বিরাটের পরিশ্রম দেখে অবাক হয়েছেন সরফরাজ।
রঞ্জি ফাইনালে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে শতরান করেই একটা লাফ দিলেন সরফরাজ খান। এই ভারী শরীর নিয়ে এমন লাফ দেওয়া সম্ভব! সরফরাজ দেখাচ্ছেন সম্ভব।
ওজন বেশি বলে সরফরাজকে কখনও ডাকা হয় ‘গোলুমোলু’, কখনও ‘পান্ডা’। রঞ্জি খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে তাঁর ওজন সব থেকে বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমন একজন ক্রিকেটার শুধু এ বারের রঞ্জিতেই ৯০০-র উপর রান করেছেন। ২০১৯-২০ মরসুমের পর আবার রঞ্জিতে ৯০০-র উপর রান করলেন সরফরাজ। ধারাবাহিক ভাবে রান করে চলেছেন তিনি। তা হলে ওজন কি কোনও পার্থক্য তৈরি করে না?
ছোটবেলা থেকে মুম্বইয়ের আজাদ ময়দানে সরফরাজকে অনুশীলন করতে দেখছেন দীনেশ লাড। রোহিত শর্মার ছোটবেলার কোচ দীনেশ। তিনি দেখেছেন সরফরাজ এবং তাঁর বাবা নওশাদ খানের লড়াই। আনন্দবাজার অনলাইনকে দীনেশ বললেন, “সরফরাজের বাবা ওর জন্য খুব পরিশ্রম করেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অনুশীলন করত ওরা। নওশাদই ওর কোচ। প্রচুর বোলার নিয়ে আসতেন নওশাদ। সারা দিন ধরে চলত অনুশীলন। স্কুল ক্রিকেটেও প্রচুর রান করেছে সরফরাজ। রঞ্জিতেও করছে। এই ভাবে ব্যাট করলে আর সিক্স প্যাকের কী প্রয়োজন? সারা দিন ব্যাট করার ক্ষমতা রয়েছে ওর। ক্রিকেটীয় শট খেলে রান করছে। দুই উইকেটের মাঝে ভাল দৌড়চ্ছে। ফিটনেস আছে বলেই তো পারছে। আর কী চাই?”
একই সুর বাংলার কোচ অরুণ লালের গলাতেও। বাংলার ক্রিকেটারদের ফিটনেসের দিকে নজর রাখেন অরুণ। তিনি মনে করেন ক্রিকেটে ফিট হওয়া খুব জরুরি। কিন্তু সেটার সঙ্গে ওজনের সম্পর্ক খুব একটা নেই। অরুণ বললেন, “ফিটনেস খুব প্রয়োজন। তার মানে এই নয় যে কেউ রোগা মানেই সে ফিট। ওজনের সঙ্গে ফিটনেসের সম্পর্ক খুব কম। অনেক মানুষ আছেন যাঁদের ওজন বেশি, কিন্তু তাঁরা ফিট। আমি মনে করি ক্রিকেটে লাল বলে খেলতে হলে ওজন একটু বেশি থাকা প্রয়োজন। ভাল করে খেতে হবে, অনুশীলন করতে হবে, ঘুমোতে হবে ফিট থাকার জন্য।”
সরফরাজ নিজেও মনে করেন খাওয়াদাওয়ার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। সেই কারণে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের হয়ে খেলার সময় তিনি নজর রাখতেন বিরাট কোহলী কী খান। ২০২০ সালের এক সাক্ষাৎকারে সরফরাজ বলেন, “আমার পাশের ঘরটাই ছিল বিরাট ভাইয়ের। অবাক হয়ে ভাবতাম, ও কী খায় যে এত ফিট। রাতের বেলা ওর ঘরের বাইরে রাখা প্লেটে দেখতে যেতাম যে কী খায়। রোজই দেখতাম রয়েছে গ্রিলড ফিস, বাসা ফিস। ২০১৪ সালে বিরাটকে আমি গ্রিলড চিকেন খেতে দেখেছি। পরের বছর গ্রিলড ল্যাম্ব খেতে দেখেছি। খাওয়াদাওয়া নিয়ে খুব সচেতন বিরাট।” এখন বিরাট আমিষ খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর খাদ্যতালিকায় থাকে ডাল, সব্জি, বাদামের দুধের মতো খাবার।
এখন ভারতীয় দলের ক্রিকেটার মানেই চাপা চোয়াল, গাল ভর্তি দাড়ি, মেদহীন, পেটানো চেহারা। বিরাট কোহলী, হার্দিক পাণ্ড্য, শ্রেয়স আয়ার, সূর্যকুমার যাদবরা জিম করে, খাওয়াদাওয়ার নিয়ন্ত্রণ করে এমন শরীর তৈরি করেছেন। সেখানে সরফরাজ সম্পূর্ণ উল্টো মেরুতে। তাঁর শরীরে মেদ স্পষ্ট। ফোলা ফোলা গালগুলো প্রশ্ন তোলে, তাঁর চেহারা ক্রিকেটার সুলভ কি না। সেই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়েও রান করে চলেছেন সরফরাজ। ধারাবাহিক ভাবে রান করছেন তিনি।
অরুণ লাল মনে করেন একজন ক্রিকেটারের ফিটনেস তাঁর ওজনের থেকেও অনেক বেশি নির্ভর করে মানসিক কাঠিন্যর উপর। তিনি বলেন, “ক্রিকেট অনেক বেশি মানসিক লড়াই। এর জন্য সিক্স প্যাক প্রয়োজন নেই। বিরাট অন্য ধাতুর। সকলে সেটা হতে পারবে না। ও খুব ফিট, খুব শক্তিশালী। কিন্তু ক্রিকেট খেলার জন্য সবার আগে দরকার মানসিক জোর। ফিটনেস অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু ফিটনেস থাকলেই যে কেউ রান করে দেবে এমনটা নয়। আমরা যে অনুশীলন করি সেটা আমাদের মানসিক ভাবে শক্তিশালী করে। আমরা যখন ২০ কিলোমিটার দৌড়তে বলি, তখন সেটা শুধু শারীরিক ভাবে ফিট করে না, মানসিক ভাবেও কঠিন করে দেয়। সেটাই প্রয়োজন ক্রিকেটে।”
মানসিক ভাবে সরফরাজ লড়াকু। মাত্র ১২ বছর বয়সে সচিন তেন্ডুলকরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। হ্যারিস শিল্ডে ৪৩৯ রান করেন সরফরাজ। তাঁর সেই ৪২১ বলের ইনিংসে ছিল ৫৬টি চার এবং ১২টি ছক্কা। হ্যারিস শিল্ডে সচিন একটি ইনিংসে করেছিলেন ৩৪৬ রান। সেই রেকর্ড ভাঙাই ছিল সরফরাজের লক্ষ্য। এমন একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বয়স ভাঁড়ানোর।
২০১১ সালে অস্থি-মজ্জা পরীক্ষা করে দেখা যায় তাঁর বয়স ১৫ বছর। কিন্তু মুম্বই ক্রিকেট সংস্থায় তাঁর বয়সের নথি অনুযায়ী সেই সময় তাঁর বয়স ১৩ বছর। মানতে চাননি সরফরাজের বাবা। লড়াই চালিয়ে যান তিনি। আধুনিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায় তাঁর বয়স মুম্বই ক্রিকেট সংস্থায় জমা দেওয়া নথি অনুযায়ীই ঠিক। কিন্তু এই ঘটনা মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত করে দেয় সরফরাজকে। বেশ কয়েক মাস সময় লাগে তাঁর ক্রিকেটে মনোযোগ ফেরাতে। সরফরাজ বলেন, “বাবা বার বার বলত ক্রিকেট থেকে মন সরে যাচ্ছে। মারও খেয়েছি বাবার কাছে।” মনোযোগ ফিরল। এমন ভাবেই ফিরল যে দুটো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেললেন ভারতের হয়ে। ২০১৬ সালে কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসাবে আইপিএল খেললেন, তাও আবার বিরাটের দলে। এরপর পঞ্জাব কিংসের হয়ে খেলেছেন। এখন খেলেন দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে।
এই ভারী শরীর নিয়েও বিরাট কোহলী, এবি ডিভিলিয়ার্স, ক্রিস গেলের মতো তারকাদের সঙ্গে সাজঘর ভাগ করে নিতে পেরেছেন কারণ তাঁর ব্যাট কথা বলে। ডিভিলিয়ার্স তাঁকে বলেছিলেন, “তোমার মতো বয়সে আমার এত প্রতিভা ছিল না। তুমি যা যা শট খেলতে পারো এই বয়সে তা আমিও পারতাম না।” বিরাটের থেকে সরফরাজ অনেক কিছু শিখেছেন। মুম্বইয়ের ব্যাটার বলেন, “জিমে সব থেকে বেশি সময় কাটাত বিরাট। আমি ওর থেকে অনেক কিছু শিখেছি। প্রচুর পরিশ্রম করে ও।”
ক্রিকেটারদের ফিট হওয়া জরুরি বলে মনে করেন ট্রেনার চিন্ময় রায়। ২০০৫ সালে গ্রেগ চ্যাপেলের সময় ভারতীয় দলের ফিটনেস ক্যাম্পে সহকারী হিসাবে কাজ করেছিলেন তিনি। ২০০৮ সালে ভারতীয় ‘এ’ দলের ট্রেনার হিসাবে চিন্ময়কে নেয় বিসিসিআই। দীর্ঘ দিন ধরে ক্রিকেটারদের সঙ্গে কাজ করা চিন্ময় আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “ওজন বেশি হলে ক্রিকেটারদের অবশ্যই সমস্যা হবে। একটা সময়ের পর হাঁটুতে ব্যথা হবে। উইকেটের মাঝে দৌড়তে সমস্যা হবে। ফিল্ডিং করতে সমস্যা হবে। যদিও অনেক ক্রিকেটার রয়েছেন যাঁদের ওজন বেশি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কায়রন পোলার্ডের ভুঁড়ি রয়েছে। আন্দ্রে রাসেলের শক্তিশালী পেশি থাকলেও মেদ রয়েছে তাঁর। এর পরেও এঁরা ব্যাট করছেন, বল করছেন, ফিল্ডিং করছেন। ওজন বেশি নিয়েও খেলা সম্ভব, কিন্তু শরীর ফিট রাখতে ওজনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।”
ব্যাট করার ক্ষেত্রে এই সমস্যা সরফরাজের হয় বলে মনে করছেন না দীনেশ। তিনি বললেন, “সরফরাজের টেকনিক দুর্দান্ত। কোনও শট খেলতেই ওর অসুবিধা হয় না। ক্রিকেটীয় শট খেলে ও। স্ট্রেট ড্রাইভ মারুক বা সুইপ, কখনও কোনও অসুবিধা দেখিনি। রঞ্জিতে ধারাবাহিক ভাবে রান করছে ও। ফিট বলেই পারছে।”
অনুশীলনের জন্য বাড়িতেই ম্যাট পেতে নেট টাঙিয়েছেন নওশাদ। ছেলেকে সেখানে বল ছুড়ে ছুড়ে অনুশীলন করান তিনি। ছোটবেলা থেকে বাবাকে ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকতে দেখেই বড় হয়েছেন সরফরাজ। তাঁর রক্তেও ক্রিকেট। রান করাই তাঁর লক্ষ্য। এর মাঝে ওজন এখনও পর্যন্ত বাধা হয়ে উঠতে পারেনি এই মুম্বইকরের সামনে।