(বাঁ দিকে) সঞ্জু স্যামসন এবং তিলক বর্মা (ডান দিকে)। ছবি: এক্স (টুইটার)।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এক পেশে ম্যাচ জিতে চার ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ় ৩-১ ব্যবধানে জিতেনিলেন সূর্যকুমার যাদবেরা। টস জেতা থেকে সব কিছুই নিখুঁত হল ভারতীয় দলের। তরুণ প্রজন্ম কতটা বিধ্বংসী ক্রিকেট খেলতে পারে, তা দেখিয়ে দিলেন ভারতীয় ব্যাটারেরা। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২৯৭ রানের ইনিংসের পরও যাঁদের মনে প্রশ্ন ছিল, তাঁরা উত্তর পেয়ে গেলেন শুক্রবার। এ দিনের ২৮৩ রান বিদেশের মাটিতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ভারতের সর্বোচ্চ। ভারতের ইনিংসে এ দিন ছক্কা হল মোট ২৩টি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২২টি ছক্কা মারার নিজেদের বিশ্বরেকর্ডই ভেঙে দিল সূর্যকুমারের দল। জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকা করল ১৪৮ রান। ১৩৫ রানে জিতল ভারত।
ওপেনিং জুটি: চার ম্যাচের সিরিজ়ে প্রথম বার রান পেল ভারতের ওপেনিং জুটি। সঞ্জু স্যামসন পর পর দু’ম্যাচে শূন্য করার পর আবার রানে ফিরলেন। গত ম্যাচে অর্ধশতরান করে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া অভিষেক শর্মাও আগ্রাসী ব্যাটিং করলেন। প্রথম ৬ ওভার পাওয়ার প্লের সম্পূর্ণ ব্যবহার করলেন দুই ওপেনার। ৫.৫ ওভারে লুথো সিপামলার বলে অভিষেক আউট হওয়ার আগে ওপেনিং জুটি ভারত তোলে ৭৩ রান। ২টি চার এবং ৪টি ছক্কার সাহায্যে অভিষেক করেন ১৮ বলে ৩৬ রান। সঞ্জুর সঙ্গে তাঁর ওপেনিং জুটিই ভারতীয় ইনিংসের সুর বেঁধে দেয়।
দ্বিতীয় উইকেটের জুটিতে বিশ্বরেকর্ড: ভারতের ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার সাফল্য বলতে শুধু অভিষেকের উইকেট। দ্বিতীয় উইকেটে সঞ্জু এবং তিলক বর্মা দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের নিয়ে এক রকম ছেলে খেলা করলেন। কাউকে আউট করতে পারলেন না আয়োজকেরা। দ্বিতীয় উইকেটের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে সঞ্জু-তিলক তুললেন ২১০ রান। এর আগে টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দ্বিতীয় উইকেটের জুটিতে এত রান তুলতে পারেনি কোনও দল। তাঁদের বিধ্বংসী ব্যাটিংই দক্ষিণ আফ্রিকাকে লড়াই থেকে ছিটকে দেয়।
জোড়া শতরান: একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে এই প্রথম ভারতের দু’জন ব্যাটার শতরান করলেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) পূর্ণ সদস্য দু’টি দেশের ম্যাচেও এমন ঘটনা এই প্রথম। তিলক ৪৭ বলে ১২০ রান করে অপরাজিত থাকলেন। মারলেন ৯টি চার এবং ১০টি ছক্কা। সঞ্জুর পর ভারতের দ্বিতীয় ব্যাটার হিসাবে পর পর দু’টি ২০ ওভারের ম্যাচে শতরান করার নজির গড়লেন হায়দরাবাদের তরুণ। বিশ্বের পঞ্চম ব্যাটার হিসাবে এই কৃতিত্ব অর্জন করলেন তিনি। প্রথম ভারতীয় হিসাবে একই সিরিজ়ে পর পর দু’টি ম্যাচে শতরানের নজির গড়লেন। এ ছাড়াও তাঁর ১২০ রান ২০ ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতীয়দের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সর্বোচ্চ ১২৬ রানের ইনিংস রয়েছে শুভমন গিলের দখলে। টানা দু’ম্যাচে ব্যর্থ হওয়ার পর শতরান এল সঞ্জুর ব্যাট থেকেও। ৫৬ বলে ১০৯ রান করে অপরাজিত থাকলেন তিনি। টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকে তৃতীয় শতরানের ইনিংস সাজালেন ৬টি চার এবং ৯টি ছক্কায়।
সঞ্জু-তিলকের নজির: একটি টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ে একাধিক শতরান করলেন সঞ্জু এবং তিলক। ভারতের প্রথম এবং দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসাবে এই কৃতিত্ব দেখালেন তাঁরা। বিশ্ব ক্রিকেটে এমন নজির এর আগে একটিই ছিল। ২০২৩ সালে ইংল্যান্ডের ফিল সল্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজ়ে দু’টি শতরান করছিলেন। শুক্রবার জোহানেসবার্গে সঞ্জু প্রথম সল্টের কৃতিত্ব স্পর্শ করেন। কয়েক বল পর একই কৃতিত্ব স্পর্শ করলেন তিলকও। এক ক্যালেন্ডার বছরে টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকে দু’টি করে শতরান করলেন তাঁরা। দু’জনেই বিশ্বরেকর্ড স্পর্শ করলেন। এর আগে আরও ১০ জনের এই কৃতিত্ব রয়েছে।
আরশদীপ সিংহ: ২০ ওভারের ক্রিকেটে ক্রমশই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছেন আরশদীপ। জোহানেসবার্গের ২২ গজেও তাঁর বল খেলতে সমস্যায় পড়লেন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটারেরা। নিজের প্রথম দু’ওভারে ১০ রান দিয়ে ৩ উইকেট তুলে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সম্পূর্ণ কোণঠাসা করে দেন বাঁহাতি জোরে বোলার। ২৮৪ রান তাড়া করতে নেমে ১০ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বসে আয়োজকেরা। তখনই ম্যাচ এবং সিরিজ়ের ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায়। যে ২২ গজে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের দেখে ক্লাব স্তরের মনে হচ্ছিল, সেখানেই আরশদীপকে বিপজ্জনক দেখাল প্রায় প্রতি বলে। তাঁর দেরিতে ভাঙা সুইং বুঝতে পারলেন না দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটারেরা। ২০ রানে ৩ উইকেট নিলেন তিনি।
দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডিং: সঞ্জু-তিলকের কৃতিত্বকে খাটো না করেও বলা যায় তাঁদের জুটিকে বিধ্বংসী দেখানোর নেপথ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্বল ফিল্ডিং। অন্তত চার বার তাঁদের আউট করার সুযোগ হাত ছাড়া করেছেন এডেন মার্করমেরা। ভারতীয় ইনিংসের ১৫তম ওভারের পঞ্চম বলে প্রথম ক্যাচ মিস। জেরাল্ড কোয়েৎজের বলে তিলকের তোলা লোপ্পা ক্যাচ ফেলে দেন কেশব মহারাজ। যথেষ্ট সময় পেয়েও বলের নিচে পৌঁছতে পারেননি তিনি। পরের ওভারেই দ্বিতীয় সুযোগ হাতছাড়া। ১৬তম ওভারের চতুর্থ বলে মার্কো জানসেনের বলে ক্যাচ তুলেছিলেন সঞ্জু। জানসেন নিজেই ক্যাচ ফেলে দেন। এর পর ১৮তম ওভারের প্রথম বলে আবার ক্যাচ ফেলেন জানসেন। এ বার কোয়েৎজের বলে তিলকের দেওয়া সহজ ক্যাচ ফেলে দেন তিনি। এ ছাড়াও ১৯তম ওভারের প্রথম বলে খুচরো ২ রান নিয়ে শতরান পূর্ণ করেন তিলক। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারেরা আর একটু তৎপর এবং নিখুঁত থাকতে পারলে ৯৯ রানে রান আউট হয়ে যেতে পারতেন তিলক।
দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্বল বোলিং: মার্করামের দলের কোনও বোলারই দলকে ভরসা দিতে পারলেন না। ভারতের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের সামনে দিশেহারা দেখিয়েছে জানসেন, কোয়েৎজেদের। সিপামলা ছাড়া কেউ উইকেট পাননি। এ দিন দক্ষিণ আফ্রিকার কৃপণতম বোলার ছিলেন জানসেন। তিনিও ৪ ওভারে দিয়েছেন ৪২ রান। ওভার প্রতি খরচ করেছেন ১০.৫০ রান। ট্রিস্টান স্টাবস এক ওভার বল করে বিলিয়েছেন ২১ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার কোনও বোলারই লাইন, লেংথ ঠিক রাখতে পারেননি। ১৭টি ওয়াইড করেছেন তাঁরা। সব চেয়ে বেশি পাঁচটি কোয়েৎজে। বেশ কিছু ফুলটস বল করেও ভারতীয় ব্যাটারদের সুবিধা করে দিয়েছেন তাঁরা।
১০ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর কিছুটা লড়াইয়ের চেষ্টা করেছিলেন স্টাবস এবং ডেভিড মিলার। তাতে লাভ কিছু হয়নি। হওয়ার ছিলও না। মিলার (২৭ বলে ৩৬) এবং স্টাবস (২৯ বলে ৪৩) পর পর দু’বলে আউট হওয়ার পর ম্যাচের বাকিটা ছিল শুধু নিয়মরক্ষার। জানসেন (অপরাজিত ২৯), কোয়েৎজেদের (১২) আগ্রাসী ব্যাটিং দর্শক মনোরঞ্জন ছাড়া কিছু করতে পারেনি। ভারতের সব ভালর মধ্যেও প্রশ্ন থাকল রবি বিশ্নোইয়ের ফিল্ডিং নিয়ে। রমনদীপ সিংহের বোলিংও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রত্যাশিত মানের হল না।