অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে শতরানের পর মুশির খান। —ফাইল চিত্র।
বৃষ্টি পড়লে মুশির খানের অনুশীলনের জায়গা বাড়ির নীচে বাবার তৈরি টার্ফ। শর্ট বল খেলার অনুশীলন চলে ভেজা টেনিস বলে। আর রোদ থাকলে তিনি হয় মুম্বইয়ের কোনও মাঠে, নয় তো উত্তরপ্রদেশে দেশের বাড়ির কোনও মাঠে। ক্রিকেট খেলাই তাঁর ধ্যান, জ্ঞান এবং ধর্ম।
মুশিরের রক্তে ক্রিকেট। তিনি নওশাদ খানের পুত্র। মুম্বই ক্রিকেটে কোচ হিসাবে পরিচিত নওশাদ। তাঁর তিন ছেলেই ক্রিকেট খেলেন। সরফরাজ় খান ইতিমধ্যেই টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছেন। আর চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে মুশির তৈরি করছেন নিজের পরিচয়। ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত অন্য ভাই মইন খানও। রঞ্জিতে একের পর এক মরসুমে রান করে সরফরাজ় ভারতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন। আর সরফরাজ়ের ভাই থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে এখন নিজের নামে পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন মুশিরও।
মুম্বইয়ের কুরলাতে জন্ম মুশিরের। বাবা নওশাদ ক্রিকেট পাগল মানুষ। নিজে স্বপ্ন দেখেছিলেন মুম্বইয়ের হয়ে খেলার। রঞ্জি দলে ঢোকার খুব কাছে এসেও অধরা থেকে গিয়েছিল সেই স্বপ্ন। একের পর এক ম্যাচে শতরান করে তাঁর দুই ছেলে সেই স্বপ্ন সত্যি করেছেন। সরফরাজ় রঞ্জি ফাইনালেও শতরান করেছে। মুশির মুম্বইয়ের হয়ে তিনটি ম্যাচে খেলেছেন। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দু’টি শতরান-সহ করেছেন ৩৬০ রান। তাঁর গড় ৬০.০০। বাঁহাতি স্পিনের জাদুতে নিয়েছেন ৭ উইকেট। ১৮ বছরের তরুণ এই অলরাউন্ডার এক দিন ভারতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেন। আর সেই স্বপ্ন সত্যি করার নেপথ্যে পরিশ্রম করে চলেন বাবা নওশাদ।
মুম্বইয়ের ‘মাচো’র (মুম্বইয়ে এই নামেই পরিচিত নওশাদ) ছেলে গোটা এলাকার মানুষের গর্ব হয়ে উঠেছেন। মুম্বইয়ের কুরলায় বাড়ি নওশাদের। তিনি যেখানে বড় হয়েছেন, বছর দশেক হল সেখান থেকে কুরলার অন্য জায়গায় একটি ফ্ল্যাটে চলে এসেছেন তাঁরা। ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দাদের অনুমতি নিয়ে সেখানেই বানিয়েছেন পিচ। সরফরাজ়, মুশিরদের সেই পিচে অনুশীলন করান নওশাদ। তিনিই যে তাঁর ছেলেদের কোচ। মুশিরদের ক্রিকেট শেখা শুরু তাঁর হাত ধরেই।
বাবার পরিশ্রমের দাম দিয়েছেন মুশিরেরা। কুচবিহার ট্রফিতে ৬৩২ রান এবং ৩২টি উইকেট নিয়ে প্রতিযোগিতার সেরা হয়েছিলেন তিনি। জায়গা করে নিয়েছিলেন মুম্বইয়ের রঞ্জি দলে। দাদা সরফরাজ়ের সঙ্গে খেলেছেন রাজ্য দলের হয়ে। তাঁর সম্পর্কে সরফরাজ় বলেছিলেন, “ভাই আমার থেকে অনেক ভাল ক্রিকেট খেলে। নিজের ভাই বলে এটা বলছি না। কখনও কখনও আমি ঠিক মতো খেলতে পারি না, কিন্তু মুশিরের টেকনিক এত ভাল, ও খেলে দেয়। ওর খেলা দেখে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়ে। মনে হয় আমিও পারব। মুশিরের দেখে শিখি আমি।”
নওশাদ মনে করেন সরফরাজ়ের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে গিয়েই অলরাউন্ডার হয়েছে মুশির। সরফরাজ়কে বল করতেন তাঁর ভাই মুশির। কিন্তু বাবা কখনওই চাননি ছেলেরা ক্রিকেটের শুধু একটা দিক শিখুক। তাই ব্যাটিংও করাতেন মুশিরকে দিয়ে। তৃতীয় ভাই মইন খান থ্রো ডাউন অনুশীলন করাতেন দুই ভাইকে। সরফরাজ় বলেন, “আমি যদি ৩০০টা বল ব্যাট করতাম, মুশিরও তাই করত। সে যতই ও আমাকে বল করুক। আমাদের মেজ ভাই মইন থ্রো ডাউন দিত। বাড়িতে দু’জন ক্রিকেটারকে দেখে ও ট্রেনার হয়ে গিয়েছে।”
ছেলেরা একে একে নওশাদের স্বপ্নপূরণ করছে। এক সাক্ষাৎকারে আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেছিলেন, “আমার অনেক স্বপ্নই সরফরাজ় পূর্ণ করেছে। মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি খেলেছে। রঞ্জি ফাইনালে শতরান করেছে। আমার আশা রয়েছে ও ভারতের হয়েও খেলবে। সব আশা পূরণ হয় না। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরফরাজ় যে ভাবে খেলছে তাতে আমি খুশি।” ভারতীয় টেস্ট দলে ডাক পেয়েছেন সরফরাজ়। এখনও অভিষেক হয়নি। বড় ছেলে বাবার স্বপ্ন সত্যি করছেন একে একে। আর ছোট ছেলে এগিয়ে চলেছেন নিজের গতিতে। অনূর্ধ্ব-১৯ পার করে সিনিয়র ভারতীয় দলে তিনি ঢুকতে পারবেন কি না তা এখনই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রস্তুতিতে যে কোনও খামতি নেই, তা বলা যায়।
মুশিরকে মানসিক ভাবে শক্তিশালী করতে সরফরাজ় এবং নওশাদ বিভিন্ন ফন্দি আঁটতেন। সরফরাজ়ের থেকে ৮ বছরের ছোট মুশির। সরফরাজ় যখন অনূর্ধ্ব-১৯ খেলছেন, তখন মুশিরের বয়স মাত্র ১১ বছর। সেই মুশিরকে দিয়ে বল করাতেন নওশাদ। ছোট বলে রেয়াত করতেন না সরফরাজ়ও। বাবা বলেন, “এক বার এমন মার খেয়েছিল যে, কেঁদে ফেলেছিল মুশির। কিন্তু মানসিক ভাবে এক জন বোলার তখনই শক্তিশালী হবে যখন সে বুঝবে মার খাওয়ার কষ্টটা কী।” মুশির বলেন, “বাবা কখনও বাড়িতে কাচ ভাঙার জন্য বকেনি। কিন্তু খারাপ শট খেললে প্রচুর বকুনি খেতাম।”
গত দু’বছরে মুশির অনেকটাই বদলে গিয়েছেন। আগে খুবই লাজুক ছিলেন মুশির। এখন অনেক বেশি মিশতে পারেন। মাঝের মধ্যে বোলারদের সঙ্গে কথা বলেন, তাঁদের উৎসাহ দেন, বিপক্ষের চোখে চোখ রেখে জবাব দেন। আবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে দেখা যায় রান আউট হয়েছেন ভেবে হতাশ হয়ে গ্লাভস খুলে ফেলতে। বেরিয়ে যাচ্ছিলেন মাঠ ছেড়ে। এমন সময় মাঠের বড় স্ক্রিনে চোখ পড়তে দাঁড়িয়ে যান। তিনি যে উইকেট ভাঙার আগে ক্রিজ়ের মধ্যে ঢুকতে পেরেছেন, সেটা বুঝতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত হয়ে যান আবার ব্যাট করার জন্য।
মুশিরেরা হয়তো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। কিন্তু তাঁর করা ৩৬০ রান বুঝিয়ে দিয়েছে যে, আগামী দিনে বড়দের ক্রিকেটেও জায়গা করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। বাবা নওশাদের থেকে এই মুহূর্তে খুশি বোধ হয় আর কেউ হবে না এখন।