বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শতরান করেন ঋষভ পন্থ এবং শুভমন গিল। ছবি: পিটিআই।
চেন্নাইয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে শতরান করেছেন শুভমন গিল এবং ঋষভ পন্থ। এই দু’টি শতরানের ইনিংস ভারতকে শুধু একটি টেস্ট ম্যাচ জিতিয়েছে, তা নয়। এই দু’টি শতরানের তাৎপর্য অনেক গভীরে। আগামী সাড়ে তিন মাসে ন’টি টেস্ট খেলতে হবে রোহিত শর্মাদের। কোচ গৌতম গম্ভীর এবং অধিনায়ক রোহিতকে স্বস্তি দেবে পন্থ এবং শুভমনের এই শতরান দু’টি।
শুভমন এবং পন্থের শতরানের আগেই ভারত ম্যাচের রাশ নিয়ে নিয়েছিল নিজেদের হাতে। পন্থ ১০৯ রান করেন। শুভমন অপরাজিত থাকেন ১১৯ রানে। পন্থ, শুভমনের এই শতরান গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কারণে।
নতুন জুটি
পন্থের টেস্ট অভিষেক হয় ছ’বছর আগে। শুভমন প্রথম টেস্ট খেলেন চার বছর আগে। কিন্তু চেন্নাই টেস্টের আগে কখনও এই দুই ভারতীয় ব্যাটার একসঙ্গে ভারতের হয়ে ক্রিজ়ে জুটি বাঁধেননি। প্রথম বার জুটি বেঁধেই সফল পন্থ এবং শুভমন। তাঁরা জুটিতে ১৬৭ রান তোলেন।
স্থায়ী দল
পন্থ এবং শুভমনের জায়গা দলে মোটামুটি পাকা থাকলেও কিছু প্রশ্ন ছিল। শুভমনকে প্রমাণ করতে হত যে ভারতের হয়ে টেস্টে তিন নম্বর জায়গাটা তাঁরই। প্রথম ইনিংসে রান পাননি। তাই দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁকে রান করতেই হত। রান না পেলে তাঁকে এখনই হয়তো দল থেকে বাদ পড়তে হত না, তবে নিশ্চিত ভাবেই সমালোচনা শুনতে হত। অন্য দিকে পন্থ ৬৩২ দিন পর টেস্টে ফিরেছিলেন। লাল বলের ক্রিকেটে তিনি যে ভাবে খেলতেন, প্রত্যাবর্তনেও সেই ধারা বজায় রাখার একটা লক্ষ্য ছিল তাঁর। তিনি যে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলতে ভুলে যাননি, সেটা দেখানো প্রয়োজন ছিল। পন্থ সেটাই দেখালেন। ১২৮ বলে ১০৯ রানের ইনিংস সেটাই প্রমাণ করল। সঙ্গে চারটি ছক্কা এবং ১৩টি চার।
আক্রমণাত্মক তিন নম্বর
শুভমনের আগে ভারতের হয় তিন নম্বরে খেলতে দেখা গিয়েছিল চেতেশ্বর পুজারাকে। তার আগে খেলতেন রাহুল দ্রাবিড়। ভারতের প্রাক্তন কোচ এবং পুজারা ধরে খেলতে পছন্দ করতেন। দ্রুত রান তোলার দিকে যেতেন না তাঁরা। শুভমন তেমন নন। তিনি স্ট্রোক খেলতে পছন্দ করেন। আর সেই কারণেই ভারতের তিন নম্বরে তাঁকে মেনে নিতে এখনও অনেকের সমস্যা হয়। তবে এখন টেস্ট ক্রিকেট যে ভাবে খেলা হচ্ছে, তাতে শুভমনের মতো ক্রিকেটারকে তিন নম্বরে প্রয়োজন। দ্রুত উইকেট চলে গেলে যিনি পাল্টা মারতে পারেন, বিপক্ষকে চাপে ফেলে দিতে পারেন। যেমন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে রোহিতের উইকেট হারানোর পর শুভমন নেমেই বাংলাদেশের উপর চাপ তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। সঙ্গী হয়েছিলেন পন্থ। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “শুভমন সব ধরনের ক্রিকেটে খেলতে পারে। ওর মতো ব্যাটার খুব কম আছে। তবে নিয়মিত রান পেতে হবে ওকে। প্রথম ইনিংসে রান পায়নি। দ্বিতীয় ইনিংসে বুঝিয়ে দিল কেন তিন নম্বরে দল ওর উপরেই ভরসা রাখছে।”
উন্নত শুভমন
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শুভমনের করা ১১৯ রানের মধ্যে ৭২ রান এসেছে স্পিনারদের বলে। পেসারদের বিরুদ্ধে শুভমন ভাল, কিন্তু আরও উন্নতি প্রয়োজন। বিশেষ করে আগামী দিনে যখন তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার পিচে প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টার্কের মতো পেসারদের সামলাতে হবে, তখন উন্নতি অবশ্যই দরকার। তবে স্পিনারদের বিরুদ্ধে শুভমন অনেক সাবলীল। তিনি বলেন, “রান করতে পারলে তো আত্মবিশ্বাস অবশ্যই পাওয়া যায়। আমি সেই কাজটাই করার চেষ্টা করছি। স্বস্তিও পাচ্ছি। এই সিরিজ়ের আগে আমি বিশেষ কিছু অনুশীলন করি। যা পরিকল্পনা করেছিলাম, সেটা মাঠে করতে পেরেছি। রক্ষণ ভাল রাখতে হবে, সেই সঙ্গে সুযোগ বুঝে রানও করতে হবে। এটাই আমার মন্ত্র। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে রান করেছিলাম। সেটাই আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। অনেক দিন পর এই আত্মবিশ্বাসটা পেয়েছি। যে জায়গায় ব্যাট করি, সেখানে এটা প্রয়োজন।” বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “শুভমনের ডিফেন্স আগের থেকে উন্নতি করেছে। পায়ের পাতার উপর শরীরের ওজনটা নিয়ে এসে দারুণ ভাবে স্পিনারদের খেলছিল। এর ফলে বলের সঙ্গে ব্যাটটা ঠিকঠাক লাগছিল।”
নিজের জন্য পন্থ
দেশের হয়ে টেস্টে ছ’টি শতরান করলেন পন্থ। এর আগের পাঁচটি শতরান এমন সময় করেছিলেন, যখন দল বেকায়দায়। পন্থ সেই সময় রান না করলে ম্যাচ হারতে পারত ভারত। ৯০-৯৯ রানের মধ্যের ইনিংসগুলিও এসেছিল কঠিন সময়ে। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পন্থ রান না করলেও ভারত খুব বেকায়দায় পড়ত না। কারণ দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নামার আগেই ভারতের ঝুলিতে ২২৭ রান ছিল। পন্থের এই শতরান দরকার ছিল নিজের জন্য। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গাড়ি দুর্ঘটনা। তার পর থেকে ক্রিকেটের বাইরে। এই বছর প্রথমে আইপিএলে ফেরা। তার পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং এখন টেস্ট জার্সি। একের পর এক প্রত্যাবর্তন এবং অবাক হওয়ার পালা। সেই প্রত্যাবর্তনের মুকুটে সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্নটি মনে হয় টেস্ট শতরানটি। যে শতরান তাঁকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিল। এবং সেই আত্মবিশ্বাস এতটাই যে, ব্যাট করার সময় বাংলাদেশের ফিল্ডিং সাজিয়ে দিতেও দু’বার ভাবেন না পন্থ। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক মনোজ বললেন, “পন্থ এক জনই। অন্য কারও পক্ষে সেই জায়গা নেওয়া সম্ভব নয়। এত দিন যে টেস্ট খেলেনি, সেটা বোঝাই গেল না। ও যে ধরনের শট খেলতে পারে, তা অন্য কারও পক্ষে খেলা সম্ভব নয়।”
উইকেটরক্ষকের জায়গা পাকা
গত ২২ মাসে টেস্টে চার জন উইকেটরক্ষককে খেলিয়েছে ভারত। শ্রীকর ভরত, ঈশান কিশন, লোকেশ রাহুল এবং ধ্রুব জুরেল। তাঁরা সকলেই নিজেদের জায়গা পাকা করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পন্থ হয়ে উঠতে পারেননি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তিনি ফিরেই বুঝিয়ে দিলেন যে, পন্থ হয়ে ওঠা যায় না। তাঁর মতো ইনিংস ইচ্ছা করলেই খেলা যায় না। পন্থ যে ভাবে বিপক্ষের উপর চেপে বসতে পারেন, সেটা বাকি উইকেটরক্ষকেরা করতে পারেননি। সম্বরণ বলেন, “ঋষভ খেলাটাকে উপভোগ করে। সেই কারণেই ওই রকম ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার পর ফিরে এসে এই রকম ইনিংস খেলতে পারল। দেখে মনেই হল না কোনও চাপ আছে। আগামী চার-পাঁচ বছর ভারতীয় ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাবে শুভমন এবং পন্থ।”
পন্থ এবং শুভমনের ইনিংস অনেকগুলি জায়গায় স্বস্তি দিয়ে গেল রোহিত এবং গম্ভীরকে। আগামী দিনে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা রান না পেলেও পন্থ এবং শুভমনের উপর ভরসা রাখতেই পারে ভারত।