন্ন’ হননি।
বস্তুত, শুক্রবার নির্বাচন হওয়ার আগেই ইঙ্গিত ছিল যে, বাবুন হারতে পারেন। তাঁকে সরানোর তোড়জোড় অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। অসমর্থিত সূত্রের দাবি, নেপথ্যে থেকে গোটা নির্বাচন পরিচালনা করেছেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। তাঁর মদতেই বাবুনের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন রোয়িং সংস্থার কর্তা চন্দন। মমতার ‘আস্থাভাজন’ অরূপ সাধারণত ‘দিদি’র অনুমোদন বা নির্দেশ ছাড়া কোনও কাজ করেন না। সেই সূত্রেই মনে করা হচ্ছে, বাবুনের পরাজয়ে মমতা ‘অপ্রসন্ন’ হননি। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠমহলের খবর, বিওএ-র নির্বাচনের ফলাফল জেনে ‘সন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নির্বাচনে জয়ীরা রাতে ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপের সঙ্গে গিয়ে দেখাও করেছেন।
সাধারণ সচিব পদে বাবুন শিবিরের কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ও হেরেছেন। নির্বাচন কি ‘স্বচ্ছ’ হয়েছে? বাবুন বলেছেন, “কিছু তো একটা হয়েছেই। সে ব্যাপারে আমি পরে বলব।” তবে বিওএ-র সভাপতি পদ হারানোর পর পাশাপাশিই তিনি বলেছেন, “খেলাধুলোয় হার-জিত রয়েছে। সে ভাবেই আমি হার স্বীকার করছি। তবে ভোট ময়দান ছেড়ে পালাব না। অন্য অনেক খেলার সঙ্গে আমি জড়িত। সেই খেলার উন্নতি করার চেষ্টা করব। যাঁরা জিতেছেন, তাঁদের চেয়েও বেশি কাজ করে দেখানোর চেষ্টা করব।”
প্রসঙ্গত, শুক্রবারের ভোটে ‘নির্বাচনী কমিশনার’-এর ভূমিকায় ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর আর এক সহোদর অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের ময়দানে তিনি সরাসরি প্রার্থী না থাকলেও তাঁর ‘ভূমিকা’ যে ছিল, তা বাংলার ক্রীড়ামহলের সকলে জানেন। ঘটনাচক্রে, চার বছর আগে ময়দান দেখেছিল মুখ্যমন্ত্রীর এই দুই সহোদরের ভোটের লড়াই। এই বিওএ নির্বাচনেই দাদা অজিতের বিরুদ্ধে সভাপতি পদে দাঁড়িয়েছিলেন বাবুন। এবং দাদাকে হারিয়ে জিতেছিলেন। তখন ওই নির্বাচন ঘিরে বহু বিতর্ক এবং কাদা ছোড়াছুড়ি দেখেছিল ময়দান। শোনা গিয়েছিল, দুই ভাইয়ের ‘ক্ষমতাদখলের লড়াই’ মুখ্যমন্ত্রী খুব একটা ভাল চোখে দেখেননি। এ বার অজিত নির্বাচনী ময়দানে প্রার্থী হিসেবে নামেননি। নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। কিন্তু ময়দানের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালেরা বলছেন, যাবতীয় ঘুঁটি চেলেছেন তিনি এবং অরূপ। সাজিয়েছেন রণকৌশলও।
উল্লেখ্য, মমতার সঙ্গে বাবুনের সম্পর্ক কখনওই খুব ‘মসৃণ’ নয়। মাঝেমধ্যেই বিবিধ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় বাবুনকে নিয়ে মমতা ‘বিড়ম্বনা’য় পড়েন। এ বছরের মাঝামাঝি লোকসভা ভোটের সময়েও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাবুন। হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হতে না পেরে প্রকাশ্যে নির্দল প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা করেছিলেন তিনি। হাওড়ায় ভোটে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে দক্ষিণ হাওড়া বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটারও হন। ওই ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করেন। বেগতিক দেখে ‘বিদ্রোহী’ অবস্থান থেকে সরে এসেছিলেন বাবুন। কিন্তু ভোট দিতে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। তার পরেও প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে যাননি বাবুন। নীরব ছিলেন হকি বেঙ্গলের সভাপতির পদ থেকে অপসারণের পরেও।
বিওএ-তে মোট ভোট ৬৮টি। জয়ী প্রার্থীকে পেতে হত ৩৫টি ভোট। নির্বাচনের আগেই নতুন সভাপতি চন্দন দাবি করেছিলেন, তিনি ৪০টি ভোট পাবেন। পেয়েছেন তার চেয়েও পাঁচটি বেশি— ৪৫টি ভোট। বাবুন পেয়েছেন চন্দনের অর্ধেকেরও কম, ২০টি ভোট। তবে তিনিও দাবি করেছিলেন ভোটে জিতবেন! ভোট-শেষে দেখা গেল, বড় ব্যবধানে হেরেছেন বাবুন।
খেলাধুলোর সঙ্গে যুক্ত কর্তাদের একটি অংশ অবশ্য বলছেন, এমন হওয়ারই ছিল। এর আঁচ মিলেছিল গত অক্টোবরেই। ১২ বছর সভাপতি থাকার পরে হকি বেঙ্গলের সভাপতি পদ থেকে সরতে হয় বাবুনকে। আচমকাই ওই পদে ঘোষণা করা হয় মন্ত্রী সুজিত বসুর নাম। তখন সংস্থার একটি সূত্র জানিয়েছিল, সভাপতি পদে ১২ বছর থাকার পর ‘কুলিং অফ’-এ যেতে হত বাবুনকে। সেই নিয়ম মেনেই আর কর্মসমিতিতে রাখা হয়নি তাঁকে। পক্ষান্তরে, বাবুন-ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল, এমন কোনও নিয়মের উল্লেখ নেই ভারতের হকি ফেডারেশনে। তবে ঘনিষ্ঠমহলে বাবুন ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, যাঁদের বিশ্বাস করেছিলেন, তাঁরাই পিছনে ছুরি মেরেছেন। ‘কুলিং অফ’-এ যাওয়ার কথা সে ভাবে জানতেনই না তিনি। সেপ্টেম্বরেই পদত্যাগ করেছিলেন। পরে যখন দেখেন যে, নতুন কমিটিতে বেছে বেছে তাঁর অনুগামীদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি হতাশ হয়ে পড়েন।
বিওএ-র শুক্রবারের নির্বাচনে সভাপতি পদে বাবুনের পাশাপাশি সাধারণ সচিব পদে বাবুন শিবিরের কল্যাণও হেরেছেন। তিনি পেয়েছেন ২০টি ভোট। অন্য দিকে, চন্দন শিবিরের জহর দাস ওই পদে দাঁড়িয়ে ৪১টি ভোট পেয়েছেন। উল্লেখ্য, গত নির্বাচনে বাবুনের সঙ্গে থাকলেও এ বার শিবির বদল করেছেন জহর। নির্বাচনের আগে দাবি করেছিলেন, গত চার বছর কাজ করতে পারেননি। কোষাধ্যক্ষ পদে দ্বিতীয় কেউ মনোনয়ন না দেওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন কমল মৈত্র।