ভালবাসা: এরিকসেনের জন্য এ ভাবেই সমর্থন থাকবে গ্যালারিতে। ফাইল চিত্র।
১৯৮৪ সালে ডেনমার্ক যখন ইউরো সেমিফাইনালে খেলেছিল, তখন এই পৃথিবীতে আসিনি আমি। আর ১৯৯২ সালে ডেনমার্কের ইউরোপ সেরা হওয়ার বছরে আমার বয়স ছিল মাত্র দু’বছর।
তাই আমার প্রজন্মের কাছে বুধবারের রাতটা হতে চলেছে একটা বিশেষ রাত। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে জিতলে সেটা হবে সিংহের গুহায় ঢুকে সিংহ শিকারের মতোই ব্যাপার। আর যদি শেষপর্যন্ত ইউরো থেকে বিদায় নিতে হয়, তা হলেও গর্বে মাথা উঁচু করেই দেশে ফিরবে থোমাস ডিলানিরা।
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হলেও, ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহাগেনেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ফুটবলের তালিম নেওয়া ও সেখানকার ক্লাবে খেলা। এখনও সেখানে আমার বাবা-মা থাকেন। ছুটি পেলেই আমি উড়ে যাই সেখানে। তাই বাংলাদেশের বাইরে ডেনমার্ক হল আমার আর একটি দেশ।
ডেনমার্কের বর্তমান ফুটবল সম্পর্কে ধারণার ভিত্তিতেই বলছি, ইংল্যান্ড কিন্তু খুব সহজে ম্যাচটা জিতে ফাইনালে যেতে পারবে না। মানছি, ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ইংল্যান্ড আমাদের চেয়ে ছ’ধাপ এগিয়ে রয়েছে। ইংল্যান্ডের এই মুহূর্তে রয়েছে চার নম্বরে। সেখানে ডেনমার্কের অবস্থান ১০ নম্বরে। বিশ্বের প্রথম দশ ফুটবল খেলিয়ে দেশের মধ্যে থাকাটাও কিন্তু এক দিনে সম্ভব হয়নি। কোচ ক্যাসপার হিউলমান্ড অনেক পরিশ্রম করে দলটাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। ফলে হ্যারি কেনদের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে ডেনমার্ক যে কোনও হীনমন্যতায় ভুগবে না, তা হলফ করে বলতে পারি।
এটা ঠিক যে সেমিফাইনালে ধারে ও ভারে ইংল্যান্ডই ফেভারিট। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলস ও কোয়ার্টার ফাইনালে চেক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ডোলবার্গরা ফেভারিট হিসেবে মাঠে নেমেছিল। এ বার ওরাই সেমিফাইনাল ম্যাচে আন্ডারডগ। তবে এই তকমা ডেনমার্কের কাছে নতুন নয়। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ বা ১৯৯২ সালের ইউরোতেও ডেনমার্ক এ রকম আন্ডারডগ হিসেবে খেলেই ইতিহাস তৈরি করেছিল।
ইংল্যান্ড মাথায় রাখবে উয়েফা নেশনস লিগে গত বছর দুই পর্বে আমাদের হারাতে পারেনি। কোপেনহাগেনে প্রথম ম্যাচ ড্র হয়েছিল। তার পরে এই ওয়েম্বলিতে গিয়েই ইংল্যান্ডকে ১-০ হারিয়ে এসেছিল ডেনমার্ক। গোলটা করেছিল ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন।
সেমিফাইনালে এরিকসেন যদি থাকত, তা হলে দলটা আরও শক্তিশালী হত, তা এখনই বলে দেওয়া যায়। তবে বুধবার রাতে গোটা ডেনমার্ক দলের কাছেই এরিকসেন একটা প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। এমনিতেই জাতীয় দলে অসম্ভব জনপ্রিয় ক্রিশ্চিয়ান। এ বারের ইউরো স্মরণীয় করে ওকে দুর্দান্ত জয় উপহার দিতে মরিয়া থাকবে আমার সঙ্গে ডেনমার্কের ক্লাবে একদা খেলা থোমাস ডিলানি, ড্যানিয়েল ওয়াসরা। মনে আছে, এই ডিলানি, আমি আর একজন গোলকিপার একসঙ্গে পেশাদার ফুটবলার ঘোষিত হয়েছিলাম। কোয়ার্টার ফাইনালে আমার বন্ধু প্রথম গোল করেছিল। প্রার্থনা করব, কোচ যদি খেলান ওদের, তা হলে আমার দুই বন্ধু যেন স্মরণীয় পারফরম্যান্স করে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়ে। ডেনমার্ক রক্ষণে আন্দ্রেয়াস ক্রিস্টেনসেন, সিমন কেয়রদের ম্যান মার্কিং, কভারিং, ব্লকিং ফাঁকি দেওয়া কিন্তু মুশকিল। এমিল হোয়বার্গ টটেনহ্যামে একই সঙ্গে খেলে হ্যারি কেনের সঙ্গে। ফলে ওর থেকে ইংল্যান্ড অধিনায়ককে নিষ্ক্রিয় করার ব্যাপারে দল অনেক পরামর্শ পাচ্ছে, তা খবরের কাগজ পড়েই জেনেছি। মনে হয় না কোচ হিউলম্যান্ড দলে খুব বদল আনবেন এই ম্যাচে।
এই মুহূর্তে গোটা ডেনমার্ক উত্তেজনায় ফুটছে। সেখানে বন্ধুদের ফোন করলে ওরা ফিফা ক্রমপর্যায়, ইংল্যান্ডের তারকাদের গুরুত্ব না দিয়ে বলছে, ‘‘কাপ আসবে ডেনমার্কেই। ইংল্যান্ড আমাদের হারাতে পারবে না।’’ এই কথাগুলোয় যেমন আবেগ আছে, তেমনই আছে জাতীয় দলের প্রতি আস্থা। হারের ভয় কেউ পাচ্ছে না। বরং প্রত্যেকেই বুধবার সকালে বাড়ির সামনে জাতীয় পতাকা টাঙিয়ে উৎসবের প্রস্তুতি নেবে।
করোনা সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তার জন্য ওয়েম্বলির গ্যালারিতে ডেনমার্ক সমর্থকেরা উড়ে যেতে পারবেন না সুরক্ষাজনিত কারণে। ফলে শহরের নানা জায়গায় বিশাল পর্দা টাঙিয়ে খেলা দেখবেন তাঁরা। দল জিতলেই শুরু হবে উৎসব। তারই প্রহর গুনছে ডেনমার্কের মানুষ।
(লেখক বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়ক। সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন)