FIFA World Cup 2022

কেউ কাজে লাগান গোল করতে, কেউ বল ফিরে পেতে! কর্নারের পিছনে জড়িয়ে কোন বিজ্ঞান?

ফুটবল এখন অনেক বেশি আধুনিক হয়ে গিয়েছে। সেখানে বল নিয়ন্ত্রণ যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, ততটাই গুরুত্ব রয়েছে ফ্রি-কিক বা কর্নার কিকের। কোন বিজ্ঞান জড়িয়ে রয়েছে এর পিছনে?

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১৩:৩৬
কর্নার নিচ্ছেন মেসি। আর্জেন্টিনার কর্নারে সব সময়েই থাকে বৈচিত্র।

কর্নার নিচ্ছেন মেসি। আর্জেন্টিনার কর্নারে সব সময়েই থাকে বৈচিত্র। ছবি: রয়টার্স

শুধু নিজেদের পায়ে বেশি ক্ষণ বল রাখা বা পাস খেলাই নয়, ফুটবল এখন অনেক বেশি আধুনিক হয়ে গিয়েছে। সেখানে বল নিয়ন্ত্রণ যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, ততটাই গুরুত্ব রয়েছে ফ্রি-কিক বা কর্নার কিকের। ফুটবলের পরিভাষায় একে বলে ‘ডেড বল সিচুয়েশন’। এখন বিশ্বের প্রায় সব দলেই ‘সেট পিস’ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যাঁদের কাজই হচ্ছে ‘সেট পিস’ থেকে কী করে গোল করা যায়, তার পথ দেখানো। শুরুটা হয়েছে ক্লাব ফুটবল থেকে। ধীরে ধীরে দেশের ফুটবলে তা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের মতো ক্লাবও আলাদা করে সেট পিস বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসছে। কর্নার কিক এখন নেহাতই খেলার একটা অঙ্গ নয়। তা হল গোল করার অন্যতম অস্ত্র।

কী ভাবে? একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে।

Advertisement

গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে খেলেছিল আর্জেন্টিনা। কর্নার নিতে দাঁড়িয়েছিলেন রদ্রিগো দি পল। প্রথম মনে করা হয়েছিল বক্সে বল ভাসাবেন। দি পল তা করেননি। পাস দেন লিয়োনেল মেসিকে। মেসি বল বাড়ান এনজ়ো ফের্নান্দেসকে। ফের্নান্দেস দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোল লক্ষ্য করে বাঁকানো শট নেন। মেক্সিকোর গোলরক্ষক গিয়েরমো ওচোয়াকে পরাস্ত করে বল জালে জড়িয়ে যায়। ওই গোল আর্জেন্টিনার জয় নিশ্চিত করে দেয়। অনেকেই ভেবেছিলেন, আর্জেন্টিনার এই গোল তাৎক্ষণিক বুদ্ধির জেরে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আর্জেন্টিনার ডাগআউটে বসে থাকা স্টুয়ার্ট রিড তা ভাবেননি। তিনি জানতেন, সেটি গোল হবেই।

ছোট কর্নার নিচ্ছেন এমবাপে।

ছোট কর্নার নিচ্ছেন এমবাপে। ছবি: রয়টার্স

রিড হলেন পেশায় সেট পিস বিশেষজ্ঞ। যুক্ত আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের সঙ্গে। হয়তো বিশ্বের সবার থেকে বেশি কর্নার কিক দেখেছেন তিনি। এক দিনেই কয়েক হাজার কর্নার কিক দেখেন। প্রতিটির ব্যাপারে আলাদা করে তথ্য লিখে নেন তাঁর নোটবুকে। পরে নিজের সুবিধা মতো সেগুলিকে নিজের দলের হয়ে কাজে লাগান। অবশ্যই তার মধ্যে নিজের বুদ্ধি মিশে থাকে। কোনওটি সফল হয়, কোনওটি হয় না। কিন্তু প্রচেষ্টা জারি থাকে অবিরাম। কী ভাবে কর্নার করতে হবে সেটা শেখানোই নয়, কর্নার আটকানোর প্রক্রিয়াও বাতলে দেন তিনি।

সাধারণত দু’ভাবে কর্নার আটকানোর চেষ্টা করে দলগুলি। সবচেয়ে সফল প্রক্রিয়া হল, একের বিরুদ্ধে এক। অর্থাৎ, বক্সে থাকা বিপক্ষের এক জন ফুটবলারকে আগলে রাখেন ডিফেন্ডার। তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকেন। অপর প্রক্রিয়াটি কিছুটা জটিল। এক জন ডিফেন্ডারকে পেনাল্টি বক্সের একটি নির্ধারিত এলাকা দেখিয়ে দেওয়া হয়। সেই এলাকার মধ্যে বল ভেসে এলে তিনি ক্লিয়ার করে দেবেন। এটি ‘জ়োনাল মার্কিং’ নামেই বেশি পরিচিত। তবে এখন অনেক দল দু’টি জিনিসই একসঙ্গে করে। তবে কোনও কোনও দেশ আবার নির্দিষ্ট একটি কাজ করতেই বিশ্বাসী। ব্রাজিল যেমন। তারা জ়োনাল মার্কিং করতে বেশি পছন্দ করে। কোনও কোনও সময় জ়োনাল মার্কিংয়ের জন্য ছ’জন ফুটবলারকে লাগিয়ে দেওয়া হয়।

ব্রাজিলকে যেটা বাকিদের থেকে আলাদা করে দেয়, তা হল তাদের আগ্রাসন। গোলকিপারের থেকে দূরে বল যাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে আগ্রাসী হয়ে দুর্গ রক্ষা করেন ব্রাজিলের ফুটবলাররা। বিশেষত বক্সের মাঝামাঝি এলাকায় তাঁরা যেন অপ্রতিরোধ্য। ব্রাজিলের ঠিক উল্টো কাজ করে আর্জেন্টিনা। তারা আবার ম্যান মার্কিংয়ে বেশি বিশ্বাসী।

ড্যানিশরা লম্বা হওয়ায় উচ্চতার সুবিধা নিয়ে বিপক্ষের বক্সে ভিড় বাড়িয়ে গোলকিপারকে চাপে রেখে দেন।

ড্যানিশরা লম্বা হওয়ায় উচ্চতার সুবিধা নিয়ে বিপক্ষের বক্সে ভিড় বাড়িয়ে গোলকিপারকে চাপে রেখে দেন। ছবি: রয়টার্স

লাতিন আমেরিকা ছেড়ে আসা যাক ইউরোপে। পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডসের কর্নার করা বা আটকানোর পদ্ধতি একে অপরের বিপরীত। পর্তুগিজরা কর্নারের সময় রক্ষণে ভিড় বাড়াতে ভালবাসেন। অর্থাৎ জ়োনাল মার্কিং। রক্ষণ আটকাতে বক্সে নেমে আসতে দেখা যায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকেও। নেদারল্যান্ডস আবার ঠিক উল্টো কাজ করে। সে দেশ হল টোটাল ফুটবলের জনক। এখানে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা দায়িত্ব রয়েছে। ফুটবলাররা নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করবেন, এমনটাই বিশ্বাস করে তারা। ডাচ দলগুলির কাছে কর্নার হচ্ছে ব্যক্তিগত লড়াই। বিপক্ষের প্রত্যেক ফুটবলারকে মার্ক করে রাখে তারা। দুই পোস্টে থাকেন আরও দু’জন।

ইউরোপীয় দলগুলির বেশির ভাগই খেলার চেষ্টা করে পাসিং ফুটবল। তাদের মাঠগুলিও সে রকম খেলার মতোই। অন্য দিকে লাতিন আমেরিকার সব মাঠ উন্নত নয়। একটু এবড়োখেবড়ো। ফলে তাদের ফুটবল শিল্প-নির্ভর। ইউরোপীয় ফুটবলের গতানুগতিকতা ছেড়ে একটু আলাদা ডেনমার্ক। সেট পিস বিশেষজ্ঞ রিড নিজে বহু দিন কাজ করেছেন ডেনমার্কে। যে হেতু তাঁরা লম্বা, তাই উচ্চতার সুবিধা নিয়ে বিপক্ষের বক্সে ভিড় বাড়িয়ে গোলকিপারকে চাপে রেখে দেন। বিপক্ষ গোলকিপার এগিয়ে এসে যাতে বল কাড়তে না পারেন, সেই চেষ্টা করেন তাঁরা। সে দেশের ঘরোয়া লিগে অর্ধেক ম্যাচেই এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। গোল বাঁচানোর ক্ষেত্রেও তাঁরা ভিড় বাড়িয়ে নিজেদের গোলকিপারের ভূমিকা কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

কর্নার কিন্তু গোল করার অন্যতম অস্ত্র নয়। বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন, প্রতি ৯টি কর্নারের একটিতে গোল করার সুযোগ তৈরি হয়। গোল হওয়া তো দূরের কথা। স্পেনের মতো দল তো কর্নার থেকে গোল করার ভাবনা থেকেই সরে এসেছে। ইউরোপের এই দলটি বেশি নির্ভর করে পাসিং ফুটবলের উপরে। বিশ্বকাপ এবং দু’বার ইউরো কাপ জিতেছে সেই কৌশলে। এ বারের কোচ লুই এনরিকে অন্য ধরনের পাসিং ফুটবল খেলাচ্ছেন দলকে, যা আরও বিধ্বংসী। মাঠের প্রতিটি অংশে যাতে তাঁর ফুটবলাররা দাপট দেখান, সেটা নিশ্চিত করেছেন তিনি। ফলে ছোট কর্নার নিয়ে খেলা শুরু করার যে কৌশল তাদের আগেও ছিল, এখনও রয়েছে।

স্পেনের ক্লাবগুলি মনে করে, কর্নার থেকে গোলটা মূল কথা নয়। আসল কথা হল, বলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া। আবার যাতে নিজেদের দখলে বল রেখে খেলা শুরু করা যায় এবং গোলের মুখ খুঁজে পাওয়া যায়, সেটাই চেষ্টা করেন তাঁরা। গত বারের লা লিগায় সবচেয়ে বেশি শর্ট কর্নার নেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ, কোনও দলের কাছে কর্নার গোল করার অস্ত্র, আবার কোনও দলের কাছে বল নিয়ন্ত্রণ করার। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, কর্নার এখন গোল করার অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন
Advertisement