Sandhya Mukhopadhyay

ওগো মোর গীতিময়

তাঁর গান পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাঙালি সংসারের শান্তি ও স্থিতি। ক্যাসেট ও ডিজিটাল প্রযুক্তির দাপটে ভেঙে গেল সেই শান্তির নীড়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দুঃখ ছিল, গান এখন বড় চটজলদি তৈরি হয়।

Advertisement
দীপেশ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:১৮

আমাদের ছেলেবেলা ও যৌবনের বেশ খানিকটা নিয়ে কিংবদন্তি শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন। অবশ্য যা নিয়ে গেলেন, তা ওঁরই দান। আর এই নিয়ে যাওয়াও আমাদের বঞ্চিত করা নয়। যা দিয়ে গিয়েছেন, তা কাল ছাড়া আর কে নেবে? এ ক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া মানে আমাদেরই অতীত সম্বন্ধে আমাদের আত্মসচেতন হয়ে ওঠা। অর্থাৎ একটা কিছু ছিল যাকে আমরা ছোটবেলায় বা যৌবনে প্রাকৃতিক নিয়মের মতো— যেমন সূর্য ওঠা বা ঋতু পরিবর্তন— স্বাভাবিক মনে করতাম, সেটাই যেন সময়ের ব্যবধানে ‘ঐতিহাসিক’ কিছু হয়ে উঠল। আমার প্রজন্ম বাংলা ‘আধুনিক’ গান শুনে বড় হয়েছে। পাশাপাশি, বিশেষত ১৯৬১-র কল্যাণে, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল; তা ছাড়া কীর্তন, পল্লিগীতি (রেডিয়োর ভাষায়) ইত্যাদি ছিল; ডোভার লেনের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সম্মেলন ছিল, কিন্তু তারই সঙ্গে ছিল ‘পুজোর গান’ যা সারা বছর ধরে শনি-রবিবার রেডিয়োর ‘অনুরোধের আসর’ ভরিয়ে রাখত। আমরা উন্মুখ হয়ে বসে থাকতাম, এ বার পুজোয় কে কী গান, কার সুরে, কার কথায় গাইবেন। আর সেই ‘আধুনিক’ গানের নিকট আত্মীয় ছিল সিনেমার গান। অনেকে ‘বেসিক’ গান ও সিনেমার গান বলে আলাদা করতেন। ঠিকই। সিনেমায় সিচুয়েশন বুঝে গান বাঁধতে ও গাইতে হত শিল্পীদের, কিন্তু তথাকথিত ‘বেসিক’ গানের কথা ও সুরেও যে ‘সিচুয়েশন’ ঢুকে বসে থাকত, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তাই ‘আধুনিক’ গান বলতে দুই-ই। আমাদের কৈশোর-যৌবনের রোম্যান্টিক স্বপ্নের উপকরণ-প্রকরণ যেমন পেতাম ‘এ শুধু গানের দিন’ বা ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ থেকে, তেমনই পেতাম ‘আজ কেন, ও চোখে লাজ কেন’, ‘মধুমালতী ডাকে আয়’ অথবা ‘আর ডেকো না ঐ মধু নামে’ জাতীয় গান থেকে।
রেডিয়ো-সিনেমা আর শীতে পাড়ার জলসার ওই যুগে বড় হতে হতে ভাবতাম, গানে-সিনেমায়-নাটকে যে অনুভূতির জগৎ আমরা খুঁজে পেতাম, তার বোধহয় কোনও আদি-অন্ত নেই— তা সূর্য ওঠা, সূর্য ডোবা, মেঘ জমা, বৃষ্টি পড়ার মতো স্বাভাবিক। চিরন্তন। ভাবার কারণও ছিল। প্রথমত দেখতাম, গান দিয়ে প্রজন্ম বা অন্য কোনও রকম সামাজিক ভাগ হত না। আমরা যে সব গান শুনে মত্ত হয়ে গলায় তোলার চেষ্টা করতাম, বড়রাও সুকণ্ঠের অধিকারী ছেলেমেয়েদের কাছে সেই গানগুলিই বার বার শুনতে চাইতেন। বা নিজেরাও গাইতেন। বাসর ঘরে সদ্য-বিবাহিত কোনও দিদি বা মামিমাকে অনুরুদ্ধ হয়ে এই সব জানা গানগুলোই গাইতে শুনতাম।
এ কথা ঠিক যে ১৯৪০-এর দশকের গায়কি একটু পুরনো শোনাত কানে, কিন্তু ভালবেসেই তো মা-র কাছে ‘মাধবী রাতে মম মনবিতানে’ গোছের গান শিখতাম, আবার ‘অনুরোধের আসর’ শুরু হলে মা-ও দেখতাম কখন রেডিয়োর সামনে এসে বসেছেন। বাংলা গানের মধ্যে যে ধারাবাহিকতা ছিল, গান যে বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে একটা বন্ধনসূত্র ছিল, তা বই পড়ে জানতে হত না আমাদের, তা ছিল আমাদের জীবনের উপলব্ধ সত্য। এই অর্থেই সেই বোধ ছিল স্বাভাবিকতার অঙ্গ, ঐতিহাসিক কোনও বোধ নয়। শ্রাবন্তী-হেমন্তর ‘আয় খুকু আয়’ বা শ্রাবন্তী-সন্ধ্যার ‘তুমি আমার মা’ — এই সব গানে যে দুই প্রজন্মের বন্ধনগীত গাওয়া হয়েছে, তার ভেতর দিয়ে কি ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ কিংবা ‘ঘুমিয়ে ছিলেম মায়ের কোলে’ ইত্যাদি গানের ও ভাবের ধারা প্রবাহিত হয়ে যায়নি?
১৯৮০-৯০’এর দশকে এসে এই ধারাবাহিকতার, স্বাভাবিকতার বোধটা ভেঙে গেল। বাংলা আধুনিক গান হয়ে উঠল একটি বিগত ‘ঐতিহাসিক’ যুগের চিহ্ন। এক দিকে যে সব শিল্পী-সুরকার-গীতিকার ‘আধুনিক’ গানের ভুবনটির নির্মাতা, তাঁরা একে একে বিদায় নিতে শুরু করলেন। সেই বিদায় নেওয়ার লম্বা সারির শেষের দিকে ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তাঁর সমসাময়িক সুরকার-গীতিকার-শিল্পীরা তাঁর কয়েক দশক পূর্বেই চলে যেতে শুরু করেছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, বাংলা গান নতুন ও অপরিচিত সব মোড় নিচ্ছিল। এখানে প্রথমেই নাম করতে হয় সুমন চট্টোপাধ্যায় বা বর্তমানের কবীর সুমনের। সুমন আমাদের প্রজন্মের মানুষ, তাই পুরনো আধুনিক গানের পুনরুজ্জীবন করতে চেয়েও পুরনোর মায়া সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারেননি বা হয়তো কাটাতে চাননি, তাই তাঁর গানে নতুনত্ব থাকলেও সেই পুরনো ধারাবাহিকতার বোধ একেবারে ছিন্ন হয়নি। অনেক সময় যেন ঠাট্টার সুরেই তাকে ধরে রেখেছেন। কিন্তু বলতে পারেন সুমন এসেই যেন ঘোষণা করে দিলেন বাংলা গান বদলেছে। তার আগে আমার কলেজের সহপাঠী গৌতম চট্টোপাধ্যায়দের ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র গানে এই বক্তব্যের যেন পূর্বধ্বনি শুনেছিলাম। কিন্তু সুমনের সময়েই গানের নতুন নাম হল, ‘জীবনমুখী গান’। শুনে আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম, তা হলে যে সব গান শুনে আমরা জীবনকে ভালবাসতে শিখেছি, সেগুলো সবই কি ‘জীবনবিমুখ’?
হয়তো বাঙালির দুর্যোগের ইতিহাসের বোধ ও চিন্তা বদলাচ্ছিল। আমরা যে যুগের আধুনিক গান— বেসিক বা সিনেমার গান যা-ই হোক— শুনে বড় হয়েছি, তা বড় সুখের সময় ছিল না পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ দেখে পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হয়েছে। মিছিলে, প্রতিবাদে, আন্দোলনে মুখর ও অস্থির সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকের সময়েই মহানগরীতে তৈরি হয়েছে আধুনিক গান ও উত্তম-সুচিত্রা-সাবিত্রী-ছবি-বিকাশ-কমল-ভানু-জহর-অভিনীত নানা ছবি ও তার গান। একই সঙ্গে খেলার মাঠে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের উত্তেজনা। হিন্দু-বাঙালির ইতিহাসের দুর্যোগের কোনও ছায়াই যে সেই সব গান বা ছায়াছবিতে পড়েনি বললে ভুল হবে, কিন্তু এটাও তো ঠিক ওই সময়কার গানে ও চলচ্চিত্রে মধ্যবিত্ত বাঙালি তার নিজের ক্ষয়িষ্ণু চেহারা দেখতে চায়নি, বরং যেন নতুন করে দেশ গড়ার স্বপ্নে হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যা-প্রতিমার কণ্ঠে ও উত্তম-সুচিত্রার অভিনয়ে প্রেমের, ভালবাসার, সংসারের, পারিবারিক মূল্যবোধের একটা স্থায়ী চেহারাই দেখতে চেয়েছে। দেখতে পেয়েওছে বলতে হবে। সে চেহারা বাঙালি, হিন্দু, ভদ্রলোকের ঈপ্সিত সাংসারিক শান্তি ও স্থিতির চেহারা। বলা বাহুল্য, এই স্বপ্ন টেকেনি। আজ ইতিহাসবিদের দৃষ্টি নিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলে মনে হয়, মধ্যবিত্তের এই স্বপ্নের প্রাচীরে ফাটল ধরা, ষাট দশকের অর্থনৈতিক ও খাদ্য সঙ্কট ও বাম রাজনৈতিক শক্তির উত্থান— এ সব পরস্পর-সম্পর্কিত ছিল। বাম জমানা না হলে কি সুমন হতেন? বা নকশাল বিদ্রোহ না হলে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’? এবং তার সব পরবর্তী ব্যান্ডের গান?
বস্তুত, একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন, পুরনো আধুনিক গান ‘জীবনবিমুখ’ আর নতুন, কিছুটা-অবিশ্বাসী, বেকারত্ব-বিষয়ী গানই একমাত্র ‘জীবনমুখী’ ছাপ্পার অধিকারী, এই দাবি জোর করে করার খুব একটা মানে হয় না। যা ষাটের দশকে বা সত্তরের দশকে এসে বদলাচ্ছিল, তা হল ‘জীবনমুখী’ কাকে বলব তার সংজ্ঞা ও অর্থ। আর গানের জগৎও এই পরিবর্তনের বাইরে ছিল না। সন্দেহ নেই যে, এর মূলে মিডিয়ার পরিবর্তন— প্রথমে টেলিভিশন, পরে ক্যাসেট টেপ, ও তারও পরে আন্তর্জালিক ডিজিটাল মিডিয়া— এ সবের একটা ভূমিকা আছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমূলক, সুমন গুপ্ত-অনুলিখিত বই ‘ওগো মোর গীতিময়’ পড়লে এই পরিবর্তনের চেহারা তাঁর মতো মহীয়সী গায়িকার কাছে কী ভাবে প্রতিভাত হচ্ছিল তার খানিকটা আভাস পাওয়া যায়। তাঁর প্রতিবেদনের দু’টি কথা বলে এই ছোট শ্রদ্ধার্ঘ্যটি শেষ করি। দু’টিতেই বিলাপধ্বনি মিলেমিশে আছে, কিন্তু বিলাপ আছে বলেই তার মধ্যে সত্য কিছু নেই, এ কথা ভাবলে নিজেদেরই ঠকানো হবে। তাঁর প্রথম বিলাপ, গান এখন বড় চটজলদি তৈরি হয়, আর হয়ও প্রচুর সংখ্যায়। এই খেদ তাঁর বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। আর তাঁর দ্বিতীয় বিলাপ, সাধনার অভাব নিয়ে। শুধু তো আধুনিক গান করেননি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বড়ে গোলাম আলির কাছে নাড়া বেঁধেছেন, খেয়াল, ঠুংরি, ভজন, হিন্দি গীত— কী গাননি? তাঁর বই পড়লে বোঝা যায়, এই সবই তাঁর আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সাধনার অংশ। সত্যিই তো, সিনেমা, রেডিয়ো, গ্রামোফোন, বাজার ইত্যাদি ছাড়া আধুনিক গানের ইতিহাস হয় না। আবার শিল্পীর সাধনার ইতিহাস ছাড়াও সেই কাহিনি অসম্পূর্ণ থাকে। তাঁর বিলাপে কি কোথাও আমাদের প্রজন্মের কিছু একটা হারানোর দুঃখবোধও বেঁচে থাকে না?
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন। পড়ে রইল তাঁর যুগ, স্মৃতি ও সৃষ্টির প্রতি আমাদের অপরিমিত মায়া, মমতা ও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা।

Advertisement
আরও পড়ুন
Advertisement