এ বারের আইপিএল নতুন জীবন দিয়েছে রিঙ্কুকে ফাইল চিত্র
পরিবারের একমাত্র রোজগেরে তিনি। মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আয় করা পরিবার যখন হঠাৎ ৮০ লক্ষ টাকা দেখেছিল তখন বুঝেছিল ছেলে সত্যিকারের কিছু করেছে। কিন্তু ছেলের মনে তখনও হতাশা। টাকা হয়তো পেয়েছেন, কিন্তু যে কারণে সেই রোজগার, সেই ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাবেন তো? আইপিএলের মতো বড় প্রতিযোগিতায় তাঁর মতো অনভিজ্ঞ ক্রিকেটারকে প্রথম একাদশে রাখবে তো ফ্র্যাঞ্চাইজি। সন্দেহ অমূলক ছিল না। প্রথম চার বছরে মাত্র ১০টি ম্যাচ খেলেছিলেন। আহামরি কিছু খেলতে পারেননি। তার মধ্যে গত মরসুমে চোটের কারণে অনেক দিন দলের বাইরে ছিলেন। সেই দুঃস্বপ্ন এখনও ভুলতে পারেননি। তবে এ বার গল্পটা আলাদা। তিনি কী করতে পারেন তা দেখেছে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। তাঁর লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন সবাই। কলকাতা নাইট রাইডার্সের সব থেকে জনপ্রিয় সদস্য হয়ে উঠেছেন ২৪ বছরের রিঙ্কু সিংহ।
২০১৮ সালের আইপিএলের নিলামে ৮০ লক্ষ টাকায় রিঙ্কুকে কেনে কেকেআর। কিন্তু ২০২১ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০টি ম্যাচ খেলে ৭৭ রান করেন তিনি। তার মধ্যে ২০২১ সালের আইপিএলের আগে বিজয় হজারে প্রতিযোগিতায় খেলতে গিয়ে হাঁটুতে চোট পান তিনি। তার পরেই ভবিষ্যতের চিন্তা গ্রাস করে তাঁকে। রিঙ্কু বলেন, ‘‘চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করার কথা বলেন। প্রায় সাত মাস খেলার বাইরে থাকতে হবে বলেও জানান। চিন্তায় ২-৩ দিন খাবার মুখে তোলেননি বাবা। একমাত্র রোজগেরে চোট পাওয়ায় আর্থিক চিন্তা গ্রাস করেছিল তাঁকে। আমিও চিন্তায় ছিলাম। ভেবেছিলাম আবার কি মাঠে নামতে পারব? ভাল ক্রিকেট খেলতে পারব? আইপিএলে কি আমার উপরে ভরসা দেখাবে কোনও ফ্র্যাঞ্জাইজি? এ রকম হাজারো চিন্তা শুরু হয়। ঠিক তখনই পাশে এসে দাঁড়ায় কেকেআর।’’
রিঙ্কুর অস্ত্রোপচারের খরচ, চিকিৎসার খরচ, রিহ্যাবের দায়িত্ব সব নেয় নাইট রাইডার্স। শুধু তাই নয়, এ বারের নিলামে ফের ৫৫ লক্ষ টাকায় রিঙ্কুকে কেনে তারা। তাঁর উপরে ভরসা রাখার জন্য কলকাতার ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রতি কৃতজ্ঞ রিঙ্কু। তাই জন্যই তিনি বলেন, ‘‘গত বছর আমি টেলিভিশনে খেলা দেখতাম। প্রতিটা মুহূর্ত মিস করতাম। গত বার কলকাতা যখন ফাইনালে উঠল তখন ইচ্ছে করছিল ছুটে মাঠে চলে যাই। এ বারের নিলামের আগে নীতীশ রানা আমাকে জানায় আমাকে কিনতে আগ্রহী কলকাতা। আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। কলকাতার জন্য আমার মনে অনেক ভালবাসা রয়েছে। কারণ কলকাতা আমাকে জীবন দিয়েছে। আমার উপর ভরসা রেখেছে। আমার বাড়ির লোক প্রথম বার কলকাতার জন্যই এত টাকা দেখেছে। ওরা আমাকে নিয়ে গর্বিত। সবটাই হয়েছে কেকেআরের জন্য।’’
কেন রিঙ্কুর প্রতি এতটা সদয় কেকেআর? যখন অন্য দল তাঁকে নিয়ে আগ্রহ দেখায় না তখন বার বার কেন কলকাতা তাঁকে কেনে? শুধুই কি এক জন ঘরোয়া ক্রিকেটার রাখা? তেমনটা কিন্তু শোনা যাচ্ছে না ম্যানেজমেন্টের তরফে। কলকাতা দলের মেন্টর অভিষেক নায়ার বলেন, ‘‘গত মরসুমে চোট পাওয়ার পর থেকে অনেক বদল হয়েছে রিঙ্কুর। ও অনেক বেশি পরিণত হয়েছে। কারণ চোটে থাকার সময় ও বুঝতে পেরেছে খেলার মধ্যে থাকার গুরুত্ব ঠিক কতটা। শুধু তাই নয়, ও সারা ক্ষণ আনন্দে মাতিয়ে রাখে সাজঘর। ওর মধ্যে কোনও নেতিবাচক চিন্তাভাবনা নেই। এখন ক্রিকেটাররা যেহেতু জৈবদুর্গের মধ্যে থাকে, তাই এই ধরনের এক জন ক্রিকেটার থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দলের সবাই খোলা মনে খেলতে পারে।’’
তা হলে কি শুধুই দলের পরিবেশ চনমনে রাখার জন্যই রিঙ্কুকে রাখা। না। অভিষেক বলেন, ‘‘রিঙ্কুর ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে ও কত ভাল ব্যাটার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওর গড় ৬৪.০৮। লিস্ট এ ক্রিকেটে গড় ৫০.৫০। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রিকেট বোধ। এর আগে ওর ভূমিকা ছিল অন্য ক্রিকেটারদের সঙ্গ দেওয়া। তাদের সঙ্গে জুটি বাঁধা। কিন্তু এখন ও নিজে দায়িত্ব নিচ্ছে। খেলা জেতানোর চেষ্টা করছে।’’
এ বারের আইপিএলে সাত ম্যাচে সুযোগ পেয়েছেন রিঙ্কু। ৩৪.৮০ গড়ে ১৭৪ রান করেছেন তিনি। কেকেআর দলে আন্দ্রে রাসেলের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড় তাঁর। স্ট্রাইক রেট ১৪৮.৭১। পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাট করেছেন তিনি। গুজরাত টাইটান্সের বিরুদ্ধে কঠিন পরিস্থিতিতে ২৮ বলে ৩৫ রান করেছেন। রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে ২৩ বলে ম্যাচ জেতানো ৪২ রানের ইনিংস খেলেছেন। লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধে হারতে থাকা ম্যাচ একার ব্যাটে জিতিয়ে দিচ্ছিলেন। ১৫ বলে ৪০ রান করেন তিনি। শেষ ওভারের পঞ্চম বলে এভিন লুইসের দুরন্ত ক্যাচে আউট না হলে হয়তো দলকে জিতিয়ে ফিরতেন তিনি। ম্যাচ শেষে রিঙ্কুর প্রশংসা শোনা গিয়েছে বিপক্ষ অধিনায়কের গলাতেও।
রিঙ্কুকে নিয়ে গর্বিত অভিষেক। কলকাতার অ্যাকাডেমিতে এই ক্রিকেটারকে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হতে দেখেছেন তিনি। তাই তিনি যখন একার দায়িত্বে ম্যাচ জেতান তখন আনন্দ পান মেন্টর। আউট হওয়ার পরে রিঙ্কুর দুঃখ দেখে কষ্ট পান দলের অধিনায়ক শ্রেয়স আয়ার। তিনি প্রকাশ্যে জানান, এ বারের আইপিএলে কলকাতার সব থেকে বড় প্রাপ্তি রিঙ্কু। কোচ ব্রেন্ডন ম্যাকালাম দল ছেড়ে যাওয়ার সময়ও বলে যান রিঙ্কুর দিকে নজর থাকবে তাঁর। সত্যিই রিঙ্কুকে নতুন জীবন দিয়েছে কলকাতা। কেকেআরের প্রাণ হয়ে উঠেছেন রিঙ্কুও।