লখনউয়ের বিরুদ্ধে আউট হয়ে ফেরার পথে কান্না বৈভব সূর্যবংশীর। ছবি: রয়টার্স।
এডেন মার্করামের বলে স্টাম্প আউট হয়ে যখন বৈভব সূর্যবংশী ডাগআউটে ফিরছে তখন তার চোখে জল। হেলমেট খুলে ডান হাতের বুডো আঙুল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ফিরল সে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, অল্পের জন্য বুঝি শতরান হাতছাড়া হয়েছে। কিন্তু সে তো করেছে ৩৪ রান। ২০ বলে। তা হলে কেন এত দুঃখ? আসলে বড়দের মঞ্চে অভিষেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল ১৪ বছরের কিশোর। সেই পথেই এগোচ্ছিল সে। ক্ষণিকের ভুলে আউট হতে হয়। সেই কারণেই হয়তো মানতে পারছিল না বৈভব। ভাবছিল, খেলা শেষ করে আসতে পারত। কিন্তু সে হয়তো নিজেও বোঝেনি, ৩৪ রানের ছোট ইনিংসেই সে নিজের জাত চিনিয়ে ফেলেছে। বুঝিয়ে দিয়েছে, সে লম্বা রেসের ঘোড়া। বৈভব ভাল খেললেও জয়ে ফিরতে পারল না রাজস্থান। জেতা ম্যাচ লখনউ সুপার জায়ান্টসের কাছে হারল তারা।
আগের ম্যাচে চোট পাওয়ায় এই ম্যাচে খেলেননি সঞ্জু স্যামসন। ফলে রাজস্থানের দরকার ছিল এক ওপেনার। ১৪ বছর ২৩ দিনের বৈভবের উপর ভরসা দেখান রাহুল দ্রাবিড়েরা। তবে প্রথম ম্যাচে ফিল্ডিং করতে হয়নি তাকে। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসাবে শুধু ব্যাট করেছে। আর শুরুতেই যে কাজটা সে করেছে তাতে পরের ম্যাচগুলিতে তাকে প্রথম একাদশের বাইরে বসিয়ে রাখা কঠিন।
১৮১ রান তাড়া করতে নেমেছিল রাজস্থান। অভিষেক ম্যাচে সাধারণত সকলে একটু ধরে খেলার চেষ্টা করে। ভাবে, শূন্য রানে যেন ফিরতে না হয়। কিন্তু বৈভব সে সবের ধার ধারে না। শার্দূল ঠাকুরের মতো পোড়খাওয়া বোলারের প্রথম বলেই কভারের উপর দিয়ে যে ছক্কাটা সে মারল তা দেখে বিশ্বের সেরা ব্যাটারেরাও হাততালি দেবেন। সেই শটটাই তার সব জড়তা কাটিয়ে দিল। পেটের ভিতর যে প্রজাপতিগুলো ছটফট করছিল, তারাও থেমে গেল। পরের ওভারে আবেশ খানের বলে আরও একটা ছক্কা। আগেরটা কভারের উপর দিয়ে হলে এটা সোজা বোলারের মাথার উপর দিয়ে। প্রথম চার বলেই তার জোড়া ছক্কা ঘোষণা করে দিল, ভারতীয় ক্রিকেটের ‘বৈভব’ হয়ে ওঠার সব গুণ তার মধ্যে রয়েছে।
তবে সুযোগও দিয়েছে বৈভব। তার একটি ক্যাচ পড়েছে। দু’বার ক্যাচের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার ব্যাট থামেনি। পেসার, স্পিনার সকলের বিরুদ্ধে বড় শট এসেছে। বৈভবের ব্যাট করার ধরনই এমন। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে সে। নইলে যে দিগ্বেশ রাঠী এ বার তাবড় তাবড় ব্যাটারকে সমস্যায় ফেলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধেও শুরুতে ছক্কা মেরেছে সে। মার্করামের যে বলটিতে বৈভব আউট হয়েছে সেটিও কভারের উপর দিয়ে খেলতে গিয়েছিল সে। কিন্তু বল ঘুরে যাওয়ায় ব্যাটে লাগেনি। শরীরের নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারায় পা সময়ে মাটিতে নামাতে পারেনি। সেই কারণে আউট হতে হয়েছে। বল সোজা গেলে হয়তো আরও একটি ছক্কা অপেক্ষা করছিল।
২০ বলে ৩৪ রানের ইনিংসে দু’টি চার ও তিনটি ছক্কা মেরেছে বৈভব। যত ক্ষণ সে ক্রিজ়ে ছিল, অপর প্রান্তে যশস্বী জয়সওয়ালকেও অনেক ফুরফুরে লাগছিল। ১৮ বছর বয়সে রাজস্থানের জার্সিতে যশস্বীরও অভিষেক হয়েছিল। বৈভবের মধ্যে হয়তো কিশোর যশস্বীকে দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। সেই একই রকম ভয়ডরহীন ক্রিকেট। সেই একই রকম অবলীলায় ছক্কা মারার ক্ষমতা। বৈভবকে আউট করে ঋষভ পন্থেরা যে ভাবে উল্লাস করলেন, তা আদতে জিতিয়ে দিল বৈভবকে। প্রথম বার মাঠে নেমেই সে বুঝিয়ে দিল, বিপক্ষ তাকে হালকা ভাবে নিলে সমস্যায় পড়বে।
এ বারের আইপিএল নিলামের আগেই আলোচনায় উঠে এসেছিল বিহারের কিশোর ব্যাটারের নাম। নিলামের তালিকায় কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসাবে ছিল বৈভবই। তার ন্যূনতম দাম ছিল ৩০ লাখ টাকা। নিলামের সঞ্চালিকা মল্লিকা সাগর বৈভবের নাম ঘোষণা করতেই আগ্রহ দেখান দিল্লি কর্তৃপক্ষ। তাঁদের সঙ্গে টাকার যুদ্ধে নামেন রাজস্থান রয়্যালস কর্তৃপক্ষ। রাজস্থানকে নিলামে নেতৃত্ব দেন কোচ দ্রাবিড় নিজে। দিল্লির হাতে সে সময় ছিল ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ১৮ জন ক্রিকেটারকে নেওয়া ছিল তাদের। অন্য দিকে, রাজস্থানের হাতে ছিল ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তাদের কেনা হয়েছিল ১৬ জন ক্রিকেটার। তুলনায় বেশি টাকা হাতে থাকায় সম্ভবত ভবিষ্যতের লগ্নি হিসাবে এগিয়ে যান রাজস্থান কর্তৃপক্ষ। তাঁরা ১ কোটি ১০ লাখ টাকা দাম দিতে লড়াই থেকে সরে যেতে বাধ্য হয় দিল্লি। বৈভবকে কেনে রাজস্থান।
বিহারের তাজপুর গ্রামের বাসিন্দা বৈভব চার বছর বয়সে বাবা সঞ্জীব সূর্যবংশীর কাছে ক্রিকেট শেখা শুরু করে। সঞ্জীব পেশায় কৃষক হলেও ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা রয়েছে তাঁর। ছেলের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ দেখে তাকে ক্রিকেটার হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বাড়ির পিছনে ছোট একটু জায়গা পরিষ্কার করে ছেলেকে ক্রিকেট শেখাতে শুরু করেছিলেন। বাবার কাছে প্রাথমিক ক্রিকেট পাঠের পর ন’বছর বয়সে সমস্তিপুর ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয় বৈভব। সেখানে আড়াই বছর শেখার পর বিজয় মার্চেন্ট ট্রফির জন্য ট্রায়ালে যায় বৈভব। ভাল পারফর্ম করলেও কম বয়সের কথা ভেবে তাকে স্ট্যান্ড বাই রেখেছিলেন বিহারের অনূর্ধ্ব ১৬ দলের নির্বাচকেরা। সেখানেই চোখে পড়ে যান প্রাক্তন রঞ্জি ক্রিকেটার মণীশ ওঝার। তার পর থেকে তিনিই বৈভবের কোচ।
১২ বছর ২৮৪ দিন বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় মিডল অর্ডার ব্যাটার বৈভবের। ২১১ দিনের জন্য রেকর্ড হয়নি তার। ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে সব থেকে কম বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার নজির রয়েছে রাজপুতানার প্রাক্তন ক্রিকেটার আলিমুদ্দিনের। অজমেরের ক্রিকেটারের রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়েছিল ১৯৪২-’৪৩ মরসুমে বরোদার বিরুদ্ধে। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১২ বছর ৭৩ দিন। এর আগে ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ ‘বি’ দলের হয়ে ভাল পারফরম্যান্স করেছিল সে। ভাল খেলেছিল বিনু মাঁকড় ট্রফিতেও। সেই প্রতিযোগিতায় পাঁচ ম্যাচে ৪০০-র বেশি রান করে সে। গত ১ অক্টোবর বেসরকারি টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব ১৯ দলের বিরুদ্ধে ৫৮ বলে শতরান করে আলোচনায় উঠে আসে ১৩ বছরের বৈভব। অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের লাল বলের ক্রিকেটে ভারতের হয়ে এটাই দ্রুততম শতরান। ইনিংসে ছিল ১৪টি চার ও চারটি ছয়। স্ট্রাইক রেট ১৬৭.৭৪।
এ বারের আইপিএলেও অনেক তরুণ ক্রিকেটার নজর কাড়ছেন। দিগ্বেশ রাঠী, অনিকেত বর্মাদের তালিকায় জায়গা করে নিল বৈভব। প্রথম ম্যাচেই। ২৭ কোটির পন্থেরা যে মঞ্চে ব্যর্থ হচ্ছেন, সেই মঞ্চেই আবির্ভাব হচ্ছে বৈভবদের। তাঁর ব্যাটে যে রান তাড়া শুরু হয়েছিল, তা শেষ করার দায়িত্ব ছিল যশস্বী, পরাগের। দু’জনেই ভাল খেলছিলেন। কিন্তু ভুল সময়ে আউট হয়ে গেলেন। আরও এক বার চাপের সামনে ভেঙে পড়ল রাজস্থান। লখনউয়ের বিরুদ্ধে জেতা ম্যাচ হারল তারা।