ICC ODI World Cup 2023

জন্মদিনে ফুল নয়, কাঁটার বাবরনামা

বাবর আজ়ম যে কোহলি বন্দনায় ব্যস্ত, তা নিয়ে এত দিন নাচানাচি হচ্ছিল। কী দারুণ মৈত্রীর ছবি, এ সব বলা হচ্ছিল। আমদাবাদে হারের পরে অন্য মেজাজ ধরা পড়ছে।

Advertisement
সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৪১
An image of Babar Azam

বিদ্ধ: শনিবারের ছবি। আমদাবাদের গ্যালারিতে ভারতের জয়ধ্বনি। মাঠে বিপর্যস্ত পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজ়ম। —ফাইল চিত্র।

জীবন কত দ্রুত পাল্টে যায়! আমদাবাদ-বেঙ্গালুরু উড়ানে বসে নিশ্চয়ই ভাবছিলেন বাবর আজ়ম।

Advertisement

রবিবার তাঁর ২৯তম জন্মদিন ছিল। কিন্তু ভারতের কাছে হারের পরের দিন কোনও পাক অধিনায়ক জন্মদিন পালন করছেন— দেখা গেলে নিশ্চয়ই আফগানিস্তানের ইংল্যান্ডকে হারানোর চেয়েও বড় অঘটন বলে গণ্য হবে।

বরং বিশ্বকাপে ভারতের কাছে এমন জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া হার মানে দেশের বোর্ড থেকে ফোন আসবে— ‘‘শোনো, তোমাকে আর নেতৃত্বের বোঝাটা বইতে হবে না।’’ অথবা পরিবারের কেউ প্রবল উদ্বেগ আর আর্তি নিয়ে ফোন করবে— ‘‘বোর্ডকে অনুরোধ করে দেখ না যাতে রাতের দিকের ফ্লাইটে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করে। দিনের বেলায় ফিরলে জনতার প্রবল রোষের মুখে পড়তে হবে। কিছু একটা যদি হয়ে যায়।’’

বাবর সে দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী এবং ভাগ্যবান। বেঙ্গালুরু পৌঁছে হোটেলে ঢোকার মুখে কেক কেটে তাঁর জন্মদিন পালন হল। কিন্তু সেটাকে হোটেল কর্তৃপক্ষের সৌজন্যের বাইরে খুব বড় কিছু বলে দেখার চেষ্টা না করাই ভাল। দলের সদস্যরা পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিলেন। ‘হ্যাপি বার্থডে’ গানও ধরলেন কেউ কেউ। সেটা ভিডিয়োর জন্য দারুণ পোজ় হতে পারে। পাক শিবিরের আসল ছবি কি না প্রশ্ন থাকছে। দলের অন্দরমহলে যে বাজ পড়েছে আমদাবাদের হারে, তা কোনও ভিডিয়ো দেখাবে না। কিন্তু অন্তঃসলিলার মতো তলে-তলে
বয়ে যাচ্ছে।

নিজের দেশে যে রকম প্রবল ভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন বাবর, তাতে কে বলবে ক’দিন আগে সর্বকালের সেরাদের পাশে বসানো হচ্ছিল তাঁকে! ভারতের কাছে হারের পরে পদত্যাগের দাবি উঠেছে। কে তুলেছেন সেই দাবি? যে সে লোক নন, স্বয়ং শোয়েব মালিক। পাকিস্তানের এক টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘দেখে মনে হচ্ছে না অধিনায়কত্ব খুব উপভোগ করছে। ছেড়ে দিক না।’’ শুনে অবাকই লাগছিল। সানিয়া মির্জ়ার স্বামী এমনিতে শান্ত প্রকৃতির মানুষ। খুব বিস্ফোরক কথা কখনও তাঁর মুখ থেকে শোনা যায়নি। তিনিও ধৈর্য হারিয়েছেন!

তা হলে অন্য শোয়েবের প্রতিক্রিয়াকে কী বলা হবে? রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস অত সব সৌজন্যের তোয়াক্কা করেন না। বাবরকে সোজা বাউন্সার নিক্ষেপ করছেন, ‘‘রোজই শুনি বলছে, বিরাট কোহলি নাকি ওর প্রিয় ক্রিকেটার। তা কোহলিকে দেখে কিছু শিখলেও তো পারে। কোহলি ২৫ রান করলে তার মধ্যে ১৫টা সিঙ্গলস থাকে। ইনিংসটা কী দারুণ ভাবে সাজায়। এ সব কি দেখে কিছুই কি শেখে না আমাদের অধিনায়ক?’’ এখানে না থেমে, শোয়েব এর পরে আরও মারাত্মক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘একটা ম্যাচও তো জেতায় না বাবর। বড্ড তাড়াতাড়ি ওকে কিংবদন্তির আসনে বসিয়ে দিয়ে আমরাই সর্বনাশটা করেছি।’’

শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাবে অতীতে খুব জনপ্রিয় হওয়া ক্রিকেটের উপরে একটি টিভি অনুষ্ঠান। ‘ম্যাচ কা মুজরিম’। যা হত ভারতীয় চ্যানেলে। দল হারলেই এই অনুষ্ঠানে খোঁজা হত খলনায়ক কে? সেই অনুষ্ঠান ভারতে এখন আর হয় না। মনে হচ্ছে, তা স্থানান্তরিত হয়ে তাঁবু ফেলেছে ওয়াঘার ওপারে। কোনও সন্দেহ নেই, নিজের দেশে এই মুহূর্তে ‘ম্যাচ কা মুজরিম’ নম্বর ওয়ানের নাম বাবর আজ়ম।

ওয়াসিম আক্রম হালফিলে অনেক শান্ত হয়েছেন। আগের মতো আগ্রাসী মন্তব্য করেন না। সেই তিনিও বলতে ছাড়েননি, ‘‘পাকিস্তানকে দেখে মনে হচ্ছে, নব্বইয়ের দশকের এক দিনের ক্রিকেট খেলছে। ওই ক্রিকেট এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গিয়েছে।’’ কাছাকাছি সময়ে অন্য এক চ্যানেলে বসেছেন কামরান আকমল। ভারতে এসে শতরান করে মোহালিতে সাক্ষাৎ হারা টেস্ট ড্র করে দিয়েছিলেন। তিনিও তোয়াজ করছেন না বাবরের দলকে। বলেছেন, ‘‘প্রায়ই শুনি ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় কেন হয় না? এই ম্যাচটা দেখে মনে হচ্ছে, ভাগ্য ভাল দ্বিপাক্ষিক ক্রিকেট বন্ধ আছে। না হলে প্রত্যেক ম্যাচে আমরা এ ভাবেই হারতাম।’’ বিশ্বকাপে ভারতের কাছে পাকিস্তানের হার নতুন কিছু তো নয়। এই নিয়ে আট বারের আট বারই তারা হারল। আগে হারলে প্রশ্ন উঠত, ‘দুশমনদের’ কাছে কেন হারল? হঠাও অধিনায়ককে। সরাও কোচকে। এখন যেটা নতুন, তা হচ্ছে— পাকিস্তানই বলছে, ভারতকে দেখে শিখতে পারো না কেন? শোয়েব আখতার তো বলেইছেন। মিসবা-উল-হক, মইন খান, রশিদ লতিফরাও বলছেন। দারুণ সুখ্যাতি হচ্ছে বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির। যাদের নিয়ে বিশ্বকাপের কয়েক দিন আগে ভারতেই ঝড় উঠেছিল। আক্রম বলেছেন, ‘‘আমি অনেক বছর ভারতে আইপিএলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কেকেআরের বোলিং পরামর্শদাতা ছিলাম। ওদের জাতীয় অ্যাকাডেমিতে দারুণ পরিকাঠামো রয়েছে। চোট সারিয়ে ফেরার খুব ভাল প্রক্রিয়া রয়েছে। রিহ্যাব করা যায়। উঠতি ছেলেরা ট্রেনিং করতে পারে। দারুণ ব্যবস্থা।’’ ভারত ‘সিস্টেম’-এ হারিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, বক্তব্য তাঁদের। কে এল রাহুল ও শ্রেয়স আয়ার সময় মতো সেরে উঠবেন কি না, তা নিয়ে প্রবল সংশয় ছিল বিশ্বকাপের আগে। সেই উদাহরণ টেনে আক্রম, শোয়েবরা বলছেন, ‘‘শুধু ফিটই করে তোলেনি ওদের, টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড়চ্ছে ওরা বিশ্বকাপে।’’

উল্টো ছবিও রয়েছে। বাবর আজ়ম যে কোহলি বন্দনায় ব্যস্ত, তা নিয়ে এত দিন নাচানাচি হচ্ছিল। কী দারুণ মৈত্রীর ছবি, এ সব বলা হচ্ছিল। আমদাবাদে হারের পরে অন্য মেজাজ ধরা পড়ছে। কোহলির থেকে জার্সি নেওয়ার ছবির ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষিপ্ত অনেকে। এদের প্রশ্ন, ‘‘দেখে মনে হচ্ছিল, হুজুরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খেলতে নেমেছিল নাকি প্রতিপক্ষের তারকাকে পুজো করতে গিয়েছিল? চোখে চোখ রেখে লড়াই সেই স্পৃহাটাই তো ছিল না।’’ না শুনলে বিশ্বাস করা যাবে না নিজেদের দেশে কী পরিমাণ তুলোধনা হচ্ছেন পাক ক্রিকেটারেরা। আক্রমকে এক জন এসএমএস পাঠিয়েছেন, ‘‘আফগানিস্তানের অধিনায়ককে পর্যন্ত বলতে শুনলাম, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনশো তুলতে চাই। আমাদের অধিনায়ক নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধেও টস করতে গিয়ে বলছে, ২৯০ টার্গেট। কী বলবেন?’’ এমনই সব ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া একের পর এক আছড়ে পড়ছে পাক অধিনায়কের জন্মদিনেই। মনে হবে যেন, শুধু ভারতের কাছে হারেননি তাঁরা। ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপটাই হারিয়ে ফিরছেন!

কে বলবে ২০২৩ বিশ্বকাপে মাত্র তিনটে ম্যাচ খেলেছে পাকিস্তান। তার দু’টো জিতেছে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড— দুই ফেভারিটের অবস্থা বাবরদের চেয়ে অনেক খারাপ। গত বারের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড তিনটের দু’টোতে হেরে পয়েন্ট টেবলে পাঁচ নম্বরে। আফগানিস্তানের কাছে হারল। অস্ট্রেলিয়া দু’টো ম্যাচের দু’টোতেই হেরে সবার শেষে। নেট রানরেট তুবড়ে থাকায় নেদারল্যান্ডসেরও পিছনে। পাকিস্তান এখনও চারে। কাপ-ভাগ্য গড়াগড়ি খাচ্ছে, মোটেও বলা যাবে না।

ক্ষিপ্ত জনতা শুনলে তো!

Advertisement
আরও পড়ুন