মিলে যায় স্টোকস এবং হার্দিকের জীবন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
সাল ২০১৭। এক জন রেস্তরাঁর বাইরে মারপিট করে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। কেউ লিখেছিলেন, ‘মত্ত অবস্থায় মারপিট করেছেন ক্রিকেটার’, কেউ লিখেছিলেন, ‘তাঁকে ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত করা উচিত।’ অন্ধকার সময় গ্রাস করেছিল ক্রিকেটারকে। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল পরিবার।
সাল ২০১৮। অন্য জন কর্ণ জোহরের অনুষ্ঠানে এসে মহিলাদের নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করে বসেছিলেন। তাঁর সেই মন্তব্য নিয়ে ঝড় উঠেছিল সংবাদমাধ্যমে। নির্বাসিত করা হয়েছিল এক বছরের জন্য। সেই সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মঞ্চে দাপট দেখাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ক্রিকেট থেকেই দূরে সরে যেতে হয়েছিল।
প্রথম জন বেন স্টোকস। ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক। দলের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারও বটে। তাঁর হাত ধরেই ২০১৯ সালে বিশ্বকাপ জিতেছিল ইংল্যান্ড। তিনি না থাকলে হয়তো ২০১৯ সালে অ্যাশেজে ৩৫৯ রান তাড়া করে জেতাই হত না তাদের। শেন ওয়ার্ন যাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “ও যদি আমাদের দলে থাকত, ভাল হত।”
দ্বিতীয় জন হার্দিক পাণ্ড্য। ভারতের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দেশকে নেতৃত্বও দিয়েছেন। সদ্য এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাটে, বলে দাপট দেখিয়ে ম্যাচ জিতিয়েছেন ভারতকে। চোট সারিয়ে ফিরে এসে যিনি একের পর এক ম্যাচ জেতাচ্ছেন দলকে।
দু’জনেই অলরাউন্ডার। দু’জনেই বিতর্কে জড়িয়েছেন। দু’জনেই চোট সারিয়ে ফিরে এসেছেন। ক্রিকেট মাঠে তাঁদের মতো আক্রমণাত্মক ক্রিকেটার খুব বেশি দেখেনি বিশ্ব। ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ককে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। নাম ‘বেন স্টোকস: ফিনিক্স ফ্রম দ্য অ্যাশেজ।’ অর্থাৎ ছাই থেকে উঠে আসা আগুনপাখি। সত্যিই তো সব শেষ হয়ে গিয়েছিল স্টোকসের। ক্রিকেট থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবসরও নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সতীর্থরা। স্টুয়ার্ট ব্রড ভয় পেয়েছিলেন, “মনে হয়েছিল হয়তো ওকে আর কোনও দিন ক্রিকেট খেলতে দেখতেই পাব না।” সেখান থেকে ফিরে এসে ইংল্যান্ড ক্রিকেটের মুকুট পরেছেন। সত্যিই ছাই থেকে উঠে আসা আগুন পাখি। এই একই কথা তো বলা যায় হার্দিককে নিয়েও।
ভারতীয় অলরাউন্ডার ২০১৮ সালে এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলার সময় মাঠ ছেড়েছিলেন স্ট্রেচারে করে। এর পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফিরলেও বল করতে পারছিলেন না। দীর্ঘ দিন ধরে পিঠের চোট ভোগাচ্ছিল তাঁকে। শুধু ব্যাটার হিসাবে দলে জায়গা পাওয়া কঠিন হচ্ছিল। শার্দূল ঠাকুর, দীপক চহারের মতো একের পর এক অলরাউন্ডার উঠে আসছিলেন। জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছিল তাঁদের। সেখান থেকে চোট সারিয়ে আইপিএলে অধিনায়ক হিসাবে খেলতে নামা। বুঝিয়ে দেওয়া অলরাউন্ডার হার্দিক ফিরছেন। কিন্তু এই হার্দিক পাল্টে গিয়েছেন। তাঁর ঠান্ডা মাথায় ম্যাচ জেতানো দেখে তুলনা শুরু হয় ধোনির সঙ্গে। অনেকে বলতে শুরু করেন এটা, ‘হার্দিক ২.০’। ছাই থেকে উঠে আসা আর এক আগুনপাখি।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে হার্দিক বাবাকে হারান। ডিসেম্বর মাসে মারা যান স্টোকসের বাবা। কী অদ্ভুত ভাবে একই বছরে নিজের প্রিয় মানুষকে হারান দু’জন। দুই ক্রিকেটারেরই শরীর জুড়ে ট্যাটু। স্টোকসের পিঠে সিংহের ট্যাটু। যা তিনি করিয়েছেন নিজেকে বার বার মনে করিয়ে দিতে যে, তিনি কোন ধরনের মানুষ। হার্দিকের বাঁ কাঁধে রয়েছে বাঘের ট্যাটু। যা শক্তির প্রতীক হিসাবে দেখেন তিনি। নিজের আক্রমণাত্মক ক্রিকেটকে মনে রাখতে এই ট্যাটু তাঁর শরীরে। সেই সঙ্গে বাঁ কানের নীচে শান্তির প্রতীকের ট্যাটু। বদলে যাওয়া হার্দিক যে ভাবে ঠান্ডা মাথায় ম্যাচ জেতাচ্ছেন তারই প্রতীক হয়ে উঠেছে সেই ট্যাটু।
২০১৮ সালে ইংল্যান্ডের আদালত জানায় স্টোকস নির্দোষ। এক সমকামী যুগলের উপর হওয়া হামলার প্রতিবাদে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলেন স্টোকস। তাঁর মা ডেব স্টোকস বলেন, “এই স্বভাব ও বাবার থেকে পেয়েছে। এমন ঘটনা চোখের সামনে ঘটলে ওর বাবা কখনও মুখ ঘুরিয়ে চলে আসত না।” কর্ণ জোহরের অনুষ্ঠানে হার্দিকের মন্তব্য ঘিরে যোধপুর কোর্টে একটি মামলা হয়েছিল। ঘটনার তিন বছর পর সেই মামলার রায় বার হয়। হার্দিককে মুক্তি দেওয়া হয়। ঘটনার পর হার্দিক পাশে পেয়েছিলেন তাঁর বাবা হিমাংশু পাণ্ড্যকে। তিনি বলেছিলেন, “একটি বিনোদনের অনুষ্ঠানে হার্দিক মজা করেই কথাটা বলেছিল। ওর কথার অন্য রকম মানে তৈরি করা উচিত নয়।”
দুই দেশের মধ্যে তফাত ৬৭০৪ কিলোমিটার। তবুও ইংল্যান্ডের ‘স্টোকসি’র জীবনের সঙ্গে মিলে যায় ভারতের ‘পাণ্ডু’র জীবন।