সব জলের বোতল বিসলেরি হয় না! বিজ্ঞাপনে এমন দাবি করেছিল দেশের এক প্যাকেটজাত পানীয় জল সংস্থা। বক্তব্যটির নেপথ্যে যেমন জালিয়াতদের প্রতি স্পষ্ট বার্তা ছিল তেমনই সেই সব ক্রেতাদেরও সতর্ক করা হয়েছিল যারা প্যাকেটজাত জল বলতে শুধু বিসলেরিকেই বোঝেন।
সতর্ক করা হয়েছিল তাঁদের যাঁরা দোকানে গিয়ে ‘মিনারেল ওয়াটার’ চাওয়ার বদলে বলেন, ‘একটা বিসলেরি দিন তো।’ এবং বদলে ‘বেলসেরি’, ‘বিলসেরি’, ‘ব্রিসলেই’ বা ‘ব্রিসলার’ নিয়ে ফিরে আসেন।
তবে নকলদের দৌড়ে বিসলেরি বিড়ম্বনায় পড়লেও বাজার বিশেষজ্ঞদের মত, আদতে বিষয়টি গৌরবের। বিসলেরির সংস্থার এতে বরং খুশিই হওয়া উচিত। কারণ নিজেদের নামকে তারা জলের সমার্থক করে তুলেছে।
শুধু তা-ই নয়। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, নকল তাঁকেই করা হয় যিনি সফল। সে ক্ষেত্রে বিসলেরির নকল করাই সংস্থার সাফল্যের মূর্তিমান প্রমাণ। তা ছাড়া বাজারের তথ্যও বলছে প্যাকেটজাত পরিশ্রুত পানীয় জলের ক্ষেত্রটির ৬০ শতাংশই বিসলেরির দখলে।
কিন্তু একটি প্যাকেটজাত পরিশ্রুত জলের সংস্থা ভারতের মতো দেশে, যেখানে পানীয় জল তেমন অপ্রতুল নয়, সেখানে এই সাফল্য পেল কী ভাবে।
বিসলেরির বোতলে লেখা তথ্য বলছে ১৯৬৯ সাল থেকে পরিশ্রুত পানীয় জল জুগিয়ে আসছে সংস্থাটি। যদিও ভারতে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার ১৮ বছর পর অর্থাৎ ১৯৬৫ সাল থেকে। ওই বছরই মুম্বইয়ের ঠাণেতে বিসলেরির প্রথম বোতলজাত জলের কারখানা তৈরি হয়।
তবে বিসলেরির ইতিহাস আরও ১১৪ বছরের পুরনো। বর্তমানে সংস্থাটি গর্বিত ভারতীয় সংস্থা বলে দাবি করে নিজেদের। তবে এদের উৎপত্তি ১৮৫১ সালের ২০ নভেম্বর ইতালির ভেরোলানুভা নামে এক ছোট শহরে। প্রতিষ্ঠা করেন ইতালীয় রসায়নবিদ ফেলিস বিসলেরি। তার নামেই সংস্থার নাম।
যদিও ফেলিস পরিশ্রুত জল তৈরির সংস্থা বানাননি। সিঙ্কোনা এবং আয়রন সমৃদ্ধ নুন দিয়ে এক আয়ুর্বেদিক পানীয় তৈরি করেছিলেন তিনি। যা মদের নেশা ছাড়াতে কাজে লাগে। পরে ওই পানীয়কে বোতলজাত করে গোটা বিশ্বে রফতানি করা হতে থাকে।
বিসলেরির ওই পানীয়ের আয়ুর্বেদিক বিভিন্ন উপাদানের যোগানও আসত ভারত থেকে। সেই সূত্রেই ১৯৫৩ সালে ভারতে এসে হাজির হন বিসলেরি সংস্থার তখনকার মালিক সিজার রোসি এবং তাঁর স্ত্রী ফিয়ামেট্টা।
ইতালীয় রসায়নবিদ ফেলিসের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন রোসি। ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে ক্ষুরধার রোসি ফেলিসের মৃত্যুর পরই বিসলেরির হাল ধরেছিলেন। ১৯৫৩ সালে এই রোসিই ভারতে এসে আর দেশে ফেরেননি।
স্বাধীনতার পর তখন ভারতে বাজারের বিপুল সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনা নিমেষে বুঝে নিয়েছিলেন রোসি। ভারতে প্যাকেটজাত পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবসা যে চলতে পারে তা তিনিই প্রথম ভেবেছিলেন।
ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানীতে তখন পরিষ্কার পানীয় জলের অভাব। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরা সেই জল বাধ্য হয়েই পান করছেন। কিন্তু উচ্চবিত্তরা বা বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের কাছে মুম্বইয়ের জল একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন।
বিলাসবহুল হোটেলগুলিতে অতিথিদের জল ফুটিয়ে পরিশ্রুত করে দেওয়া হত। রোসি এ সব দেখে জলের ব্যবসার কথা ভাবেন। রোসিকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন তাঁর ভারতীয় আইনজীবী বন্ধু খুসরু সানটুক। তাঁদের দু’জনকেই অবশ্য সবাই পাগল ভেবেছিলেন। ভারতের মতো দেশে দাম দিয়ে কেউ জল কিনবে এটা ভাবতেই পারেননি কেউ।
রোসি অবশ্য দূরদর্শী ছিলেন। মুম্বইয়ের ঠাণেতে বোতলজাত পানীয়জলের কারখানা বানিয়ে সেখানে উৎপাদন শুরু করে দেন তিনি। তবে তখনও বিসলেরি শুধু ধনীদেরই পণ্য। বিক্রি হয় মুম্বইয়ের বড় হোটেল, রেস্তরাঁ এবং পর্যটন কেন্দ্রে। কিন্তু সফল হতে হলে যে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনো দরকার তা বুঝতে পেরেছিলেন সানটুক। চার বছর পর ১৯৬৯ সালে সংস্থা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ক্রেতাদের লাইন পড়ে যায়। ৪ লাখ টাকা দিয়ে বিসলেরি কিনে নেন রমেশ চৌহান। তাঁর হাতে পড়ে নতুন করে প্রাণ পায় বিসলেরি। জল ছাড়াও সোডা, কার্বোনেটেড জল এবং নরম পানীয় তৈরি করতে শুরু করে বিসলেরি। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছতে শুরু করে।
বর্তমানে সেই বিসলেরিই দেশের সবচেয়ে বড় প্যাকেটজাত পানীয় জল প্রস্তুতকারী সংস্থা। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিসলেরি উত্থানের মূল কারণ তাদের বিপণন কৌশল। তাঁরা বিপণনের চারটি নিয়ম মেনে চলেন— পণ্য, দাম, জায়গা এবং বিজ্ঞাপন।
কোথায় বিক্রি হচ্ছে তার ভিত্তিতে বরাবর দাম নির্ধারণ করা হয় বিসলেরির। গুরত্ব দেওয়া হয় বিজ্ঞাপনেও। সেই সব বিজ্ঞাপনও বিভিন্ন সময়ে বিসলেরিকে তাঁর সুনাম অর্জন করতে সাহায্য করেছে।