
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ফের এক বার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে গুপ্তহত্যার ছক? তাঁর ব্যবহার করা বিলাসবহুল লিমোজ়িনে বিস্ফোরণ হতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। নেপথ্যে কে বা কারা? আমেরিকা না ইউক্রেন? রয়েছে কোনও অন্তর্ঘাত? এই সমস্ত প্রশ্নে উত্তাল ইউরোপ-সহ গোটা বিশ্ব।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য সান’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৯ মার্চ পুতিনের লিমোজ়িনে বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটির ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। পরে সেটা গাড়ির ভিতরেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে ঘটনার সময় গাড়িতে ছিলেন না রুশ প্রেসিডেন্ট। এই অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের কোনও ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে মস্কো।

লিমোজ়িন বিস্ফোরণকাণ্ডের নেপথ্যে কাদের হাত রয়েছে, এই প্রশ্নে একাধিক বিকল্পের কথা বলেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, এই পদ্ধতিতে পুতিনকে হত্যার চেষ্টা করে থাকতে পারে ইউক্রেনীয় গুপ্তচর সংস্থা। ২০২২ সালের অগস্টে গাড়িবোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারান রুশ প্রেসিডেন্টের ‘মস্তিষ্ক’ হিসাবে পরিচিত আলেকজ়ান্ডার ডুগিনের কন্যা দারিয়া।

রাজধানী মস্কো থেকে ৩২ কিমি দূরে মোজাইস্কয় মোটরওয়েতে টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজ়ার চালিয়ে নিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন ডুগিন-কন্যা। আচমকাই চলন্ত গাড়িতে বিস্ফোরণ হলে তাঁর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। দারিয়ার মৃত্যুর মাত্র ছ’মাস আগে (পড়ুন ২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) শুরু করেন পুতিন, তিন বছর পেরিয়ে যা এখনও বন্ধ হয়নি।

ডুগিন-কন্যার মৃত্যুর তদন্তে নেমে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে পান রুশ গোয়েন্দারা। তাঁদের দাবি, দারিয়ার ল্যান্ড ক্রুজ়ারের ইঞ্জিনে একটি বিশেষ যন্ত্র বসানো হয়েছিল। এর সাহায্যে কয়েক কিলোমিটার দূরে বসে বিস্ফোরণ ঘটায় আততায়ী। এই হত্যাকাণ্ডে ইউক্রেনীয় গুপ্তচরদের পাশাপাশি কিভের ‘সন্ত্রাসী’দের যোগাযোগ থাকার প্রমাণ পায় মস্কো।

বিশেষজ্ঞেরা লিমোজ়িন বিস্ফোরণের নেপথ্যে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ-র হাত থাকার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। এ ছাড়া পুতিন অন্তর্ঘাতের শিকার হতে পারেন বলেও মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ। কেউ কেউ আবার মনে করছেন, গোটাটাই নিজের হাতে সাজিয়েছেন পুতিন। এই অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে এ বার পুরো ইউক্রেন দখলের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন তিনি।

পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে অন্তত ছ’বার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু প্রতি বারই আশ্চর্যজনক ভাবে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। সর্বশেষ চেষ্টাটি হয় ২০২৩ সালের মে মাসে। ওই দিন ক্রেমলিনের প্রাসাদ লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেনীয় সেনা। মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলিকে অবশ্য দেখামাত্রই গুলি করে নামায় রুশ ফৌজ।

২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে কৃষ্ণ সাগর এবং কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী ককেশাস অঞ্চল সফরে যান রুশ প্রেসিডেন্ট। সেই সময়ে তাঁকে খুনের চক্রান্ত করেছিল ইউক্রেনীয় গুপ্তচরবাহিনী। ২০২৩ সালে সংবাদমাধ্যমের কাছে সে কথা স্বীকার করে নেন কিভের তৎকালীন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল কিরিলো বুদানভ।

২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে পুতিনকে হত্যার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেন রুশ গোয়েন্দারা। ওই ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের এক জন ছিলেন কৃষ্ণ সাগর তীরবর্তী ওডেসা বন্দর এলাকার বাসিন্দা। দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম আন্তর্জাতিক অপরাধীদের তালিকায় ছিল বলে জানা গিয়েছে।

‘দ্য সানডে টাইমস’ লিখেছে, ২০০৩ সালের অক্টোবরে পুতিনকে খুনের চক্রান্ত ব্যর্থ করে ব্রিটিশ পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখা। ষড়যন্ত্রে জড়িত সন্দেহে দু’জনকে গরাদের ওপারে পাঠায় তারা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, রুশ প্রেসিডেন্টকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে মরিয়া ছিলেন মস্কোর গুপ্তচর সংস্থা ‘ফেডারেল সিকিয়োরিটি সার্ভিস’-এর (এফএসবি) এক সাবেক হিটম্যানও।

গোয়েন্দা সূত্রে খবর, স্নাইপার রাইফেলের গুলিতে বহু দূর থেকে রুশ প্রেসিডেন্টকে পরপারে পাঠানোর নিখুঁত ছক ছিল প্রাক্তন এফএসবি কর্মীর। কিন্তু, সেই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তাঁকে হাতকড়া পরাতে মস্কোর বেশি সময় লাগেনি। ২০০২ সালে আজ়ারবাইজান সফরের সময় পুতিনকে হত্যার চেষ্টা করেন এক ইরাকি নাগরিক।

কিন্তু দ্রুত ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ১০ বছরের জন্য জেলে পাঠায় বাকু। ধরা পড়ে গিয়ে আজ়ারবাইজান পুলিশের কাছে যাবতীয় পরিকল্পনা ফাঁস করেন তিনি। জানা যায়, আফগানিস্তান এবং চেচেন বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর।

এ ছাড়া এক বার ক্রেমলিনের কাছে মোটরওয়েতে বিস্ফোরণে পুতিনের গাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে আততায়ীরা। কিন্তু, রুশ গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে পারেনি তারা। ওই রাস্তা থেকে ৪০ কেজি বিস্ফোরণ উদ্ধার করে মস্কো পুলিশ। হত্যার চেষ্টার ষড়যন্ত্রে কাদের হাত ছিল, তা অবশ্য সে বার জানতে পারেননি রাশিয়ার দুঁদে গোয়েন্দারা।

বিশ্লেষকদের দাবি, এ বারের লিমোজ়িন বিস্ফোরণকাণ্ডে বেশ কয়েকটি জায়গায় খটকা রয়েছে। প্রথমত, মস্কোর লুবিয়াঙ্কায় রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা এফএসবির সদর দফতরের অদূরে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। সারা বছরই নিরাপত্তার চাদরে মোড়া থাকে ওই এলাকা। ফলে অন্তর্ঘাত না থাকলে সেখানে ঢুকে পুতিনের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটানো বেশ কঠিন।

ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা ‘দ্য সান’ জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট লিমোজ়িনটি পুতিনের কনভয়ে ব্যবহার হয়। গাড়িটির বাজারমূল্য ২ লক্ষ ৭৫ হাজার পাউন্ড। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্টের সম্পত্তি বিভাগের (প্রপার্টি ডিপার্টমেন্ট) কাঁধে। বছর ৭২-এর পুতিনের সংগ্রহে এই ধরনের একাধিক লিমোজ়িন রয়েছে। প্রায়ই সেগুলিতে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।

মস্কোর জনপ্রিয় গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা ‘অরাস সেনাট’-এর তৈরি বিলাসবহুল লিমোজ়িনকে রুশ সমাজের আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। বহু বার নিজের ‘বন্ধু’দের এই গাড়ি উপহার দিয়েছেন পুতিন। সেই তালিকায় রয়েছে কমিউনিস্ট-শাসিত উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম জং-উন।

মার্চের শেষ সপ্তাহে প্রকাশ্যে পুতিনের মৃত্যুকামনা করেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘রুশ প্রেসিডেন্টের দিন ফুরিয়ে এসেছে। খুব শীঘ্রই তিনি মারা যাবেন। এটা ধ্রুব সত্য। তাঁর ওই পরিণতির মধ্যে দিয়ে শেষ হবে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধ।’’

মজার বিষয় হল, জ়েলেনস্কির ওই মন্তব্যের কয়েক দিনের মধ্যেই পুতিনের কনভয়ে ব্যবহার হওয়া লিমোজ়িনে ঘটেছে বিস্ফোরণে ঘটনা। তবে ক্রেমলিনের মুখপাত্র জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্টের অদৃশ্য সুরক্ষাকবচ রয়েছে। সেটা ভেদ করা অসম্ভব। পুতিন যে পুরোপুরি সুস্থ আছেন, তা-ও জানিয়ে দিয়েছে মস্কো।
সব ছবি: সংগৃহীত।