
আরব মুলুকে শোনা যাবে কোরীয় বিমানের গর্জন! তেল বিক্রির টাকায় এ বার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধবিমান কিনতে চলেছেন দুবাই ও আবু ধাবির ধনকুবের শেখরা। দক্ষিণ কোরিয়ার বায়ুসেনার সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বিমানবাহিনীর ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিতে তুঙ্গে উঠেছে সেই জল্পনা। পশ্চিম এশিয়ার সামরিক ইতিহাসে এই ঘটনাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।

সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার বিমানবাহিনীর সঙ্গে ‘লেটার অফ ইনটেন্ট’-এ সই করেছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বায়ুসেনা। এর পরই সোলের তৈরিতে কেএফ-২১ বোরাম যুদ্ধবিমান নিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে আরব মুলুকটি যথেষ্ট আগ্রহী বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, সমঝোতার চুক্তিতে সই করেন রিপাবলিক অফ কোরিয়া এয়ারফোর্সের (আরওকেএফ) প্রধান জেনারেল লি-ইয়ং সু এবং আমিরশাহির বায়ুসেনা ও বিমান প্রতিরক্ষা বিভাগের কমান্ডার মেজর জেনারেল রাশেদ মহম্মদ এ অল শামসি।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দু’পক্ষ কোনও চূড়ান্ত চুক্তি করার আগে অনেক সময় একটি খসড়া সমঝোতা করে থাকে। একে বলা হয় ‘লেটার অফ ইনটেন্ট’। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, দক্ষিণ কোরিয়া সফরে গিয়ে কেএফ-২১ এবং এফএ-৫০ লড়াকু জেট নির্মাণকারী সংস্থা কোরিয়া অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়ের (কেএআই) কারখানা পরিদর্শন করেন আমিরশাহির কমান্ডার মেজর জেনারেল রাশেদ। তার পর দু’পক্ষের মধ্যে সম্পন্ন হয় সমঝোতা চুক্তি।

এই চুক্তি অনুযায়ী, আরব মুলুকটির বায়ুসেনার পদস্থ আধিকারিকেরা যে কোনও সময় সোলের কেএফ-২১ যুদ্ধবিমানের বহরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউনিটগুলি পরিদর্শন করতে পারবেন। এই লড়াকু জেটের মহড়া পর্যবেক্ষণ করার অধিকারও পাবেন তাঁরা। তবে আমিরশাহির সরকার সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানগুলি কিনতে আগ্রহী কি না, তার চূড়ান্ত উল্লেখ অবশ্য চুক্তিতে করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের একাংশের অবশ্য ধারণা, এই ‘লেটার অফ ইনটেন্ট’ ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা চুক্তির রাস্তাই প্রশস্ত করল।

গত কয়েক বছর ধরেই পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধবিমানে বাহিনীকে সাজাতে চাইছে আমিরশাহির বায়ুসেনা। এ ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার কেএফ-২১ লড়াকু জেটকে পাখির চোখ করেছে তারা। ২০২৩ সালে এ ব্যাপারে প্রথম বার আগ্রহ প্রকাশ করে আবু ধাবি। সে বছর সোলের জাতীয় নিরাপত্তা দফতরে চিঠি লেখে আমিরশাহির অর্থনৈতিক কাউন্সিল। চিঠিতে কেএফ-২১ লড়াকু জেটের প্রকল্পে সরাসরি শামিল হওয়ার আবেদন জানায় ওই আরব মুলুক।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স একজ়িবিশন অ্যান্ড কনফারেন্স’ বা আইডেক্স-২০২৫-এর আয়োজন করে আমিরশাহির সরকার। তাতে অংশ নিয়ে আরব মুলুকটির বায়ুসেনা ও বিমান প্রতিরক্ষা বিভাগের কমান্ডার মেজর জেনারেল রাশেদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন কেএআইয়ের সভাপতি কাং-গু-ইয়ং। সূত্রের খবর, এর পরই কেএফ-২১ যুদ্ধবিমানটি নিয়ে আবু ধাবির আগ্রহ বাড়তে থাকে।

দক্ষিণ কোরিয়া এখনও ব্যাপক আকারে কেএফ-২১ লড়াকু জেটের নির্মাণকাজ শুরু করেনি। যুদ্ধবিমানটির মাত্র ছ’টি প্রোটোটাইপ তৈরি করেছে কেএআই। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর থেকে সোলের বায়ুসেনায় কর্মজীবন শুরু করবে কেএফ-২১। সূত্রের খবর, ভবিষ্যতের যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে লড়াকু জেটটিকে তৈরি করেছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র। এর ককপিটে থাকা পাইলট যুদ্ধের সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) ব্যাপক ব্যবহার করতে পারবেন।

উল্লেখ্য, পশ্চিম এশিয়ার অস্ত্রের বাজারে এখনও পা রাখতে পারেনি দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে ইউরোপ, আমেরিকা এবং রাশিয়ার একাধিপত্য রয়েছে। অথচ যুদ্ধের হটস্পট হিসাবে ওই এলাকাকে চিহ্নিত করলে একেবারেই ভুল হবে না। এই পরিস্থিতিতে সেখানকার হাতিয়ার ব্যবসায় অন্যতম বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে সোল। শুধু তা-ই নয়, আবু ধাবির মাধ্যমে সেই দরজা খুলতে চাইছে প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র।

ফেব্রুয়ারিতে আইডেক্স-২০২৫-এ অংশ নিয়ে কেআইএ সভাপতি কাং বলেন, ‘‘সংযুক্ত আরব আমিরশাহি আমাদের উন্নত প্রযুক্তির অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের প্রযুক্তি পরিদর্শনের সুযোগ চেয়েছে। এতে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্প্রসারণের ভিত্তি স্থাপন হল।’’ ভবিষ্যতে কোরিয়া অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ় যে পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানির চেষ্টা চালিয়ে যাবে, তা স্পষ্ট করেছেন তিনি।

বর্তমানে আমিরশাহির বিমানবাহিনী ফ্রান্সের তৈরি মিরাজ-২০০০ এবং আমেরিকার তৈরি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। এই দুই লড়াকু জেটের যথেষ্ট বয়স হওয়ায় আবু ধাবির সেগুলি দ্রুত বদল করার প্রয়োজন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ লাইটনিং টু যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে আরব মুলুকটির প্রবল আগ্রহ ছিল। কিন্তু সেই আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় বিকল্প লড়াকু জেটের সন্ধানে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন সেখানকার বায়ুসেনা অফিসারেরা।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরব মুলুকটির ১৮টি অত্যাধুনিক ড্রোন ও ৫০টি এফ-৩৫ লাইটনিং টু যুদ্ধবিমান কেনার কথা ছিল। কিন্তু, মার্কিন কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রতিরক্ষা চুক্তিটিকে কেন্দ্র করে অচলাবস্থা তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে এ ব্যাপারে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায় ওয়াশিংটন। ফলে এফ-৩৫ পাওয়ার আশা পুরোপুরি ত্যাগ করতে বাধ্য হয় সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বায়ুসেনা।

বিশ্লেষকদের দাবি, মূলত দু’টি কারণে আবু ধাবির হাতে এফ-৩৫র মতো অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান তুলে দেওয়ার ব্যাপারে অনীহা দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। প্রথমত, গত কয়েক দশকে চিনের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করেছে আমিরশাহির সরকার। দ্বিতীয়ত, লড়াকু জেটটি আরব মুলুকের হাতে গেলে ‘প্রিয় বন্ধু’ ইজ়রায়েলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকত। সেই ভয় থেকে প্রতিরক্ষা চুক্তি থেকে পিছিয়ে আসে আমেরিকা।

এফ-৩৫ নিয়ে আলোচনা স্থগিত হতেই ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ফরাসি সংস্থা দাসো অ্যাভিয়েশনের তৈরি ৮০টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি তড়িঘড়ি সেরে ফেলে আমিরশাহির প্রশাসন। এটাই ছিল কোনও দেশের রাফালকে নিয়ে একক বৃহত্তম বরাত। এ বছরের জানুয়ারিতে প্রথম পর্বের লড়াকু জেটগুলি হাতে পেয়েছে পশ্চিম এশিয়ার এই আরব মুলুক।

দক্ষিণ কোরিয়ার কেএফ-২১ ছাড়া তুরস্কের তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের কান যুদ্ধবিমানকে বাহিনীতে শামিল করতে আমিরশাহির বায়ুসেনা যথেষ্ট আগ্রহী। তুর্কি বিমানবাহিনীতে এখনও সরকারি ভাবে কাজ শুরু করেনি কান। তবে এর প্রোটোটাইপ প্রকাশ্যে এনেছে আঙ্কারা।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের কেএফ-২১ তৈরি করতে ন’বছর সময় লেগেছে। প্রাথমিক ভাবে এর ২০টি ইউনিট সরবরাহের বরাত পেয়েছে কোরিয়া অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়। সূত্রের খবর, আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকে আরওকেএফের বহরে শামিল হবে এই লড়াকু জেট।

রাফালের মতো এই কোরীয় জেটটিও ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান। কেএআইয়ের প্রেসিডেন্ট তথা সোল বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কাং লড়াকু জেটটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাফাল বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৈরি ইউরো ফাইটার টাইফুনের অত্যধিক বেশি প্রচার হয়। কিন্তু তুল্যমূল্য বিচার করলে দেখা যাবে কেএফ-২১ তাদের চেয়ে অনেক উন্নত যুদ্ধবিমান।’’

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা তাঁদের যুদ্ধবিমানে অ্যারে রাডার ব্যবহার করেছেন। কেএফ-২১ ইলেকট্রনিক্স লড়াইয়ে বেশ পটু। তবে পঞ্চম প্রজন্মের মার্কিন স্টেলথ জেট এফ-৩৫ লাইটনিং টুর সঙ্গে এই তুলনা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানটি এর চেয়ে যে অনেক বেশি উন্নত, তা স্বীকার করেছেন দুনিয়ার তাবড় সমর বিশ্লেষকেরা।

এত দিন পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরশাহি মূলত আমেরিকা থেকে হাতিয়ার আমদানি করেছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আরব মুলুকটির কেনা অস্ত্রের ৫৭ শতাংশের সরবরাহকারী দেশ ছিল আমেরিকা। সেই হিসাবে ধীরে ধীরে বদল আসায় ওয়াশিংটন ও আবু ধাবির সম্পর্কে কোনও বড় বদল আসে কি না, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।