জম্মু ও কাশ্মীরের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে বহু মামলা দায়ের হয়েছিল। সেগুলি একত্রে এনে সম্প্রতি শুনানি শুরু করে দেশের শীর্ষ আদালত। সোমবার তার রায়দান করল শীর্ষ আদালত।
২০১৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদটি বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার বিলোপ করেছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। সেই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য, অনুচ্ছেদ ৩৭০-এ জম্মু ও কাশ্মীরকে যে বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছিল, তা সাময়িক। কাশ্মীরের গণপরিষদ বাতিল হয়ে যাওয়ার পরেও রাষ্ট্রপতির ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করার অধিকার ছিল। ফলে যা হয়েছে, তা অসাংবিধানিক নয়।
এর পাশাপাশি জম্মু ও কাশ্মীরকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দিতে কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। অর্থাৎ, আর তা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে পড়বে না। রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত ২ জুলাই থেকে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চে শুরু হয় ধারাবাহিক শুনানি। ৫ সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে রায়দান স্থগিত রাখে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ।
দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরে ৩৭০ রদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। ২০১৯ সালে কেন্দ্র সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ করে। সাবেক জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখে ভাগ করা হয়।
তার পরেই সুপ্রিম কোর্টে এই পদক্ষেপের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়। শুনানিতে সরকারের আইনজীবীরা জানান, জম্মু-কাশ্মীরকে পুরোপুরি ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে এই পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সেখানে ভোট হবে। ফেরানো হবে রাজ্যের মর্যাদা।
আবেদনকারীদের পক্ষে কপিল সিব্বল, গোপাল সুব্রহ্মণ্যমের মতো প্রবীণ আইনজীবীরা জানান, কেন্দ্র সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জারি করা বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক নির্দেশের মাধ্যমে একটি পূর্ণ মর্যাদার অঙ্গরাজ্যকে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করেছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরে আঘাত। সংবিধানের সঙ্গেও ধোঁকাবাজি করা হয়েছে।
২০২০ সালের মার্চ মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের আসন পুনর্বিন্যাসের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জনাপ্রকাশ দেশাইয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তরফে ২০২২ সালের মে মাসে জম্মুতে ছ’টি এবং কাশ্মীরে একটি আসন বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, জনবিন্যাস কিংবা জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, রাজনৈতিক কারণেই বিধানসভায় জম্মুর জন্য আসন বাড়িয়ে উপত্যকাকে কব্জা করতে চাইছে বিজেপি।
যে সমস্ত মামলাকারী ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্তের আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হন, তাঁদের বক্তব্য, কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে ভারত সরকার যে ভারতভুক্তির চুক্তি করেছিল, সেখানেই বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হল, কী কী বিশেষ মর্যাদা বা অধিকার কাশ্মীরকে দেওয়া হয়েছিল? ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের অগস্ট মাসের আগে পর্যন্ত প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে হস্তক্ষেপের অধিকার ছিল না কেন্দ্রের।
জম্মু ও কাশ্মীরে কোনও আইন প্রণয়নের অধিকার ছিল না সংসদেরও। আইন প্রণয়ন করতে হলে রাজ্যের সম্মতি নিতে হত। তা ছাড়া আলাদা পতাকাও ছিল জম্মু ও কাশ্মীরের।
এ ছাড়াও ৩৫-এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, রাজ্যের কে স্থায়ী বাসিন্দা, আর কে নন, তা স্থির করতে পারত জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভা। স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ কাশ্মীরে জমি কিনতে পারতেন না।
এমনকি স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ ওই রাজ্যে চাকরির আবেদন করতে পারতেন না। দিতে পারতেন না ভোটও। রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা কোনও মহিলা বাইরের কাউকে বিয়ে করলে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন।
এ বার দেখা যাক, এই মামলায় সরকারপক্ষের যুক্তি কী? কেন্দ্রের বক্তব্য, দেশের সংবিধান সভা জম্মু ও কাশ্মীরকে ৩৭০ অনুচ্ছেদে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে সংবিধান প্রণয়নের পর ১৯৫৭ সালে সংবিধান সভা ভেঙে দেওয়া হয়।
সরকারপক্ষের যুক্তি ছিল, ১৯৫০ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় ৩৭০ অনুচ্ছেদে জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হলেও সেই মর্যাদা স্থায়ী ছিল না, বরং ছিল ‘অস্থায়ী সংস্থান’ (টেম্পোরারি প্রভিশন)।
ওই অনুচ্ছেদের ৩ নম্বর উপধারায় বলা হয়, রাষ্ট্রপতি ইচ্ছে করলে ওই ‘বিশেষ মর্যাদা’ তুলে নিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির ওই ক্ষমতাকে ব্যবহার করেই ২০১৯ সালে ‘বিশেষ মর্যাদা’ প্রত্যাহার করে মোদী সরকার।
অর্থাৎ নির্দেশনামায় রাষ্ট্রপতি সই করার পরের মুহূর্ত থেকেই রদ হয়ে যায় ৩৭০ ধারা। এই ধারার অধীনেই ৩৫এ ধারায় ভারতীয় ভূখণ্ডে থেকেও জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দারা যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন, খারিজ হয়ে যায় সেটাও।
২০১৯ সালের ৫ অগস্ট তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা প্রকাশ করেন। সরকারের তরফে জানানো হয়, এমনকি রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-ও দাবি করেন যে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা অস্থায়ী একটি ব্যবস্থা ছিল।
সব ছবি: সংগৃহীত।