ধারাবাহিক উপন্যাস।। পর্ব ১১ ।।
Bengali Serial Novel

অনন্ত পথের যাত্রী

নৃসিংহ সেই দেবালয়ের বন্ধ দরজার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর সারা শরীর বেয়ে জল ঝরছে। তাঁর মনে সন্দেহের উদ্রেক হল, কেউ যদি না থাকে! তিনি ভাল করে লক্ষ করলেন।

Advertisement
অবিন সেন
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ০৫:৫৩

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

পূর্বানুবৃত্তি: গোবিন্দ বিদ্যাধর মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেবের ভ্রাতুষ্পুত্র বজ্রদেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন বটুকেশ্বরের। জানালেন, বজ্রদেব শীঘ্রই দাক্ষিণাত্যে যাবেন যুদ্ধ করতে। আর বটুকেশ্বর যেন মানুষের মনে অসন্তোষ তৈরির কাজটা করে যায়। তার পর বিদ্যাধর জিজ্ঞেস করলেন নদিয়া থেকে আসা সন্ন্যাসীর ব্যাপারে। সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মতো পণ্ডিতকে যে বশ করতে পারে, তার সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করলেন বিদ্যাধর। বললেন, বটুকেশ্বর যেন তাঁর খবর রাখে। বটুকেশ্বর চলে গেলে বনমালী নামের আর এক চরকে ডেকে বিদ্যাধর নির্দেশ দিলেন, সে যেন বজ্রদেব আর বটুকেশ্বর, দু’জনের উপরেই নজর রাখে। অন্য দিকে, এক অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করেছে নৃসিংহ উপরায়কে। কিছুই ভাল লাগে না। গুরু কাহ্নদেবের পরামর্শে অস্ত্রচালনা অনুশীলন করেও তাঁর বিমর্ষতা কাটে না। বিষণ্ণ মনে এক সন্ধ্যায় বৃষ্টির মধ্যেই ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। পৌঁছন রাজপ্রাসাদের পিছন দিকে। সেখানে রয়েছে একটি অপ্রশস্ত কিন্তু গভীর পরিখা।

Advertisement

অনুমানে ভর করে তিনি সেই পরিখার জলে নেমে পড়লেন। অন্ধকারে সাঁতরে পার হওয়া সহজ নয়। তিনি বিপুল পেশিশক্তিতে বাহু সঞ্চালনা শুরু করলেন। পরিখা পার হওয়ার পরে তাঁর সামনে একটি প্রাচীর পড়ল। দেড় মানুষ সমান উঁচু। নৃসিংহ সেটি অনায়াসেই পার হয়ে গেলেন। তার পরে একটি গাছপালা ঘেরা উদ্যানের মতো নিবিড় বনাঞ্চল। এই দিকটা রাজপ্রাসাদের পিছনের দিক। এই দিকে তেমন কেউ আসে না। এই উদ্যানের অপর প্রান্তে, ছোট একটি দেবালয়। সেখানে বহুমূল্য রত্নখচিত রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপিত।

নৃসিংহ সেই দেবালয়ের বন্ধ দরজার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর সারা শরীর বেয়ে জল ঝরছে। তাঁর মনে সন্দেহের উদ্রেক হল, কেউ যদি না থাকে! তিনি ভাল করে লক্ষ করলেন। অবলোকন করলেন, কপাটের ফাঁকে সরু আলোর রেখা।

আশায় ভর করে তিনি ধীরে ধীরে তিন বার সাঙ্কেতিক টোকা দিলেন দরজায়। কয়েক মুহূর্ত তাঁকে অপেক্ষা করতে হল।

দেখলেন, ধীরে ধীরে দরজাটা একটু ফাঁক হল। আবছা একটি মুখ ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা এক টুকরো মৃদু আলোয় তাঁর মুখ দেখে আঁতকে উঠল যেন। তার পরে দরজাটা হাট করে খুলে গেল।

রাজকুমারীর প্রিয় সখী শ্যামা বিস্মিত হয়ে বলল, “এ কী! আর্য আপনি!”

পরক্ষণেই তার মুখ নির্মল হাসিতে ভরে উঠল। সে অভিবাদন জানিয়ে বলল, “আসুন আর্য। প্রিয়সখী ভিতরেই আছেন।”

অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শ্যামা একটু হাসল।

নৃসিংহকে এই অবস্থায় দেখে রাজকুমারী তুক্কা চমকে উঠে দাঁড়ালেন। আজ তিনি নিরাভরণা। একটি সাধারণ শুভ্র বস্ত্র তাঁর পরনে।

নৃসিংহ তাঁর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেন। কী আশ্চর্য স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছিল রাজকুমারীকে। নৃসিংহ মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালেন। তাঁর সারা গা থেকে বারিবিন্দুসকল ছিটকে পড়ল।

রাজকুমারী একটু এগিয়ে এলেন তাঁর দিকে। বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, “আপনি কোন পথে এলেন? প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে?”

এত দিন তাঁরা পুরীতে সমুদ্রের তীরবর্তী রাজকুমারীর সেই সঙ্গীতগৃহে সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু এমন হঠকারিতা নৃসিংহ কখনও করেননি।

উত্তরে নৃসিংহ মৃদু হেসে অঙ্গুলি নির্দেশ করে পিছনের বনপথের দিকটা দেখিয়ে দিলেন।

রাজকুমারী সব বুঝতে পারলেন। অমলিন হাসিতে তাঁর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তবু তিনি বললেন, “আমি যদি আজ এখানে না আসতাম! এই বৃষ্টিবাদল মাথায় নিয়ে!”

নৃসিংহ মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় বললেন, “আমি মনে মনে নিশ্চিত জানতাম আপনি আসবেন।”

সহসা শ্যামা কোথা থেকে শুষ্ক শুভ্র বস্ত্র জোগাড় করে নিয়ে এসেছে।

তুক্কা মৃদু হেসে বললেন, “আপনি সিক্ত বস্ত্র পরিবর্তন করে আসুন আর্য।”

নৃসিংহ মৃদু আপত্তি করতে গিয়েও রাজকুমারীর নির্দেশ অমান্য করতে পারলেন না। শ্যামাকে অনুসরণ করে পাশের ঘরে উপস্থিত হলেন।

শ্যামা একটি শয্যায় বস্ত্রগুলি রেখে খিলখিল করে হেসে বলল, “প্রিয়সখীর বস্ত্র পরে দেখুন আর্য, মনে হবে সখীর স্পর্শ লেগে আছে দেহে।”

পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে শ্যামা বলল, “বাচালতা ক্ষমা করবেন আর্য!”

বস্ত্র পরিবর্তন করে রাজকুমারীর কাছে ফিরে আসার পর নৃসিংহ লক্ষ করলেন, তাঁদের দু’জনের পোশাক একেবারে এক রকম।

নৃসিংহ বসলে রাজকুমারী একটি রেকাবিতে তাঁর আরাধ্য রাধাকৃষ্ণের প্রসাদ নিয়ে এসে পাশে বসলেন। বললেন, “এখানে তো আর কিছু নেই। প্রসাদ নিন। এটুকু আপনাকে খেয়ে নিতে হবে।”

রেকাবি থেকে একখণ্ড মিষ্টান্ন মুখে দিয়ে তিনি রাজকুমারীর দিকে তাকালেন। দেখলেন, রাজকুমারী তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। সে চোখের ভাষা আশ্চর্য মায়াবী। নৃসিংহের বুকের ভিতরটা যেন কেঁপে উঠল। অনুভব করলেন, রাজকুমারীর একটা আঙুল তাঁর আঙুল স্পর্শ করেছে।

নৃসিংহের মুখের ভাষা যেন হারিয়ে গিয়েছে। তিনি শুধু যেন বলতে পারলেন, “রাজকুমারী!”

আর কোনও কথা ফুটল না তাঁর মুখে।

অনুভব করলেন, রাজকুমারী আরও ঘন হয়ে বসেছেন তাঁর পাশে। তাদের আঙুলে আঙুল শৃঙ্খলিত হয়ে গিয়েছে। রাজকুমারী মৃদু ধরা গলায় বললেন, “রাজকুমারী নয়। বলো তুক্কা।”

নৃসিংহের গলায়ও যেন সেই অনুপম কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হল, “তুক্কা!”

“তোমার তুক্কা।”

“আমার তুক্কা!”

এমন বিভোর ভাবে যে কতটা সময় কেটে গেল, তাঁদের কোনও খেয়াল রইল না।

সহসা শ্যামার গলায় তাঁদের দুজনের সম্বিৎ ফিরে আসে। সে বলল, “রাজকুমারী, অনেক রাত্রি হয়ে গিয়েছে। এ বার তো ফিরতে হবে।”

তাঁদেরও চমক ভাঙল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দু’জনে উঠে পড়লেন।

শ্যামা বলল, “আর্য, আপনাকে আর ওই পথ দিয়ে ফিরে যেতে হবে না। আমার সঙ্গে চলুন, আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

নৃসিংহ বললেন, “কিন্তু আমার যে ঘোড়া বাঁধা আছে পরিখার কাছে।”

শ্যামা মৃদু হেসে বলল, “আমি আপনাকে সেখানেই পৌঁছে দেব আর্য।”

যাওয়ার আগে নৃসিংহ এক বার পিছু ফিরে দেখলেন রাজকুমারীকে, গভীর দৃষ্টিতে তুক্কা তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন।

কোনও এক গোলকধাঁধার মতো সুড়ঙ্গপথ দিয়ে নৃসিংহ পরিখার ও পারে গিয়ে হাজির হলেন। সহসা বিদ্যুৎ ঝলক দিয়ে উঠল। সেই আলোকে নৃসিংহ অবাক হয়ে দেখলেন, সামনের ঝোপঝাড়ের পথ দিয়ে একটি মানুষের অবয়ব দ্রুত পলায়ন করছে।

১২

মহাপ্রভুর দাক্ষিণাত্য গমনের পরেও তাঁকে নিয়ে আলোচনা থামেনি শ্রীক্ষেত্রে। দেবকান্তি সেই তরুণ সন্ন্যাসীর কথা লোকের মুখে মুখে ভ্রমরগুঞ্জনের মতো উড়ে বেড়াচ্ছিল।

মহারাজা প্রতাপরুদ্রদেবের কানেও সেই খবর পৌঁছেছিল। মনে মনে তিনি ভাবছিলেন, কে এই আশ্চর্য সন্ন্যাসী, যে কিনা পণ্ডিতচূড়ামণি সার্বভৌম ভট্টাচার্যকে শাস্ত্র আলোচনায় পরাজিত করেছেন! ভট্টাচার্যমশাই হয়ে পড়েছেন তাঁর একান্ত অনুগত!

এক দিন তিনি সার্বভৌম ভট্টাচার্যকে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠালেন।

রাজসভার পাশে মাঝারি মাপের একটি ঘরে মহারাজা রোজ পারিষদদের সঙ্গে মিলিত হন। রাজসভায় যে সব বিষয়ে আলোচনা করা যায় না, সেই সব বিষয় নিয়ে তিনি এই ঘরেই আলোচনা করেন। ঘরটি রাজকীয় রুচিতে সুসজ্জিত এবং ভিতর ও বাহির উভয় দিক থেকেই শব্দনিরুদ্ধ।

সভাশেষে মহারাজা প্রতাপরুদ্রদেব তাঁর একান্ত গোপনীয় এই ঘরে এসে বসলেন। গজপতিরাজ প্রতাপরুদ্রদেব শৌর্য-বীর্যে মহা পরাক্রমশালী। বার বার তিনি পার্শ্ববর্তী রাজ্যের শত্রুর আক্রমণ থেকে ওড়িশাকে রক্ষা করেছেন। উন্নতশির সুপুরুষ বীর তিনি। এই মুহূর্তে তাঁর সারা মুখমণ্ডল ভ্রুকুটিকুটিল। বিগত তিন বৎসর ধরে বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে চলা যুদ্ধকে তিনি কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না। গোদাবরীর তীরবর্তী কিছু অঞ্চল বিজয়নগরের অধীনে চলে গিয়েছে।

তার উপরে আবার তাঁর শিরঃপীড়া বাড়িয়ে দিয়েছে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহ। প্রধান সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধরের অবিমৃশ্যকারিতায় হুসেন শাহকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়েও তিনি দিতে পারেননি। তিনি জানেন, সর্পকে সম্পূর্ণ বিনাশ না করে শান্তি নেই। যে কোনও দিন আবার বিপুল বিক্রমে হুসেন শাহ উৎকল আক্রমণ করতে পারে। ঘরে বাইরে শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। ঊর্ধ্বপানে মুখ তুলে তিনি ভাবতে লাগলেন, দিকে দিকে ক্রমশ যেন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। কী উপায়ে তিনি পাবেন তিমিরবিনাশী আলোর দিশা?

গৌরবর্ণ কপালে তাঁর বিন্দু বিন্দু স্বেদ জমতে শুরু করেছে। ভিতরে ভিতরে খুব ক্লান্তি বোধ করলেন তিনি। তিনি কি বৃদ্ধ হয়ে পড়ছেন!

এক কিঙ্করী সুরার পাত্র নিয়ে এসে তাঁর সামনে সাজিয়ে দিতে তিনি এক চুমুকে পাত্রের সুরা শেষ করে গা এলিয়ে দিলেন। মনে মনে ভাবলেন, পুত্র বীরভদ্রদেবের হাতেই তিনি এ বার দাক্ষিণাত্য যুদ্ধের ভার ছেড়ে দেবেন।

এক কিঙ্কর জানাল, সার্বভৌম ভট্টাচার্য এসেছেন। মহারাজ তাঁকে ভিতরে নিয়ে আসতে বললেন। ইশারা করে ঝালরের ব্যজনরত পরিচারিকাকে ঘর থেকে চলে যেতে বললেন।

সার্বভৌম ভট্টাচার্য কখনও মহারাজের এই গোপন কক্ষে আসেননি। তিনি চার পাশে তাকাতে তাকাতে সঙ্কুচিত ভাবে ঘরে এসে প্রবেশ করে মহারাজাকে অভিবাদন জানালেন।

প্রাথমিক গৌরচন্দ্রিকা শেষে মহারাজা জানতে চাইলেন, “শুনেছি, আপনার কাছে নদে থেকে কোনও এক তরুণ সন্ন্যাসী এসেছিলেন?”

“রাজাধিরাজ ঠিকই শুনেছেন।”

মহাপ্রভুর কথা বলতে গিয়ে ভট্টাচার্যমশাইয়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সহসা একটা আবেগের দমক যেন তাঁর অন্তরকে অধিকার করে নিল। এক নিঃশ্বাসে তিনি মহাপ্রভুর যাবতীয় পরিচয়-বৃত্তান্ত আউড়ে গেলেন। এমনকি তর্কে মহাপ্রভুর কাছে তাঁর পরাজিত হওয়ার কথা বলতেও তিনি লজ্জা বোধ করলেন না। মহাপ্রভুর কাছে পরাজিত হওয়াটাও যেন তাঁর কাছে পরম সৌভাগ্যের, পরম কৃপার বিষয়। বলতে বলতে পণ্ডিতচূড়ামণি ভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়লেন যেন। তাঁর দুই চক্ষু সজল হয়ে উঠল।

সার্বভৌম ভট্টাচার্যমশাইয়ের এই ভাববিহ্বলতা দেখে মহারাজা বিস্ময়াপন্ন হলেন। মুখে বললেন, “তবে এক দিন এই ব্যক্তিকে আমার সাক্ষাতে নিয়ে আসুন চূড়ামণিমশাই।”

ভট্টাচার্য বললেন, “তিনি সন্ন্যাসী মানুষ। সর্বদা বিরলে নির্জনে থাকতেই পছন্দ করেন। রাজত্ব বৈভবের সংস্পর্শে আসার বাসনা তাঁর নেই। তবু এক দিন নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ করাতাম। কিন্তু তিনি মাত্র অষ্টাদশ দিবস আমার আলয়ে অবস্থান করে দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে চলে গেলেন।”

মহারাজ বললেন, “প্রভু জগন্নাথের সান্নিধ্য ছেড়ে কেন তিনি চলে গেলেন?”

ভট্টাচার্য বললেন, “এই তো মহাপুরুষের লীলা। তীর্থক্ষেত্রকে পবিত্র করার ছলে তাঁরা তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করেন। সেই সঙ্গে পাপী-তাপীদের উদ্ধার করেন।” একটু থেমে তিনি আবার বললেন, “তিনি তো সাধারণ বৈষ্ণব সন্ন্যাসী নন। তিনি মনুষ্যলীলায় সাক্ষাৎ ঈশ্বর।”

মহারাজা মনে মনে ভাবলেন, পণ্ডিতচূড়ামণির মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তি যখন এমন কথা বলছেন, তখন নিশ্চয়ই এ অবিশ্বাস্য নয়। মুখে বললেন, “আপনার মতো সুপণ্ডিত ব্যক্তির মুখে এমন প্রশংসা, সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।”

“মহারাজ, নিশ্চয়ই আপনি তাঁর সাক্ষাৎ পাবেন। দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ শেষে তিনি নীলাচলে ফিরে আসবেন।” একটু থেমে তিনি বললেন, “মহারাজের কাছে এই অধমের একটি নিবেদন আছে।”

এত ক্ষণে যেন মহারাজের মুখে হাসির স্পর্শ দেখা গেল। তিনি স্মিত হেসে বললেন, “পণ্ডিতমশাই, আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন।”

“মহাপ্রভুর জন্য নির্জনে বসবাসের এক স্থান ভিক্ষা করি,” বলতে বলতে পণ্ডিতচূড়ামণি দুই হাত এক করে প্রণামের ভঙ্গি করলেন।

মহারাজ এক মুহূর্ত যেন মনে মনে ভাবলেন। হয়তো মহাপ্রভুর জন্য উপযুক্ত স্থানের অন্বেষণ করলেন। তার পর বললেন, “উনি ফিরে এলে, আপনি বরং রাজপণ্ডিত কাশী মিশ্রের গৃহেই মহাপ্রভুর থাকার ব্যবস্থা করে দিন। কাশী মিশ্রের গৃহ জগন্নাথ মন্দিরের কাছেই, ফলে মহাপ্রভুর প্রত্যহ দেবদর্শনেরও সুবিধে হবে।”

পণ্ডিতচূড়ামণি এই সিদ্ধান্তে বিশেষ খুশি হলেন। তিনি সত্বর বলে উঠলেন, “যাই তবে, কাশী মিশ্র মহাশয়ের কাছে গিয়ে মহারাজের অভিপ্রায় জ্ঞাত করি। আমি নিশ্চিত, তিনি এই সিদ্ধান্তে যারপরনাই প্রীত হবেন।”

সার্বভৌম ভট্টাচার্য বিদায় নিলে মহারাজা আবার সুরাপানে মনোযোগী হলেন। আজকাল তিনি সুরাপানে বড্ড বেশি আসক্ত হয়েছেন। আগে তিনি এতটা সুরাপান করতেন না। কিন্তু দিনে দিনে একটা হতাশা ক্রমশ তাঁকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এক কালের পরাক্রমশালী বীর যেন ক্রমশ চিন্তাদীর্ণ, দুর্বল হয়ে পড়ছেন। তাঁর পিতা পুরুষোত্তমদেবের পূর্বে উৎকল শাসন করেছেন সূর্যবংশীয় কপিলেন্দ্রদেব। দক্ষিণের মুসলমান রাজাদের মূলোৎপাটন করে তিনি বিজয়নগর-বাহমনী পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেছেন। আর এখন? বিজয়নগরের রাজা ক্রমশ তাঁর রাজ্যের সীমানা অধিকার করে নিচ্ছেন। কথাটা ভাবতে ভাবতে আরও কয়েক পাত্র সুরা তিনি নিমেষে পান করে ফেললেন।

নেশার উত্তেজনা সবে তাঁর মাথায় চড়ে বসতে শুরু করেছে, তখনই এক কিঙ্কর এসে জানাল, প্রধান সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধর মহারাজের দর্শনপ্রার্থী।

প্রতাপরুদ্রদেব তাঁকে নিয়ে আসতে বললেন। তাঁর মুখ ভ্রুকুটিকুটিল হয়ে উঠল।

ক্রমশ

Advertisement
আরও পড়ুন