প্রাচুর্যের প্রাসাদ গড়ে তুলতে যুদ্ধ-ব্যবসা! ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র বিক্রির কোটি কোটি টাকায় রাজকোষ ভরিয়ে তোলা! দশকের পর দশক ধরে এ ভাবেই ‘বড়লোক’ হয়েছে আমেরিকা। এই রাস্তা থেকে সরে এলে আর্থিক দিক থেকে আফ্রিকার থেকেও খারাপ দশা হবে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’-এর। এমনটাই মত বিশ্লেষকদের একাংশের।
অস্ত্র ব্যবসায় বিপুল লাভের স্বাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রথম বার পায় আমেরিকা। জাপান এবং জার্মানির আক্রমণের আতঙ্কে হাতিয়ার নির্মাণে জোর দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজ়ভেল্ট। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ থেমে গেলে শুরু হয় সমস্যা। অস্ত্র কারখানাগুলিতে আসে মন্দা। কমে যায় পুঁজি, চলে যথেচ্ছ ছাঁটাই।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে নতুন নতুন অস্ত্রের বাজারের খোঁজে কোমর বেঁধে লেগে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তা-ব্যক্তিরা। তত দিনে একটি সহজ সত্য বুঝে গিয়েছেন তাঁরা। সেটা হল, যুদ্ধের আতঙ্ক তৈরি করতে পারলেই বিপুল টাকা দিয়ে হাতিয়ার কিনবে দুনিয়ার যে কোনও দেশ। তবে তার জন্য দেখাতে হবে স্বাধীনতার মিথ্যা স্বপ্ন। এমনকি প্রয়োজনে নিজেকেই নামতে হতে পারে লড়াইয়ের ময়দানে।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে শীতল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। এই সময়ে হাতিয়ার ব্যবসায় মুনাফা করতে কমিউনিজ়মের আতঙ্ককে বিশ্বব্যাপী ছড়াতে শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরেরা। এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল ওয়াশিংটনের অস্ত্র নির্মাণকারী সমস্ত সংস্থা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, গত শতাব্দীর ৫০ থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত হাতিয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে মূলত সোভিয়েত আতঙ্ককেই পুঁজি করেছিল আমেরিকা। ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন বা নেটো)। সোভিয়েত হামলার ভয় দেখিয়ে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে বিপুল অস্ত্র বিক্রি করে ওয়াশিংটন। ফলে ৫০-এর দশকে অস্ত্র নির্মাণকারী আমেরিকান সংস্থা ‘জেনারেল ডায়নামিক্স’-এর শেয়ার সূচক ৪০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
অস্ত্রের বাজার ঠিক রাখতে একটা সময়ে দেশের ভিতরে ভুয়ো প্রচার চালিয়েছিল আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ। ৬০-এর দশকে সোভিয়েত সেনা এসে নিরীহ যুক্তরাষ্ট্রবাসীর ফ্রিজে রাখা ভদকা (রাশিয়ান মদ) খেয়ে যাবে বলে খবর ছড়িয়ে দেন তাঁরা। ফলে মস্কোর প্রতি আটলান্টিকের পারে বাড়তে থাকে ঘৃণা। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী বছরগুলিতে সেখানকার হাতিয়ার নির্মাণকারী সংস্থাগুলির দক্ষ শ্রমিক বা প্রযুক্তবিদ পাওয়ার ক্ষেত্রে কখনওই সমস্যার মুখে পড়তে হয়নি।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে গেলে শীতল লড়াই পর্বের গোপন তথ্য প্রকাশ্যে আনে সিআইএ। সেই সমস্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ৮০-র দশকের পরবর্তী সময়ে মস্কোর আর্থিক অবস্থা ইটালির থেকেও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন আমেরিকার যুদ্ধবিমান নির্মাণকারী জনপ্রিয় সংস্থা ‘লকহিড মার্টিন’-এর তৎকালীন সিইও। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘আমরা হাতিয়ারের বাজারে আধিপত্য রাখতে যে ভাবে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলাম, তার জন্য নোবেল পাওয়া উচিত।’’
তবে অস্ত্র বিক্রি করতে আমেরিকা যে শুধুই সোভিয়েত আতঙ্কের উপর নির্ভরশীল ছিল, এমনটা নয়। ১৯৫৩ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ। তিনি কুর্সি থেকে সরতেই পারস্য উপসাগরের তীরের দেশটিতে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে বিবদমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যে হাতিয়ার বিক্রির খোলা বাজার চলে আসে ওয়াশিংটনের হাতে।
১৯৬৪ সালে হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের রণতরীর উপর ভিয়েতনাম আক্রমণ করেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেই তথ্য যাচাইয়ের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সরকার। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে নামার দলিল পাশ করে আমেরিকার পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’। ফলস্বরূপ পাঁচ হাজার ফৌজি কপ্টারের বরাত পায় ‘বেল টেক্সট্রন’ নামের একটি সংস্থা। আর তাতেই রাতারাতি লাল হয়ে উঠেছিল টেক্সাসের ওই কোম্পানি।
২১ শতকের গোড়ায় আমেরিকার নৌবাহিনী জানিয়ে দেয়, তাঁদের কোনও রণতরীর উপর কখনওই আক্রমণ করেনি ভিয়েতনাম। ভুয়ো খবর কে বা কারা ছড়িয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য অজানাই থেকে গিয়েছে। ২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র নিউ ইয়র্ক শহর। কুখ্যাত সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়দার আত্মঘাতী হামলায় ধূলোয় মিশে যায় সেখানকার বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার) জোড়া আকাশচুম্বী ইমারত।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ৯/১১-র জঙ্গি হামলা আমেরিকার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থাগুলির সামনে নতুন করে লক্ষ্মীর ঝাঁপি খুলে দিয়েছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই আল-কায়দার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে নিকেশ করতে আফগানিস্তান-অভিযানে নামে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতেই ‘লকহিড মার্টিন’-এর শেয়ারের দর এক এক দিনে লাফিয়ে ৩০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নামে আমেরিকা। তৎকালীন সিআইএর অধিকর্তা জর্জ টেনেটের দেওয়া একটি গুপ্ত নথির উপর ভিত্তি করে শুরু হয় ওই সংঘর্ষ। রিপোর্টে তিনি লিখেছিলেন, ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনের কাছে রয়েছে গণবিধ্বংসী হাতিয়ার (ওয়েপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশন)। বাগদাদে রাসায়নিক অস্ত্র জমা করেছেন তিনি। কিন্তু ইরাক দখলের পর সেই ধরনের কোনও অস্ত্রের চিহ্ন খুঁজে পায়নি যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ।
ইরাক যুদ্ধ নিয়ে ২০১২ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে বলা হয়েছে, এই সংঘর্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার ব্যবসায়ীরা লাভ করেছেন আট লক্ষ কোটি ডলার। বিনিময়ে ৪৫ হাজার সৈনিক হারিয়েছে ওয়াশিংটন। মৃত্যু হয়েছে তিন লাখ ইরাকি নাগরিকেরও।
হার্ভার্ডের গবেষকদের দাবি, ২১ শতকে অস্ত্রের বাজার ঠিক রাখতে সন্ত্রাসবাদের আতঙ্ককে পুঁজি করেছে ওয়াশিংটন। বর্তমানে দুনিয়ার হাতিয়ারের বাজারের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আমেরিকার হাতে। ১৯৫০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ৭ কোটি ২৯ লক্ষ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়া।
গবেষকেরা আরও জানিয়েছেন, বিশ্বের ১০টি রণক্ষেত্রের মধ্যে অন্তত ছ’টিতে আমেরিকায় তৈরি অস্ত্র ব্যবহার হতে দেখা গিয়েছে। দুনিয়ার সর্বাধিক হাতিয়ার আমদানিকারী দেশ সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ারের জন্য প্রতি বছর গড়ে ১১ কোটি ডলার খরচ করে থাকে। ওয়াশিংটনের অস্ত্রকে অন্ধের মতো ভরসা করে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইজ়রায়েল-সহ পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ।
২০২৩ সালে প্রতিরক্ষা খাতে আমেরিকার বরাদ্দ ছিল ৮৮,৬০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৩৮,৩৫০ কোটি ডলার শুধুমাত্র হাতিয়ার সরবরাহের জন্য খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের মূল তিনটি অস্ত্র নির্মাণকারী সংস্থা হল, লকহিড মার্টিন, রেথিয়ন টেকনোলজিস কর্পোরেশন এবং জেনারেল ডাইনামিক্স। এদের বাজারি পুঁজির পরিমাণ ২৯,৭৬৮ কোটি ডলার বলে জানা গিয়েছে।
হার্ভার্ড জানিয়েছে, রাশিয়া, চিন এবং ভারতের সম্মিলিত অর্থের চেয়েও প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় তিন গুণ বেশি টাকা ব্যয় করে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টস বা জিডিপি) একটি বড় অংশ আসে হাতিয়ার ব্যবসা থেকে। গড়ে সেই অঙ্কটি প্রায় ৭০ হাজার কোটি ডলার।
২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ১৫,৯০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিশ্বব্যাপী বিক্রি করেছে ওয়াশিংটন। এর ৭০ শতাংশই গিয়েছে পশ্চিম এশিয়ায়। এর মাধ্যমে সেখানে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অস্ত্র নির্মাণকারী সংস্থাগুলিতে সরাসরি যুক্ত রয়েছে ২৫ লক্ষ কর্মী। এ ছাড়া অপ্রত্যক্ষ ভাবে সেখানে কাজ পেয়েছেন আরও ৪৭ লক্ষ মানুষ। অর্থাৎ দেশটির টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির তুলনায় বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে হাতিয়ারের শিল্প।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মন্দার কবলে পড়েছিল আমেরিকার ৫০ শতাংশ অস্ত্র কারখানা। ফলে ১৫ শতাংশ কর্মসংস্থান কমে গিয়েছিল সেখানে। কিন্তু পরবর্তী কালে হাতিয়ারের নতুন নতুন বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয় সিআইএ। এতে আর কোনও দিনই সে ভাবে ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে হয়নি অস্ত্র কারখানার শ্রমিক বা কর্মীদের।
২০২৫-এর ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় বারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতায় এসেই পশ্চিম এশিয়ায় দেড় বছরের বেশি চলা ইজ়রায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করেছেন তিনি। একই ভাবে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ থামানোরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।
গবেষকদের অবশ্য দাবি, ট্রাম্পের এ-হেন পদক্ষেপের জেরে আগামী দিনে আমেরিকা অস্ত্রের দোকান পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে, এমন ধারণা ভুল। কারণ নতুন সংঘাতের জায়গা খুঁজে পেয়ে গিয়েছে ওয়াশিংটন। আর তাই আগ্রাসী চিনের আতঙ্ক বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চেষ্টার কসুর করছে না সিআইএ। সেই সঙ্গে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার দেশগুলিকে হাতিয়ার বিক্রির নতুন বাজার হিসাবে পাখির চোখ করেছে তারা।
সব ছবি: সংগৃহীত।