
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কনীতির প্রভাব সরাসরি পড়তে শুরু করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। চাহিদা ও জোগানের টানাপড়েনের কারণে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম কমে প্রায় ৬০ ডলারে নেমে এসেছে। বিশ্ববাজারে ধারাবাহিক ভাবে কমছে জ্বালানি তেলের দাম। গত চার বছরের মধ্যে দাম কমে সর্বনিম্ন হয়েছে।

কোভিডকালে চাহিদা না থাকায় তেলের দামে এই পরিমাণ পতন দেখেছিল গোটা বিশ্ব। ২০২১ সালের পর বিশ্ববাজারে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় পৌঁছেছে তেলের দাম। সোমবার প্রায় ৩ শতাংশ কমে গিয়েছে অপরিশোধিত তেলের দাম। ট্রাম্পের শুল্কনীতির ঘায়ে ইকুইটির তুলনায় দামে পতন দেখা দিয়েছে।

ওপেক দেশগুলির তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনার ফলে এই পতন আরও বেড়ে গিয়েছে। বিশ্বে তেল রফতানিকারক দেশগুলিও বিশ্বজোড়া টালমাটাল বাণিজ্য পরিস্থিতিতে তেলের মজুত আর বৃদ্ধি করতে চাইছে না। অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ৭১ ডলারের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল কয়েক দিন আগেও। এই আবহে তা হু হু করে পড়তে থাকে।

দুই যুযুধান ওয়াশিংটন ও বেজিঙের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য-সংঘাত বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা তৈরি করেছে। ফলে অপরিশোধিত তেলের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে এক সপ্তাহের মধ্যে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের আঁচ সরাসরি ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে এসে পড়েছে।

তেলের বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমলেও তাতে আপাতত ভারতীয় আমজনতার উদ্বাহু হওয়ার কোনও কারণ নেই। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার সুফল মিলবে না ভারতের সাধারণ নাগরিকের। বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত তেলের দাম যখন ক্রমাগত কমছে, তখন সোমবার রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ৫০ টাকা এবং পেট্রল ও ডিজ়েলের উপর লিটার প্রতি ২ টাকা উৎপাদন শুল্ক বৃদ্ধি করেছে কেন্দ্র।

বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য হ্রাস পেলেও শুল্ক বৃদ্ধি করে ঘুরপথে সেই আগের মূল্যই আমজনতার জন্য বহাল রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এখন থেকে পেট্রলের উপর অন্তঃশুল্ক বাড়িয়ে ১৩ টাকা করা হয়েছে। ডিজ়েলের ক্ষেত্রে ওই শুল্ক ১০ টাকা করা হয়েছে। বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তা হলে কি ফের বাড়তে চলেছে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম?

বহু দিন আগেই তেলের মূল্যের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়েছে কেন্দ্র। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে ওঠাপড়ার সমানুপাতিক হারে ভারতে তেলের দাম নির্ধারিত হয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের হাতে কেবল রয়েছে শুল্কের নিয়ন্ত্রণ। সেই অস্ত্র প্রয়োগ করেই সরকার নিজেদের আয়বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করল। তেলের মূল্য কমার কোনও রকম সুবিধা তো পাওয়া গেলই না, উল্টে জনতার ঘাড়ে চাপল মূল্যবৃদ্ধির বোঝা।

আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম, ডলারের বিপরীতে টাকার দর, পরিশোধনাগারের খরচ, পরিবহণ খরচ, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের শুল্ক (এক্সাইজ় ও ভ্যাট) এবং ডিলার কমিশন যোগ করে পাম্পে বিক্রির দাম স্থির হয়। রাজ্যভেদে করের হার ভিন্ন হওয়ায় এক এক জায়গায় জ্বালানির দাম এক এক রকম হয়।

অপরিশোধিত তেলের দাম সাধারণত লিটার প্রতি ৩০-৩২ টাকা। সেই ৩০ টাকার তেল ১০০ থেকে ১০৫ টাকা লিটারে বিক্রি হয় গ্রাহকদের কাছে। বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত তেলের দাম কমলেও করছাড়ের কারণে ঘাটতি হওয়া রাজস্বের লোকসান মেটাতে সরকার পেট্রল ও ডিজ়েলের উপর অন্তঃশুল্ক প্রতি লিটারে ২ টাকা বৃদ্ধি করেছে।

তেলমন্ত্রী হরদীপ সিংহ পুরীর বক্তব্য, বিশ্ববাজারে ফেব্রুয়ারিতে টনপ্রতি তেলের দাম বেড়ে ৬২৯ ডলার হয়েছিল। দু’বছরেরও কম সময়ে ৬৩ শতাংশেরও বেশি দাম বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে তেল সংস্থাগুলির আর্থিক বোঝা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। সেই বোঝা কমাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হল বলে যুক্তি দিয়েছেন তিনি।

জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে আপাতত গ্রাহকদের জন্য খুচরো দামে কোনও পরিবর্তন আনা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি। উৎপাদন শুল্ক বাড়লেও আমজনতার জন্য দাম বাড়ছে না বলেও ঘোষণা করেছেন তিনি। পুরীর দাবি, সরকার ৪৫ দিনের তেলের মজুত হাতে রেখে চলে। সেই মজুত গড়ে ৭৫ ডলারে কিনেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি। মজুত তেল থেকে আজকের কম দামে তেল বিক্রি করলে আখেরে ক্ষতির মুখে পড়বে তেল সংস্থাগুলি।

পেট্রল এবং ডিজেলের দাম কমানোর বিষয়ে অপেক্ষা-নীতির ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তেলের দাম কমার এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তা হলে জ্বালানির দাম কমার প্রত্যাশা রয়েছে বলে তেলমন্ত্রী জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞদের একাংশের যুক্তি, বিশ্ববাজারে দাম কম থাকাকালীন দেশেও কমলে উল্টো পরিস্থিতিতে দাম বাড়লেও তা গায়ে লাগে কম। তেল সংস্থাগুলিও ক্ষতি এড়াতে পারে। শেষ বার অপরিশোধিত তেল এত সস্তা ছিল ২০২১-এর জুলাই-অগস্টে। তখন দেশে (কলকাতায়) পেট্রলের লিটার ছিল প্রায় ৯৫.৪১ টাকা। এখন ১০৫.০১ টাকা। ডিজ়েল ৯১.৮২ টাকা। ফলে নানা মহল থেকে দাম কমানোর দাবি উঠলেও, তেল সংস্থা সূত্রের বার্তা, এখনই তা সম্ভব নয়। এই কম দাম যদি আরও কিছু দিন চলে তবেই আমজনতার কিছুটা সুরাহা হতে পারে।

তথ্য বলছে, যখনই বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে, তখনই সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে সরকার। ২০১৪ সালের শেষ থেকে ২০১৬ সালের গোড়া পর্যন্ত ৯ বার শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাত্র এক বছরের কিছু বেশি সময়ে ১২০ শতাংশ উৎপাদন শুল্ক বেড়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করতেই পেট্রল ও ডিজ়েলের উপর অতিরিক্ত অন্তঃশুল্ক বসায় কেন্দ্র।

সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, বেশ কিছু দিন ধরেই কেন্দ্রের কাছে তেলের উৎপাদন শুল্ক কমানোর দাবি জোরালো হচ্ছে। বিরোধী শিবির তো তা তুলছেই, বাজেট প্রস্তাবেও শিল্পমহলের একাংশ এই পরামর্শ দিয়েছে। লক্ষ্য একটাই, অন্তত শুল্ক কমিয়ে জ্বালানির দর কমানোর ব্যবস্থা করা। তাতে সাধারণ মানুষ আর্থিক ভাবে উপকৃত হবেন। তাঁদের খরচ কিছুটা কমলে বাজারে চাহিদা চাঙ্গা হতে পারে।

বিরোধী শিবির-সহ সব পক্ষেরই অভিযোগ, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে দেশে দ্রুত তা চড়ে। কিন্তু উল্টোটা হলে তার প্রতিফলন সে ভাবে পড়ে না। একমাত্র ভোট থাকলে দাম কমানোর চেষ্টা হয়। তা-ও গত বার মাত্র ২ টাকা সুবিধা দিয়ে ভোটবাক্সে ফয়দা তোলার চেষ্টা হয়েছিল, যা তেমন কাজে লাগেনি। ২০২৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে ১০০ টাকা গ্যাসের দাম কমিয়েছিল কেন্দ্র।
সব ছবি: সংগৃহীত।