Space

স্বাস্থ্য ফেরাতে কি মহাকাশে ‘হাওয়া বদল’, গবেষণায় দিশা

আমেরিকার ফ্লরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে নাসার ব্যবস্থাপনায় স্পেসএক্স-এর রকেটে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল ১৬০টি ইঁদুরকে। ৪২ দিন পরে আবার তাদের প্রশান্ত মহাসাগরে নামিয়ে এনে পরীক্ষা করা হয়।

Advertisement
সুজিষ্ণু মাহাতো
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৩৮
পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাকগোয়ান ইনস্টিটিউট অব রিজেনেরেটিভ মেডিসিনে চলছে গবেষণা।

পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাকগোয়ান ইনস্টিটিউট অব রিজেনেরেটিভ মেডিসিনে চলছে গবেষণা। ছবি: চন্দনকুমার সেনের সৌজন্যে।

কয়েক দশক আগেও স্বাস্থ্য ফেরানোর জন্য পশ্চিমে হাওয়া বদল করতে যাওয়ার রীতি ছিল চেনা। মহাকাশে ‘হাওয়া’ নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে কি একেবারে পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে মহাকাশে গিয়েই ‘হাওয়া বদলে’র ধাঁচে রোগ সারিয়ে ফিরে আসা যাবে? এমন চমকপ্রদ সম্ভাবনারই ইঙ্গিত মিলেছে গবেষণায়। গত ২০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সেল’-এর ‘আইসায়েন্স’ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে সেই গবেষণাপত্র। সেটির অন্যতম প্রণেতা আমেরিকার পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাকগোয়ান ইনস্টিটিউট অব রিজেনেরেটিভ মেডিসিনের ডিরেক্টর চন্দনকুমার সেন। চন্দনের সঙ্গে সেই গবেষণার সহ-প্রণেতা হিসেবে রয়েছেন আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের ন্যাশনাল ল্যাবের বিজ্ঞানী লিজ় ওয়ারেন-সহ আরও অনেকে।

Advertisement

গবেষণাপত্রটি মাসখানেক আগে প্রকাশিত হলেও এই কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। আমেরিকার ফ্লরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে নাসার ব্যবস্থাপনায় স্পেসএক্স-এর রকেটে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল ১৬০টি ইঁদুরকে। ৪২ দিন পরে আবার তাদের প্রশান্ত মহাসাগরে নামিয়ে এনে পরীক্ষা করা হয়। তার পরে গবেষণা চলেছে পাঁচ বছর। সেই গবেষণা থেকেই বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, মহাকাশে পাঠানো এক তৃতীয়াংশ ইঁদুরের মধ্যে জিনগত স্তরে পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।

এই পরিবর্তনই ভবিষ্যতে বিশ্বের স্বাস্থ্য গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন চন্দন ও লিজ়রা। চন্দন বলছেন, “আমরা দেখতে পাই মহাকাশে গেলে স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। হাড়, পেশি দুর্বল হয়। কিন্তু সেগুলো হয়তো মহাকাশে কাজে লাগে না বলে আমাদের শরীর সেগুলিকে হারাতে রাজি হয়েছে। সেই সঙ্গে শরীর মানিয়ে নেওয়ারও কিছু সঙ্কেত দিচ্ছে। আমরা যদি সেই সঙ্কেতগুলির উপরে চোখ রাখি, তাহলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরো ধারণাতেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে।”
গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা বলছেন, হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ফলে মানব শরীর তৈরি হয়েছে পৃথিবীতে বসবাসের জন্য যা দরকার সেই অনুযায়ী। আবার পৃথিবীতেই ভৌগোলিক স্থান ও পেশার ফারাকে শারীরিক ক্ষমতা, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার তফাত হয়। শেরপাদের শারীরিক গঠন সমতলের লোকের চেয়ে আলাদা, শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া আলাদা। আবার সমুদ্রগর্ভে যাঁরা ডুবুরি, তাঁদেরও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ফলে শরীর মানিয়ে নেয়।

সেই প্রসঙ্গ তুলেই বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, মহাকাশে যদি কোনও প্রাণীকে এমন একটা অবস্থায় রাখা হয় যেখানে তার প্রাণ যাবে না, সেখানে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী সে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেই। তার স্পষ্ট প্রমাণও মিলেছে গবেষণায়।
হুগলির ভূমিপুত্র, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের শারীরবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তনী চন্দন বলছেন, “চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী মানুষের শরীর বা শারীরিক ক্ষমতার সীমা সম্বন্ধে যে ধারণা এত দিন রয়েছে, তার পুরোটাই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর প্রেক্ষিতে। তার ভিত্তিতেই চিকিৎসাবিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যখন আমরা পৃথিবী ছাড়ব, হতেই পারে সীমাগুলি বদলে যাবে। তাই ভবিষ্যতে মহাকাশে কোনও স্বাস্থ্য কেন্দ্র হওয়া বা সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করানো অসম্ভব নয়।”

কী ভাবে মহাকাশে হচ্ছে স্তন্যপায়ী প্রাণী ইঁদুরের এই শারীরিক পরিবর্তন? চন্দনের ব্যাখ্যা, “এককোষী প্রাণী বা অ্যামিবা, প্রোটোজোয়া থেকে শুরু করে, সরীসৃপ, পাখি থেকে স্তন্যপায়ী, অর্থাৎ মানুষ— এই যাত্রার মধ্যে যে পদ্ধতিতে বিবর্তন হয়, তার একটা অঙ্গ জিনোমিক প্লাস্টিসিটি। যার অর্থ, জিনোম বাতাবরণের সঙ্গে কথা বলছে, এবং নিজেকে বদলে নিচ্ছে। কারণ জিনোম থেকে জিন তৈরি হয়, জিন থেকে প্রোটিন তৈরি হয়, প্রোটিন থেকে ফাংশন তৈরি হয়, ফাংশন থেকে লাইফ অর্থাৎ প্রাণ তৈরি হয়। জিনোমের যে এই নিজেকে বদলে নিতে পারে, তার এই ধর্মকেই বলা হয় প্লাস্টিসিটি।” মহাকাশে পাঠানো ইঁদুরদের মধ্যে এই জিনোমিক প্লাস্টিসিটিই চন্দনরা দেখতে পেয়েছেন। চন্দন জানাচ্ছেন, এই পরিবর্তন অবশ্য সব ক’টি প্রাণীর মধ্যে দেখা দেয়নি। এক তৃতীয়াংশের মধ্যে দেখতে পাওয়া গেছে। চন্দনের কথায়, “এই এক তৃতীয়াংশের খাপ খাইয়ে নেওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ ভাবেই আমরা বেঁচেছি বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। সবাই বাঁচেনি।”

যে ইঁদুরদের শরীরে জিনের এই পরিবর্তন দেখা গিয়েছে, গবেষণাপত্রে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে ‘রেসপন্ডার’ বলে। কী পদ্ধতিতে জিন এ ভাবে মহাকাশের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে? চন্দন বলছেন, “এটাকে বলে এপিজেনেটিক কন্ট্রোল। কোনও জিনে যখন রসায়নগত একটা বদল হয়, তখন সেই জিন নিজেকে ব্যক্ত করে না। অর্থাৎ সেই জিন প্রোটিন বানায় না। সে তখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে।”

চন্দনদের পর্যবেক্ষণ, “যখন ওই প্রাণীরা মহাকাশে যাচ্ছে, তখন যে মেথিলেশন বা রাসায়নিক পদ্ধতি জিনকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, তা সরে যাচ্ছে।” তবে সেই পরিবর্তন ঘটছে এক তৃতীয়াংশের শরীরে। চন্দনের কথায়, “বিবর্তন একটা কয়েক হাজার বছরের প্রক্রিয়া হতেই পারে। কিন্তু মাত্র দেড় মাসের মধ্যে আমরা জিনোমিক স্তরে স্পষ্ট খাপ খাইয়ে নেওয়ার সঙ্কেত পাচ্ছি। কী ভাবে হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছি। এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দরজা খুলে দিচ্ছে।” সেই দরজা দিয়েই হয়তো ভবিষ্যতের চিকিৎসাবিজ্ঞান পথ করে নেবে সম্পূর্ণ এক বৈপ্লবিক দিকে। চন্দনের কথায়, “পৃথিবী আমাদের শরীরের যে সীমাবদ্ধতার কথা শিখিয়েছে, আমরা বুঝতে পারছি তা পার্থিব শক্তি তথা পৃথিবীর প্রেক্ষিতে। সেগুলি পৃথিবীর বুকে ধ্রুব সত্য। কিন্তু মহাকাশে তা নয়। বিপুল এই ব্রহ্মাণ্ডে পৃথিবী তো অতি নগণ্য।” তাই চন্দনের বক্তব্য, “এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত যে, শরীর মানিয়ে নিতে চাইছে। মহাকাশে বিকিরণ আছে, মাধ্যাকর্ষণ নেই। সেই পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার জন্য শরীরে যে বদল হচ্ছে, সেটাকে কি আমরা ওষুধে বা অন্য কোনও ভাবে ব্যবহার করতে পারি? পৃথিবীতে শরীরে যে বদল আসতে হয়তো কয়েকশো বছর সময় লাগবে, মহাকাশের পরিস্থিতিতে তা অনেক দ্রুত আসতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে মহাকাশের মতো উপযুক্ত
গবেষণাগার আর নেই।”

এখন মহাকাশেই রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত নভশ্চর সুনীতা উইলিয়াম। তাঁর সাম্প্রতিক ছবি দেখে চর্চা হয়েছে তাঁর শরীর ভেঙে যাওয়া নিয়েও। চন্দনদের গবেষণা অবশ্য বলছে, এই ‘ভেঙে যাওয়া’র মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে নতুন করে গড়ার দিশা। চন্দনের কথায়, “মহাকাশে মানিয়ে নেওয়ার অন্য কোনও ইঙ্গিতও দিচ্ছে দেহ। ভবিষ্যতে যদি মানবজাতিকে অন্য কোনও গ্রহে বাঁচতে হয়, সে জন্যও এই ইঙ্গিতের দিকে
নজর রাখা দরকার।”

Advertisement
আরও পড়ুন