বাংলার অনুশীলনে অভিমন্যু ঈশ্বরণের সঙ্গে কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্ল। ছবি: সিএবি।
বাংলা যে বার রঞ্জি ট্রফি জিতেছিল, মনোজ তিওয়ারির বয়স তখন চার বছর। শুক্রবার তিনি নামবেন কেরিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলতে। বাংলার হয়ে রঞ্জি জয়ের স্বপ্ন তাঁর অধরাই রইল। কেরলের বিরুদ্ধে হেরে রঞ্জি থেকে বাংলা বিদায় নেওয়ার পর থেকেই আঙুল উঠতে শুরু করেছে বাংলার ‘সাপ্লাই লাইন’-এর দিকে। অর্থাৎ, বয়সভিত্তিক খেলায় বাংলার পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সেখান থেকে ক্রিকেটার উঠে না আসা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
গত বছর বাংলা রঞ্জির ফাইনাল খেলেছিল। এই বছর এক ম্যাচ বাকি থাকতেই গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হল। এমন অবস্থার কারণ কী? বাংলার বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে অনূর্ধ্ব-১৬ দলের কোচ অরিন্দম দাস, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ সঞ্জীব সান্যাল এবং অনূর্ধ্ব-২৩ দলের কোচ প্রণব রায়। বাংলার ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব তাঁদের হাতেই। সিনিয়র দলে ক্রিকেটার প্রয়োজন হলে তো বয়সভিত্তিক দলগুলিই ভাঁড়ার হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু সেই ভাঁড়ারঘরে কেন সমস্যা হচ্ছে?
বাংলার ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মতে সমস্যা ক্রিকেটারদের নিয়ে নয়। বাংলায় প্রতিভার অভাব নেই। কিন্তু তাঁদের খুঁজে নেওয়ার প্রক্রিয়াতে গলদ চোখে পড়ছে অনেকের। স্কুল ক্রিকেট খেলা হয় কোথায়? যে মাঠে সেই সব ম্যাচ হয়, সেগুলি কতটা খেলার উপযোগী? ক্লাব ক্রিকেটে খেলোয়াড়দের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এক প্রাক্তন ক্রিকেটার বললেন, “ব্যাঙের ছাতার মতো ক্রিকেট কোচিং সেন্টার গজিয়ে উঠছে বাংলায়। কিন্তু সেখানে যে সব কোচেরা খেলা শেখান তাঁরা কি আদৌ যোগ্য? বেশির ভাগের কোচিং ডিগ্রি নেই। না তাঁরা অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। বড় বড় ক্রিকেটারের নামে কোচিং সেন্টার চলছে। আর বাবা-মায়েরা টাকা ঢালছেন। ছেলেমেয়েরা কী শিখছে? আদৌ কিছু শিখছে কি না তা জানা নেই।”
বাংলার বয়সভিত্তিক দলগুলির এই মরসুমে অবস্থাটা দেখে নেওয়া যাক। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ ছিলেন দেবাং গান্ধী। কিন্তু প্রতিযোগিতা শুরুর ১৫ দিন আগে তিনি হঠাৎ দায়িত্ব ছেড়ে দেন। সেই জায়গায় তাঁর সহকারী সঞ্জীবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনিই দলের একমাত্র কোচ। বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং সব কিছুর প্রশিক্ষণ দেন তিনিই। সেই সঞ্জীবের হাত ধরে বাংলার অনূর্ধ্ব-১৯ দল কুচবিহার ট্রফিতে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে। সেখানে পঞ্জাবের বিরুদ্ধে হেরে যায়। যদিও সব ধরনের বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এটাই বাংলার সেরা সাফল্য। বাংলার অনূর্ধ্ব-১৬ দল বিনু মাঁকড় ট্রফিতে মাত্র দু’টি ম্যাচ জিতেছে। সেটার মধ্যে একটি আবার মেঘালয়ের বিরুদ্ধে। দিল্লি, মহারাষ্ট্র এবং হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে হেরে যায় বাংলা। অনূর্ধ্ব-২৩ দলের অবস্থাও খুব ভাল নয়। সেখানে বাংলা এখনও পর্যন্ত একটি ম্যাচও জিততে পারেনি। বিদর্ভের সঙ্গে গ্রুপ পর্বের ম্যাচ বাকি। নক আউটে ওঠার কোনও সম্ভাবনা নেই।
সিনিয়র দলকে সামলানোর কাজটা যে কোনও কোচের কাছেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্টের মতো। মনোজ তিওয়ারি, অনুষ্টুপ মজুমদারদের তো আর ক্রিকেট খেলা শেখানোর প্রয়োজন হয় না। সেটা প্রয়োজন হয় তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য। সেখানেই গন্ডগোল হচ্ছে বলে অভিযোগ। তবে শুধু কোচিং সেন্টারগুলি দোষ দিলে মুশকিল। কারণ প্রতিভা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বাংলার প্রধান শক্তি এখন অভিমন্যু ঈশ্বরণ, মুকেশ কুমার, আকাশ দীপ এবং শাহবাজ় আহমেদ। এই চার ক্রিকেটারই ভারতীয় দলে ঢোকার দাবিদার। মুকেশ এবং আকাশ এখন টেস্ট দলের সদস্য। বাকি দু’জনও নির্বাচকদের নজরে রয়েছেন। কিন্তু এই চার জনের আরও একটি মিল রয়েছে। এঁরা কেউই বাংলার ভূমিপুত্র নন।
অন্য রাজ্য থেকে ক্রিকেটারেরা বাংলায় আসছেন। ক্লাব ক্রিকেট খেলছেন। বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতাও খেলছেন। সেখান থেকে বাংলার নির্বাচকদের নজর কেড়ে জায়গা করে নিচ্ছেন সিনিয়র দলেও। আর পিছিয়ে পড়ছেন ভূমিপুত্রেরা। কিন্তু এই অভিযোগ তো নতুন নয়। বাংলার হয়ে বহু যুগ ধরে অন্য রাজ্যের ক্রিকেটারেরা খেলেছেন। তাঁরা সফলও হয়েছেন। আবার ঋদ্ধিমান সাহা, সুদীপ চট্টোপাধ্যায়েরা বাংলা ছেড়ে চলে গিয়েছেন অন্য রাজ্যের হয়ে খেলতে। কিন্তু বাংলার ভূমিপুত্রেরা যদি সিনিয়র দলে না খেলতে পারেন, তা হলে আগামী দিনে ভারতীয় দলের হয়েও বাঙালি ক্রিকেটার দেখা যাবে না। খবরের শিরোনামে বার বার লিখতে হবে ‘বাংলার ক্রিকেটার’, তাঁরা ‘বাঙালি’ হয়ে উঠতে পারবেন না।
সমস্যা রয়েছে মাঠেও। ক্লাব ক্রিকেটে একাধিক ম্যাচে ২০০ রানের গণ্ডি পার করতে পারছেন না ব্যাটারেরা। সেখানে অনেক প্রতিভাবান ব্যাটারেরা খেললেও রান আসছে না। আঙুল উঠছে পিচের দিকে। বাংলার ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তি বলছেন, “যে সব পিচে খেলা হচ্ছে, তা ক্রিকেট ম্যাচের উপযোগী নয়। ব্যাটারেরা রান করবে কী করে? আর ব্যাটে রান না থাকলে ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি হয় না। সেটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।” অভিজ্ঞদের মতে, পিচ খারাপ হলে বোলারেরা তবুও মানিয়ে নেয়। ব্যাটারদের জন্য প্রচণ্ড সমস্যা হয়ে যায় উইকেট ঠিক মতো তৈরি না হলে।
পাল্টা যুক্তিও আছে। পিচ তৈরি করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বৃষ্টি। বাংলায় আগে বৃষ্টি শেষ হয়ে যেত অগস্ট মাস নাগাদ। এখন অক্টোবরেও বৃষ্টি হচ্ছে। ফলে পিচ তৈরি করার সময় পাওয়া যাচ্ছে না ঠিক মতো। সেই সমস্যার ফল ভুগতে হচ্ছে তরুণ ক্রিকেটারদের। অনুশীলন করার সময় পাচ্ছেন না। সব জায়গায় তো আর ইন্ডোর অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকে না। আর ইন্ডোর ক্রিকেট খেলে পুরোপুরি অনুশীলন নেওয়া সম্ভবও নয়।
আঙুল উঠছে বাংলার ক্রিকেট সংস্থার দিকেও। ‘নিন্দক’দের প্রশ্ন ৩০-৪০ লক্ষ টাকা খরচ করে বাংলার সিনিয়র দলের জন্য ব্যাটিং পরামর্শদাতা আনা হয়। কিন্তু সেই ডব্লিউ ভি রামন ক’টা দিন দলের সঙ্গে থাকেন? তিনি তো ব্যস্ত ধারাভাষ্য দিতে। বাংলার ক্রিকেটে এমন এক জনকে এনে কী লাভ যিনি নিজের পুরো সময়টা দেবেন না। রামনের সঙ্গে চুক্তি হয় কয়েক দিনের জন্য। তাতে বাংলার ব্যাটারদের কতটা লাভ হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
কথা উঠছে বাংলার ক্রিকেট সংস্থায় ভোট না হওয়া নিয়েও। এই বছরই ভোট হয়নি। তাতে সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে মত অনেকের। বলা হচ্ছে, সংস্থায় এমন ব্যক্তিদের প্রাধান্য বাড়ছে, যাঁদের বাংলার ক্রিকেটের উন্নতির দিকে মন নেই। সমস্ত কাজই হচ্ছে লোকদেখানো। ভিতরে কাজের কাজটা হচ্ছে না। একে অপরের পিঠ চাপড়ে লাভের গুড় খেয়ে যাওয়ার অভিযোগও উঠছে। এক প্রাক্তন ক্রিকেটার বললেন, “ক্রিকেটার বা কোচেদের উপর ব্যর্থতার দায় ঠেলে হাত ধুয়ে ফেললে আগামী দিনে বাংলার ক্রিকেটের হাল আরও খারাপ হবে। সমস্যার কোনও শেষ নেই। প্রতিটা পর্যায় সমস্যা রয়েছে। পদ্ধতিতে বদল আনা প্রয়োজন। না হলে ক্রিকেটার, কোচ বদলাবে সমস্যাগুলো থেকেই যাবে।”
অভিযোগ উঠছে বাংলার দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্রিকেট নিয়ে। সেখানে দুর্নীতি হচ্ছে। যার ফলে ভাল ক্রিকেটার উঠে আসছে না। প্রতিভাবানেরা সুযোগ পাচ্ছেন না। সুযোগ পাচ্ছেন সেই সব ক্রিকেটারেরা যাঁদের পকেটের জোর রয়েছে। বাংলার ক্রিকেটের এক শুভাকাঙ্ক্ষী বললেন, “এক সময় বাংলা থেকে বহু ক্রিকেটার ভারতের হয়ে খেলেছেন। সেই সব বাঙালি ক্রিকেটারদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বাংলা ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গঙ্গোপাধ্যায়, সাহা, রায়, বসুরা। যে ভাবে বাংলা ক্রিকেট চলছে তাতে এই ছবি খুব দ্রুত বদলাবে বলেও মনে হচ্ছে না।”