
রাশিয়া-ইউক্রেন হোক বা পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল-হামাস। ২১ শতকে আমূল বদলে গিয়েছে যুদ্ধ। আধুনিক লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে ড্রোন। এই আবহে মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলিকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করতে নতুন হাতিয়ার বানিয়ে গোটা দুনিয়াকে চমকে দিল মার্কিন প্রতিরক্ষা স্টার্ট আপ সংস্থা।

চলতি বছরে মার্চে ড্রোন ধ্বংসকারী নতুন সমরাস্ত্রের প্রদর্শন করে ক্যালিফোর্নিয়ার টরেন্স এলাকার এপিরাস আইএনসি। স্পার্টার ইতিহাসখ্যাত গ্রিক রাজাকে মনে রেখে হাতিয়ারটির নামকরণ করা হয়েছে ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’। স্টার্ট আপ সংস্থাটির দাবি, সংশ্লিষ্ট অস্ত্রটির থেকে বেরিয়ে আসা উচ্চশক্তির মাইক্রোওয়েভ নিমেষে পুড়িয়ে ছাই করবে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা মানববিহীন উড়ুক্কু যান।

সূত্রের খবর, ড্রোন হামলা আটকাতে সীমান্তবর্তী বিশাল এলাকা জুড়ে এই সমরাস্ত্র মোতায়েন করা যাবে। আবার ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’ একক ভাবে ছোট জায়গায় কাজ করতেও সক্ষম। ড্রোন ধ্বংস করতে আকাশে তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করবে অত্যাধুনিক এই হাতিয়ার।

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি বিবৃতি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মার্কিন প্রতিরক্ষা স্টার্ট আপ সংস্থা। সেখানে বলা হয়েছে, শত্রুর উড়ে আসে ড্রোনের সামনে একটি অদৃশ্য ঢাল তৈরি করবে ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’। মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলিকে নিষ্ক্রিয় করতে অস্ত্রটির সময় লাগবে মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

ক্যালিফোর্নিয়ার স্টার্ট আপ সংস্থাটির দাবি, স্থলবাহিনীর পাশাপাশি অত্যাধুনিক হাতিয়ারটি নৌসেনাও ব্যবহার করতে পারবে। ছোট-বড় সব ধরনের রণতরীতে একে মোতায়েন করা যাবে। ফৌজি ট্রাকে একে এক জায়গা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুবিধাও রয়েছে।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’-এর একাধিক সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, এর থেকে বেরিয়ে আসা মাইক্রোওয়েভ খালি চোখে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে আড়াল থেকে অদৃশ্য ড্রোন ধ্বংসকারী হিসাবে একে ব্যবহার করা যাবে।

দ্বিতীয়ত, প্রথাগত বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় এর খরচ অনেক কম। আমেরিকার সেনাবাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট বা ড্রোনকে মাঝ-আকাশে ওড়ানোর জন্য ‘টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাড নামের একটি অস্ত্র ব্যবহার করে। এর নির্মাণ এবং ব্যবহারের খরচ কয়েক কোটি ডলার।

তুলনামূলক ভাবে ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’ তৈরির খরচ কম। শুধু তা-ই নয়, এর সাহায্যে মাইক্রোওয়েভ ছুড়ে অতি অল্প খরচে ওড়ানো যাবে ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন। হাতিয়ারটিতে অত্যাধুনিক হাই পাওয়ার মাইক্রোওয়েভ বা এইচপিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

সূত্রের খবর, ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’ ৩০০ মেগাহার্ৎজ় থেকে ৩০০ গিগাহার্ৎজ় পর্যন্ত তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি করবে। উচ্চশক্তির মাইক্রোওয়েভ ইলেকট্রিক সার্কিটে শক্তিশালী বিস্ফোরণের মাধ্যমে কাজ করবে এই হাতিয়ার। এর ফলে সৃষ্ট তড়িচ্চুম্বকীয় স্রোত মাঝ-আকাশে ধ্বংস করবে ড্রোন।

বিশ্লেষকদের কথায়, মাইক্রোওয়েভ সব সময় সংবেদনশীল উপাদানকে ব্যাহত করে থাকে। ফলে ড্রোনের মতো যন্ত্র অকেজো হয়ে যায়। অনেকে আবার উচ্চশক্তির মাইক্রোওয়েভ প্রযুক্তিকে লেজ়ার অস্ত্রের সমতুল্য বলে মনে করেন। তা যে একেবারেই নয়, সেটা স্পষ্ট করেছে মার্কিন প্রতিরক্ষা স্টার্ট আপ।

ক্যালিফোর্নিয়ার সংস্থাটি জানিয়েছে, লেজ়ার হাতিয়ার সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’-এর মতো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা ড্রোনকে চোখের নিমেষে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। সীমান্ত জুড়ে বিশাল এলাকাকে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এর।

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’কে ইলেকট্রনিক যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা যাবে। অর্থাৎ, রণক্ষেত্রে শত্রুর রাডার বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম সহজেই ধ্বংস করতে পারবে এই হাতিয়ার। পাশাপাশি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে, উন্মত্ত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে অস্ত্রটি কাজে আসবে বলে জানিয়েছে নির্মাণকারী সংস্থা এপিরাস।

তবে ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’-এর বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, এই অস্ত্র নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চালিয়ে যেতে হলে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন হবে। সেটা না পাওয়া গেলে উচ্চশক্তির মাইক্রোওয়েভ তৈরি করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, শত্রুপক্ষ যদি যুদ্ধের গোড়াতেই বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহের কেন্দ্রগুলি উড়িয়ে দেয়, তা হলে একরকম অকেজো হয়ে পড়বে এই সমরাস্ত্র।

দ্বিতীয়ত, সমস্ত রকমের আবহাওয়ায় সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি কাজ করতে পারবে, তা নয়। প্রবল বৃষ্টি বা ঘন কুয়াশা থাকলে ড্রোন ঠেকাতে উচ্চশক্তির তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, মাইক্রোওয়েভের জন্য সীমান্তলাগোয়া এলাকায় নিজের দেশেরই অসামরিক নানা কাঠামো ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে এর ব্যবহার বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

সমর বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, আগামী দিনে শুধুমাত্র ড্রোন নিয়ে শত্রুপক্ষ আক্রমণ শানাবে এমনটা নয়। তার সঙ্গে থাকবে যুদ্ধবিমান। আবার ড্রোনের সঙ্গে মাঝারি বা দূরপাল্লার রকেট এবং শক্তিশালী ক্রুজ়, ব্যালেস্টিক বা হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্রও উড়ে আসতে পারে।

এই সবগুলিকে একসঙ্গে আটকে দেওয়ার ক্ষমতা নেই ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’-এর। ফলে এর পাশাপাশি প্রথাগত বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং লেজ়ার হাতিয়ারও মোতায়েন রাখতে হবে। এগুলির প্রতিটির কর্মপদ্ধতি আলাদা। ফলে অস্ত্রগুলিকে একসঙ্গে ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

‘লিওনাইডাস সিস্টেম’-এর নির্মাণকারী সংস্থার দাবি, অস্ত্রটিকে এখনও পুরোপুরি তৈরি করা যায়নি। আগামী দিনে এতে কৃত্রিম মেধা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তখনও আরও শক্তিশালী হবে এই অস্ত্র।

মার্কিন প্রতিরক্ষার সদর দফতর পেন্টাগনের তরফে অবশ্য এখনই এই অস্ত্রের পরীক্ষার দিনক্ষণ ঠিক করা হয়নি। তবে হাতিয়ারটির ক্ষুদ্র সংস্করণ তৈরি হলে, তার কার্যকারিতা যে আমেরিকার বায়ুসেনা যাচাই করে দেখবে, সেই ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই মিলেছে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, চিনা ড্রোনশক্তির মোকাবিলার কথা মাথায় রেখে ‘লিওনাইডাস সিস্টেম’-এর নকশা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা।
সব ছবি: সংগৃহীত।