মনস্বী: শরৎচন্দ্র দাশ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
জিগমে শেরিং। বয়স চল্লিশের নীচে, কালিম্পঙে অনাথ বাচ্চাদের একটি স্কুল চালায়, দার্জিলিং-চা খায় আর সুস্পষ্ট এবং নির্ভুল উচ্চারণে বাংলা বলে বাঙালিদের লজ্জায় ফেলে দেয়। “এমন বাংলা শিখলেন কোথায়?”— এমনতর প্রশ্ন করলে পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে হেসে বলে, “বাবা লালবাজারে পোস্টেড ছিলেন অনেক বছর। তাঁর হুকুম ছিল...”
আর ভালবাসাটা? মানে, হুকুমে আর কতটা হয়?— শনৈঃ শনৈঃ জন্মে গেছে।
এর পর আর জটায়ু-মার্কা ‘আপনাকে তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে মশাই’ না বলে থাকা যায় না। আর সেই ‘কাল্টিভেশন’-এর প্রসঙ্গ থেকেই উঠে আসে খেদোক্তি— “বাঙালি বাঙালিকেই মনে রাখলে না, তার আমি...”
ভিড় কমে আসা দার্জিলিং মলের চত্বরে দাঁড়িয়ে জিগমের কাছে শুনতে হয় কয়েকশো মিটার দূরে অবহেলায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘লাসা ভিলা’ নামক এক বাড়ির কথা। শুনতে হয় এই বাড়ির মালিক, শরৎচন্দ্র দাশ নামক সেই বিদগ্ধ পণ্ডিতের কথা, যাঁর মৃত্যুর একশো বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই বাঙালি তাঁকে ভুলে বসে আছে। অথচ এই প্রাজ্ঞ অভিযাত্রীর নামে দার্জিলিঙে মলের অদূরেই রয়েছে ‘শরৎচন্দ্র দাশ রোড’।
কোনও এক সময় সাধারণ মানুষের কাছে শরৎচন্দ্রের তিব্বত যাত্রা তাঁকে ব্রিটিশদের ‘গুপ্তচর’ করে তুলেছিল। তিব্বতে থাকাকালীন এবং ভারতে ফিরে এসে তিনি অসংখ্য তিব্বতি পুঁথি সংস্কৃতে অনুবাদ করেছিলেন। বেশ কিছু সংখ্যক তিব্বতি মানুষ শরৎচন্দ্রের সঙ্গে এ দেশে চলে আসেন। তাঁদের একটা বড় অংশ আজও দার্জিলিং, কালিম্পং ইত্যাদি অঞ্চলে বাস করেন। এঁদের কাছে শরৎচন্দ্র ছিলেন গুরুস্থানীয়।
আর যে বাঙালি সেই ভদ্রলোকের নামটুকু শুধু মনে রেখেছে, তাদের কাছে?
জিগমে হেসে বলে, “স্পাই!”
শরৎচন্দ্র দাশের জন্ম ১৮৪৯ সালের ১৮ জুলাই চট্টগ্রামে। পিতা চন্দ্রশেখর দাশ, মাতা স্নেহলতা দেবী। প্রাথমিক লেখাপড়া চট্টগ্রামে। পরে কলকাতায় চলে আসা। প্রেসিডেন্সির ছাত্র ছিলেন। তার পর দার্জিলিং চলে যান।
এটা ঠিক যে, সাহেবদের তিব্বতি সংস্কৃতি ও ভাষা বুঝতে শরৎচন্দ্রের তিব্বত-ভ্রমণ যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। তাঁর প্রথম তিব্বত সফর শুরু হয়েছিল ১৮৭৯ সালে। শরৎচন্দ্রের ভ্রমণের ফলে ব্রিটিশদের তিব্বতি রাজনীতি ও ভূগোল সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ যেমন সম্ভব হয়েছিল, ঠিক তেমনই এই যাত্রা এক বাঙালি পণ্ডিতকে তিব্বতি সংস্কৃতি সম্পর্কেও ঋদ্ধ করে তোলে, ফলত গুপ্তচরবৃত্তির প্রসঙ্গটাকে ভ্রমণের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হিসাবে না-ও ধরা যায়।
শরৎচন্দ্র দাশ ছিলেন এক জন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং দার্জিলিঙের ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সি আর মার্কহ্যাম-এর লেখা ‘ন্যারেটিভস অব এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ইন টিবেট’ (১৯০৪) বইয়ে জানা যায়, শরৎচন্দ্র ১৮৭৪ সালে এই স্কুলে ছাত্র হিসাবে ভর্তি হন। এখানে তখনকার দিনে প্রচুর তিব্বতি তরুণ লেখাপড়া করত। এই কাজটিই শরৎচন্দ্রের তিব্বতি সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তোলে। তিনি ক্রমশ তিব্বতি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশরা শরৎচন্দ্রের জ্ঞান এবং আগ্রহে একটি সম্ভাবনা দেখতে পায়। কারণ, তাদের কাছে তিব্বতের ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল অশেষ।
১৮৭৯-র কিছু আগে দার্জিলিঙে পোস্টেড টমাস গ্রাহাম বেইলি নামক এক ব্রিটিশ অফিসার প্রথম লক্ষ করেন শরৎচন্দ্রের পাণ্ডিত্য। দেবেন ভট্টাচার্যের লেখা ‘অ্যান এক্সপ্লোরার অব টিবেট’ বইয়ে পাওয়া যাচ্ছে, বেইলিই এই বিদগ্ধ বাঙালিকে তিব্বত ভ্রমণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র বুঝতে পারেন, তাঁর ভ্রমণের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক নয়, বরং তাতে রয়েছে তিব্বতের রাজনীতি ও ভূগোল সম্পর্কে তথ্য আহরণের প্রচেষ্টা।
“এইখানে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই,” বলছেন দুর্গাপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক মানস কুণ্ডু, “শরৎচন্দ্র— এই চরিত্রটি নিয়ে বিশেষ কোনও সারস্বত-চর্চা হয়নি বললেই চলে। যেটা হয়েছে এবং রয়েছে, সেটা কৌতূহল। কিছু লোকের কাছে তিনি গুপ্তচর, কিছু লোকের কাছে তিনি ভ্রমণ-কাহিনিকার, আবার কিছু লোকের কাছে তিনি তিব্বতি ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তাঁর বা তাঁর কাজের সার্বিক মূল্যায়ন…” দীর্ঘশ্বাস
পড়ে অধ্যাপকের।
তবে এটা ঠিক, তিব্বত ও শরৎচন্দ্রকে আলাদা করে দেখা যাবে না।
শরৎচন্দ্র তাঁর প্রথম তিব্বত অভিযানের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন সিকিমের এক তিব্বতি লামাকে। তাঁর নাম উগিয়েন গায়াতসোকে। উগিয়েন ছিলেন শরৎচন্দ্রের গাইড এবং অনুবাদক। অজুহাত ছিল তীর্থযাত্রা। কারণ, তখন বহিরাগত বিদেশিদের তিব্বতে সন্দেহের চোখে দেখা হত। কিন্তু এই অজুহাতই শরৎচন্দ্রের বৌদ্ধ ধর্ম এবং তিব্বতি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
তখনকার তিব্বত যাত্রা ছিল নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। পেরোতে হয়েছিল হিমালয়ের প্রমুখ গিরিবর্ত্মগুলি। শরৎচন্দ্র ও উগিয়েন প্রথমে পৌঁছন শিগাৎসের তাশিলুনপো মঠে। এই মঠে শরৎচন্দ্র বেশ কয়েক মাস কাটান তিব্বতি গ্রন্থ অধ্যয়ন এবং অনুবাদ করে। এই মঠ ছিল পাঞ্চেন লামার আসন। তিব্বতীয় আধ্যাত্মিক জগতে দলাই লামার পরেই পাঞ্চেন-এর স্থান। ফলে এই স্থানে থাকাকালীন শরৎচন্দ্র বৌদ্ধ ধর্মের অনেকটাই কাছে আসতে পেরেছিলেন। পাঞ্চেন লামা তাঁকে মঠের বিস্তৃত গ্রন্থাগারে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন, যেখানে তিব্বতি সাহিত্য এবং ধর্মীয় পাণ্ডুলিপির একটি মূল্যবান সংগ্রহ ছিল।
শরৎচন্দ্রের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য পাঞ্চেন লামাকে মুগ্ধ করে এবং তিনিই এই বাঙালি পণ্ডিতকে কয়েকটি বিরল পাঠ্য অনুবাদের প্রস্তাব দেন। এই সাক্ষাৎকার শুধুমাত্র শরৎচন্দ্র দাশের সঙ্গে তিব্বতি ধর্মগুরুদের বোঝাপড়া সমৃদ্ধ করেনি, বরং তাঁকে তিব্বতি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি বিশ্বাসের বন্ধনেও আবদ্ধ করেছিল।
পরবর্তী কালে শরৎচন্দ্রের লেখা ‘জার্নি টু লাসা অ্যান্ড সেন্ট্রাল টিবেট’ (১৯০২) বইয়ে লেখক লিখছেন: “ইন শিগাৎসে, আই ওয়াজ় ওয়ার্মলি রিসিভড বাই দ্য পাঞ্চেন লামা, হু শোড গ্রেট ইন্টারেস্ট ইন মাই নলেজ অব টিবেটান কালচার অ্যান্ড বুদ্ধিজ়ম। ডিউরিং মাই স্টে অব সেভেরাল মান্থস, আই ডিভোটেড মাইসেল্ফ টু কালেক্টিং ভ্যালুয়েবল ম্যানুস্ক্রিপ্টস, কনডাক্টিং ইন-ডেপথ রিসার্চ অন টিবেটান বুদ্ধিজ়ম, অ্যান্ড অবজ়ার্ভিং দ্য লোকাল কাস্টমস অ্যান্ড ওয়ে অব লাইফ। আই অলসো ম্যাপড সেভেরাল রিজিয়নস দ্যাট ওয়াজ় প্রিভিয়াসলি আনচার্টেড অ্যান্ড ডকুমেন্টেড মাই ফাইন্ডিংস এক্সটেনসিভলি।”
তবে গোয়েন্দাগিরিকে অগ্রাহ্য করাও শরৎচন্দ্রের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ, তাঁর প্রধান ‘টাস্ক’ হিসেবে সেটাই তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার স্থির করে দিয়েছিল। ফলে তাঁকে সংগ্রহ করতে হয় ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক তথ্য। তিব্বতি সমাজ, সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সংক্রান্ত তাঁর পর্যবেক্ষণগুলি তিনি বিস্তারিত ভাবে লিপিবদ্ধ করেন। তিনিই তৈরি করেন তিব্বতের ম্যাপ, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ব্রিটিশ সরকারের কাছে মূল্যবান হয়ে পড়েছিল।
“এই যে থেকে থেকেই তিব্বতের প্রসঙ্গ চলে আসছে, এখানে কিন্তু বলতে হয় শরৎচন্দ্রের আগেও যে বাঙালি তিব্বতি ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধান রচনা করেছিলেন তাঁর নাম— কৃষ্ণকান্ত বসু। সেটা ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকের ঘটনা,” জানাচ্ছেন অধ্যাপক কুণ্ডু, “যদিও তিব্বতি লামাদের সঙ্গে ইংরেজদের যোগাযোগ কিন্তু তারও আগের ঘটনা। আমাদের মধুকবির বন্ধু গৌরদাস বসাক লিখছেন, ‘ভারতীয় আচার্য ও সরকারী দূত’ অভিহিত হাওড়ার সাংখ্যযোগী পূরণ গিরি গোঁসাই
কলকাতা থেকে নেপাল ও মানস-সরোবর হয়ে তিব্বতে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এই যাতায়াতের মাধ্যমে যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ ও তিব্বতিদের মধ্যে, তাতে ক্রমশ চিড় ধরতে শুরু করে। শরৎচন্দ্রের তিব্বত ভ্রমণের পরে এই সম্পর্ক সমস্যাসঙ্কুল
হয়ে দাঁড়ায়।”
যাই হোক, শরৎচন্দ্রকে তাঁর তিব্বত ভ্রমণকালে খুব সাবধানে দিন কাটাতে হত। জানা যায়, সন্দেহ এড়াতে তিব্বতি জীবনযাপনে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন তিনি। তিব্বতি পোশাক পরতেন, স্থানীয় খাবার খেতেন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। পরবর্তী কালে ‘ন্যারেটিভ অব আ জার্নি টু লাসা ইন ১৮৮১-১৮৮২’ বইয়ে তিনি এই জীবনধারার বিবরণ দেন।
ফিরতি পথে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে শরৎচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গী সমস্যায় পড়লেও একটুর জন্য রক্ষা পান। তাঁরা ফিরছিলেন সিকিমের পথ ধরে। গ্যাংটকের কাছে কয়েক জন তিব্বতি কর্মকর্তা তাঁদের পথ আটকান। শুরু হয় জেরা। এই অবস্থায় শুধুমাত্র তিব্বতি ভাষায় দক্ষতার সঙ্গে কথা বলে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি সামলেছিলেন শরৎচন্দ্র। তিনি লিখছেন— “উই ওয়্যার স্টপড বাই আ পার্টি অব টিবেটান অফিশিয়ালস হু কোয়েশ্চেনড আস ক্লোজ়লি অ্যাবাউট আওয়ার জার্নি। ইউজ়িং মাই ফ্লুয়েন্সি ইন টিবেটান অ্যান্ড আওয়ার কভার স্টোরি অব বিয়িং পিলগ্রিমস, উই ম্যানেজড টু অ্যালে দেয়ার সাসপিশনস অ্যান্ড কনটিনিউ অন আওয়ার ওয়ে। ইট ওয়াজ় আ ন্যারো এসকেপ, বাট আওয়ার কুইক থিঙ্কিং অ্যান্ড ইমারশন ইন দ্য লোকাল কালচার সেভড আস।”
এই সফল পলায়ন এবং মূল্যবান তথ্য-পাণ্ডুলিপি’সহ ভারতে প্রত্যাবর্তনকে ব্রিটিশরা এক জয়লাভ হিসেবে দেখেছিল।
১৮৮১ সালে শরৎচন্দ্র দাশের দ্বিতীয় বার তিব্বত যাত্রা তাঁর প্রথম যাত্রার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তিব্বতের অধ্যয়ন এবং অনুসন্ধানের ভিত্তি আরও দৃঢ় করেছিল তা। স্বভাবতই এই দ্বিতীয় যাত্রাতেও রাজনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তির একটি প্রসঙ্গ চলে আসে।
শরৎচন্দ্রের প্রথম তিব্বত যাত্রার পর তিনি এক জন পণ্ডিত ও অভিযাত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। কাজেই তাঁর দ্বিতীয় তিব্বত যাত্রার প্রেরণা হয়ে উঠেছিল একাধারে অ্যাকাডেমিক কৌতূহল এবং ব্রিটিশ ভারত সরকারের কৌশলগত স্বার্থ। ব্রিটিশরা তিব্বতের রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তাদের জ্ঞান বাড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করে। তার প্রধান কারণ ওই অঞ্চলটি। মধ্য এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যে কৌশলগত
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিব্বত অধিকারের প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল।
দ্বিতীয় বারও যাত্রার প্রস্তুতি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। শরৎচন্দ্র আবারও এক জন বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন, এবং এ বারও তাঁর সঙ্গী ছিলেন লামা উগিয়েন গায়াতসোকে। এ বার অভিযানে অতিরিক্ত সহায়তা ছিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের, তাঁরা আর্থিক সহায়তা করেছিলেন এবং তিব্বত বিষয়ক বিস্তারিত প্রতিবেদন চেয়েছিলেন।
১৮৮১ সালের শরতে দার্জিলিং থেকে শুরু হয় যাত্রা। শরৎচন্দ্র নাথু লা পাস পেরিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করে প্রথম বারের রাস্তাই অনুসরণ করেন। এ বারেও ঝুঁকি ছিল তিব্বতি বা চিনা কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ার।
শরৎচন্দ্রের দ্বিতীয় যাত্রার একটি প্রধান আকর্ষণ ছিল তিব্বতের রাজধানী লাসায় ভ্রমণ। তিনি এক জন ভিক্ষুর ছদ্মবেশে লাসায় প্রবেশ করেন এবং সেখানে কয়েক মাস থাকেন।
এই সময়ের মধ্যে তিনি শহরের স্থাপত্য, মঠ ও দৈনন্দিন জীবনের বিস্তারিত নথি তৈরি করেন। তাঁর পোটালা প্যালেস, জোখাং মন্দির অথবা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্থানগুলির বর্ণনা পশ্চিমের কাছে পেশ করা প্রথম বিস্তারিত বিবরণ। ‘জার্নি টু লাসা অ্যান্ড সেন্ট্রাল টিবেট’ বইয়ে তিনি লিখছেন— “ইন লাসা, আই হ্যাড দি অপারচুনিটি টু ভিজ়িট দ্য গ্র্যান্ড পোটালা প্যালেস অ্যান্ড দ্য সেক্রেড জোখাং টেম্পল। দ্য পোটালা প্যালেস, উইথ ইটস ম্যাগনিফিশেন্ট আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইনট্রিকেট ডিজ়াইনস, স্ট্যান্ডস অ্যাজ় আ টেস্টামেন্ট টু টিবেটান আর্টিস্ট্রি অ্যান্ড স্পিরিচুয়াল ডিভোশন। দ্য জোখাং টেম্পল, অন দ্য আদার হ্যান্ড, ইজ় আ ভাইব্র্যান্ট সেন্টার অব ওয়রশিপ, হোয়্যার পিলগ্রিমস ফ্রম অল ওভার টিবেট গ্যাদার টু পে দেয়ার রেসপেক্টস। দিজ় এক্সপিরিয়েন্সেস অ্যালাউড মি টু ডকুমেন্ট দ্য রিচ কালচারাল হেরিটেজ অ্যান্ড রিলিজিয়াস প্র্যাকটিসেস অব দ্য টিবেটান পিপল, প্রোভাইডিং আ ডিটেলড অ্যাকাউন্ট ফর দ্য ফার্স্ট টাইম টু ওয়েস্টার্ন স্কলার্স।”
লাসায় থাকাকালীন তিনি অনেক পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন, তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্ম এবং স্থানীয় রীতিনীতি সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন করেন। তিনি বেশ কয়েক জন উচ্চপদস্থ লামা এবং কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন, যা তাঁকে সীমাবদ্ধ এলাকায় প্রবেশ এবং তথ্য সংগ্রহের অধিকার দিয়েছিল। তাঁর ভাষাগত দক্ষতা, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের গভীর জ্ঞান স্থানীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে আস্থা ও সম্মান অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শরৎচন্দ্রের দ্বিতীয় যাত্রার অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল এক জন সিনিয়র তিব্বতি কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন। তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে সেই কর্মকর্তা তাঁকে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ করেন। শরৎচন্দ্র তাঁর তিব্বতি ধর্মগ্রন্থের গভীর জ্ঞানের দৃষ্টান্তে শুধু কর্মকর্তার সন্দেহ দূর করতেই সক্ষম হননি, বরং তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেন যে, সেই কর্মকর্তা লাসায় তাঁর থাকার জন্য সহায়তা প্রস্তাব করেন। সেই কর্মকর্তা ছিলেন ‘প্রাইম মিনিস্টার’। তাঁর নাম কালন লামা উগিয়েন গায়াতসো।
তাঁর লেখায় পাওয়া যায় যে, এই সময় তিব্বতে থাকাকালীন শরৎচন্দ্র লাসার একটি প্রধান মঠে ধর্মীয় বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর বাগ্মিতা ও বৌদ্ধ দর্শনের গভীর জ্ঞান তাঁকে ভিক্ষুদের প্রশংসা অর্জন করতে সাহায্য করে এবং তিব্বতি কর্তৃপক্ষের চোখে এক জন প্রকৃত পণ্ডিত হিসেবে তাঁর অবস্থানকে আরও পোক্ত করে তোলে।
শরৎচন্দ্র ১৮৮২ সালের বসন্তে ভারতে ফিরে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন বেশ কিছু তিব্বতি পাণ্ডুলিপি, মানচিত্র এবং নৃবিজ্ঞান সম্পর্কিত নোট। লাসা ও তিব্বতের অন্যান্য অংশের উপর তাঁর লেখা বিস্তারিত প্রতিবেদনগুলি ব্রিটিশ সরকার এবং অ্যাকাডেমিক সম্প্রদায় উভয়ের কাছেই
অত্যন্ত মূল্যবান।
তিনি যে তিব্বতি বইগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল ‘দ্য পাগ-সাম-জোন-জাং’ যার ইংরাজি অনুবাদ ‘হিস্ট্রি অব বুদ্ধিজ়ম ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড টিবেট’ (১৯০২), ‘আ টিবেটান-ইংলিশ ডিকশনারি’ যা শরৎচন্দ্র দ্বারা সঙ্কলিত এবং আংশিক ভাবে অনূদিত (প্রথম খণ্ড ১৯০২ এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৯০৪) এবং ‘গ্রুব-মথা সেল-গি মে-লং’ যার ইংরাজি অনুবাদ ‘দ্য মিরর ইলুমিনেটিং দ্য ডকট্রিনস’ (১৯০৮)।
“তিনি লিখেছেন বহু প্রবন্ধ— তিব্বতি বিবাহ থেকে শ্রাদ্ধ প্রক্রিয়া, দণ্ডনীতি থেকে তিব্বতি কারাগার এবং অবশ্যই মহাযান বৌদ্ধধর্মের শাখাপ্রশাখা থেকে তিব্বতের প্রাচীন বন-ধর্ম— যা কিন্তু আকর-রচনার মর্যাদা পাবে,” জানাচ্ছেন অধ্যাপক কুণ্ডু।
শরৎচন্দ্রে মুগ্ধ পাঠিকা ও একটি প্রকাশনের কর্ণধার ঐত্রেয়ী সরকার সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন ‘অটোবায়োগ্রাফি: ন্যারেটিভস অব দ্য ইনসিডেন্টস অব মাই আর্লি লাইফ’। তাঁর কথায়, “শরৎ দাশ-এর যেটুকু আমরা জানি, সেটুকু হিমশৈলের চূড়ামাত্র। তিনি শুধু কার্টোগ্রাফার হিসেবেই বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারতেন। তার সঙ্গে তিনি অনুবাদক ও তিব্বত-বিশেষজ্ঞ। তাঁর ‘গুপ্তচর’ পরিচয়টি আমার কাছে অন্তত আর গুরুত্ব বহন করে না। পাহাড়ে এবং সমতল বঙ্গদেশে মানুষ তাঁকে নতুন করে জানুক। ইন্টারডিসিপ্লিনারি পড়াশোনার যুগে এমন একটি মানুষকে নতুন করে আবিষ্কার করার প্রয়োজন ব্যক্তিগত ভাবে আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।”