২০১৯-এর সেই টেস্টের পর বেশ কয়েক বার ইডেনে খেলেছেন কোহলি। কখনও টি-টোয়েন্টি, কখনও ৫০ ওভারের ম্যাচে। — ফাইল চিত্র
প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে ইডেনে ফিরেছিলেন তিনি। আদর-আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি ছিল না। প্রথম বার ইডেন গার্ডেন্সের সামনে বাস থেকে নামার সময়েই হোক বা ম্যাচের শেষে শাহরুখ খানের সঙ্গে ‘ঝুমে জো পাঠান’ গানে পা দোলানো, বিরাট কোহলির কলকাতায় প্রত্যাবর্তন হয়ে থাকল বর্ণময়। চার দিনের এই কলকাতা ‘সফরে’ সেই বিরাট তেজ দেখা গেল না ঠিকই, কিন্তু সমর্থকদের মন জিততে তিনি সফল।
আর ছ’টা মাস আগে এই শহরে খেলতে এলে ইডেনকে অনায়াসে ‘অপয়া’ বলতে পারতেন বিরাট কোহলি। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে এই মাঠেই তো গোলাপি বলের টেস্ট খেলার পর শতরানের খরা শুরু হয়েছিল। সেই যে শতরান হল, তার পর থেকে শুধু ইডেন কেন, দেশ-বিদেশের কোনও মাঠেই তাঁর ব্যাটে তিন অঙ্কের রান ছিল না। যে মাঠে খেলতে নামা বিশ্বের বহু ক্রিকেটারের কাছে স্বপ্নের, সেটাই অসহ্য হয়ে উঠেছিল ভারতের অন্যতম সেরা এক ব্যাটারের কাছে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে কোহলির ব্যাট থেকে শতরান আসার পর হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ইডেন।
২০১৯-এর সেই টেস্টের পর বেশ কয়েক বার ইডেনে খেলেছেন কোহলি। কখনও টি-টোয়েন্টি, কখনও ৫০ ওভারের ম্যাচে। শেষ বার এসেছিলেন জানুয়ারিতে। কিন্তু তিন বছর আগে যে কোহলিকে দেখেছিল ইডেন, তার সঙ্গে এখন আর কোনও মিল নেই। তখন কোহলি পূজিত হতেন ঈশ্বর হিসাবে। সমতুল্য ছিলেন সচিন তেন্ডুলকরের। কালক্রমে এই কোহলির এখন ক্রিকেট সন্ন্যাসের সময়। ক্রিকেট জীবনের শেষ কয়েকটা বছর উপভোগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।
এই কোহলিকেই এক বছর আগে চেনা যেত না। টানা ব্যর্থতার জেরে ভিতর থেকে একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিলেন তিনি। নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন। ক্রিকেট জীবনের তুঙ্গে থাকার সময় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ব্যাটে রান আসছিল। অধিনায়ক হিসাবে সাফল্যও পাচ্ছিলেন। কিন্তু কোনও সাফল্যই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কাঁটার মতো খচখচ করত আইসিসির কোনও প্রতিযোগিতায় ট্রফি না জেতার ব্যাপারটি। চোখের সামনে বেশ কয়েক বার স্বপ্নভঙ্গ দেখতে হয়েছে। টানা সমালোচনা শুনতে শুনতে সেই নেতৃত্বের ভারই এক সময় কাঁটার মুকুট হয়ে মাথায় চেপে বসেছিল। নিজের সমস্যা বুঝে নিয়ে তা ঝেড়ে ফেলতে এক মিনিটও সময় নেননি কোহলি।
তার পরেই ম্যাজিক! প্রথম কয়েকটা ম্যাচের পরেই ব্যাটে ফিরল রান। যে কোহলি তিন বছর মাথা খুঁড়েও একটি শতরান করতে পারেনি, তাঁরই ব্যাটে গত কয়েক মাসে চার-চারটি শতরান দেখা গিয়েছে। সবক’টি ফরম্যাটেই তিন অঙ্কের রান করে ফেলেছেন তিনি। জাত ব্যাটাররা বোধহয় এ রকমই হন। ফুরোতে ফুরোতেও ফুরিয়ে যান না। শেষ বেলায় জ্বলে ওঠেন। কোহলির ক্ষেত্রেও সেটাই দেখা যাচ্ছে। ক্রিকেট জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন নিজের দক্ষতা।
কথায় আছে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। একই কথা কোহলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যতই তিনি নেতৃত্ব ছেড়ে দিন (বা তাঁর থেকে কেড়ে নেওয়া হোক), ভেতরে যে জন্মগত নেতা রয়েছে, সেটাকে কেড়ে নেওয়া যাবে কী ভাবে? খাতায়-কলমে নেতা হিসাবে মাঠে নামেন অন্য কেউ। কিন্তু পরিস্থিতি কঠিন বুঝলেই ‘নেতা’ কোহলি এগিয়ে আসেন। এ বারের আইপিএলে আরসিবির দুটি ম্যাচে সেটা দেখাও গিয়েছে। আগের ম্যাচেই যখন মহম্মদ সিরাজ বল হাতে সাফল্য পাচ্ছিলেন না, তখন কোহলিই এগিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘‘যা, ওর মাথা লক্ষ্য করে বল কর।’’ সিরাজ অক্ষরে অক্ষরে সে কথা পালন করেন। এ ছাড়া মাঠে ফিল্ড সাজিয়ে দেওয়া, অধিনায়ককে গিয়ে কোন বোলার আনতে হবে সে ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া, এ সব তো রয়েছেই।
এর পরেও কোহলি দিনের শেষে রক্তমাংসের মানুষ। তাই সুনীল নারাইনের বলটা যখন পিচে পড়ে সামান্য ঘুরে গিয়ে তাঁর অফস্টাম্প ফেলে দেয়, তখন তিনি বিমূঢ় হয়ে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। এক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতে থাকেন বলের গতিপথ। মাথার মধ্যে অনেক ভাবনা। ভুলটা হল কোথায়? কোন শট খেলা উচিত ছিল এই বলে? নিশ্চিত ভাবেই ম্যাচের পর ওই আউটের ভিডিয়ো অনেক বার দেখবেন কোহলি। পরের বার একই ভুল যাতে আর না হয়, তার জন্য অনুশীলনে ডুবিয়ে দেবেন নিজেকে।
২০১৪ সালেও এমনটাই দেখা গিয়েছিল। ইংল্যান্ড সফর। জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রডরা ম্যাঞ্চেস্টার, লর্ডসের পিচে আগুন ঝরাচ্ছেন। দলের বাকিরা রান পেলেও কোহলির ব্যাট কিছুতেই জ্বলে উঠছে না। তিন অঙ্ক তো দূর, দুই অঙ্কের রানেও পৌঁছতে পারেননি অনেক সময়। ১০টা ইনিংস খেলে নামের পাশে মোটে ১৩৪। দেশে ফিরে ছুটে গিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকরের কাছে। জিজ্ঞাসা করে নিয়েছিলেন, কোথায় ভুলটা হল? কী পরামর্শ পেয়েছিলেন তা এখনও জানা যায়নি। তবে ফলটা টের পাওয়া গেল চার বছর পরে। আগের বার পাঁচ টেস্ট মিলিয়ে যেখানে ১৩৪ রান ছিল, সেখানে ২০১৮-য় প্রথম টেস্টেই পাওয়া গেল ১৪৯ রানের ঝকঝকে ইনিংস। এই না হলে জাত খেলোয়াড়!
কোহলির সঙ্গে কোথাও গিয়ে কি মিল খুঁজে পাওয়া যায় টাইগার উডসের খেলোয়াড়ি জীবনের? গলফ খেলতে নিয়ে নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন উডস, তার ধারেকাছে এখনও কোনও খেলোয়াড়ই আসতে পারেননি। একের পর এক মাস্টার্স, মেজর খেতাব জিতে উডসের কাছে ছিল নস্যি। রোরি ম্যাকিলরয়, ফিল মিকেলসন, জ্যাক নিকলাসদের সঙ্গে অহরহ তুলনা হত। কিন্তু উডস নিজে কোনও দিন বিতর্কে ঢুকতে চাননি। শুধু নিজের কাজটা করে গিয়েছেন। সাধেই কি আর নামের পাশে ১৫টি মেজর রয়েছে! গলফের সাধক উডস।
কোহলিও তেমনই ক্রিকেটের সাধক। কেরিয়ারের শুরুর দিকে আর পাঁচটা দিল্লির ক্রিকেটার যেমন হয়, তেমনই ছিলেন তিনি। কিছুটা ভারিক্কি চেহারা, বদমেজাজি, আগ্রাসী। প্রথম দুটো জিনিস তাঁর ক্রিকেটজীবন বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না ভেবেই এক লহমায় নিজেকে বদলে ফেলেন। বয়স তিরিশের কোঠা পেরিয়েছে অনেক দিন। কিন্তু ফিটনেস, শারীরিক সক্ষমতা, দক্ষতা— এখনও সব কিছুর শীর্ষে তিনি। উডস এবং কোহলির ব্যক্তিগত জীবনে ফারাক থাকতেই পারে। কিন্তু কোথাও গিয়ে খেলার প্রতি সাধনার ব্যাপারে দু’জনেই যেন একই সরলরেখায়।
সাধনা রয়েছে বলেই ক্রিকেট খেলাটাকে নিয়ে এখনও একই রকম আবেগপ্রবণ কোহলি। কখনও লং অনে আন্দ্রে রাসেলের ক্যাচ তালুবন্দি করে উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। এটা বুঝতে পেরে যে, বিপক্ষের সবচেয়ে দামী উইকেটটা তাঁদের দখলে চলে এসেছে। কখনও আবার আকাশ দীপ, শাহবাজ আহমেদরা উইকেট পেলে দূরে দাঁড়িয়েও এমন ভাবে লাফিয়ে উঠছেন যেন বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছেন। আউট হলে তেমনই হতাশায় মাথা নাড়তে দেখা গিয়েছে।
আবেগ বরাবরই কোহলির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আগে একটি বেশিই আগ্রাসী ছিলেন। এই কোহলি তার থেকে আলাদা। অতীতে আউট হওয়ার পর কলকাতার তৎকালীন অধিনায়ক গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে মাঠেই বাদানুবাদে জড়াতে দেখা গিয়েছে। দর্শকদের টিটকিরি শুনে দর্শকাসনের উদ্দেশে মধ্যমা দেখাতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। এখন তাঁর আগ্রাসন অনেক পরিমিত। দল উইকেট পেলে লাফালাফি করেন বটে, তবে তা কখনওই শালীনতার মাত্রা ছাড়ায় না। তিন বছর পর এশিয়া কাপে যখন শতরানের খরা কাটালেন, তখন মনে করা হয়েছিল লাফিয়ে উঠে তীব্র উচ্ছ্বাস করবেন। কোহলি কিছুই করেননি। গ্যালারির দিকে তাকিয়ে শুধুই হাসছিলেন। গলায় পরা বিয়ের হার বের করে একটা চুম্বন। ব্যস! উৎসব শেষ।
আসলে এই কোহলি অনেক আলাদা। জীবনের শেষ প্রান্তে কী ভাবে খেলাটা উপভোগ করে নিতে হয়, সেটা তিনি জানেন। যেমন টাইগার উডস। ৪৭ বছর পরেও নেমে পড়েছেন মাস্টার্স খেলতে। নেশা করে গাড়ি চালিয়ে হাজতে ঢুকেছেন, স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তিগত হাজারও সমস্যা কাটিয়ে আবার তিনি গলফ স্টিক হাতে সেই সবুজ ঘাসে ফিরেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে কোহলি অনেকটাই আলাদা উডসের চেয়ে। কিন্তু খেলার প্রতি আবেগ, সাধনা একই রকম। তাই সূর্যাস্তের আগে শেষ বেলাতেও দ্যুতি ছড়ানোর কাজটা করেই যাচ্ছেন।